ধর্ম হৈলা যাবনরূপী শিরে পরে কাল টুপী
হাতে ধরে ত্রিকচ কামান
ব্ৰহ্ম হৈলা মহম্মদ বিষ্ণু হৈলা পেগম্বর
মহেশ হইল বাবা আদিম
দেখিয়া চণ্ডিকা দেবী তেঁত তুইল হায়া বিবি।
স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, জাতির মানসক্ষেত্ৰ নানাভাবে আগে হইতেই এই বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। মুসলিম অভিযাত্রীরাই তো কল্কি-অবতার এবং অশ্বারূঢ় এই অবতারের আগমনের জন্য দূরদৃষ্টিহীন সংকীর্ণবুদ্ধি ভাগ্যনির্ভর ধর্মোপদেষ্টারা আগে হইতেই দেশের লোকের চিত্তভূমি তৈরি করিতেছিলেন। মুসলমানেরা যখন আসিয়া পড়িলেন তখন বিহ্বল বিক্ষিপ্ত জনচিত্তকে বুঝাইতে কষ্ট হইল না যে, ইহাই বিধাতার অমোঘ বিধান, কল্কি-অবতার তো আসিবেনই! দেশের ভিতরে এই অবস্থা; আর, বাহির হইতে অভিযানের পর অভিযানে যাঁহারা আসিতেছিলেন তাহদের কাছেও যে এই অবস্থা একেবারে অজ্ঞাত ছিল, এমন মনে হয় না। সোমনাথ-মন্দির হইতে আরম্ভ করিয়া প্রাচ্য-ভারতের বিহার ধ্বংস ও লুণ্ঠন যে শুধু রক্তের নেশায় এবং ধনরত্নের লোভেই, হয়তো তাহা নয়; অন্য উদ্দেশ্যও হয়তো ছিল এবং সে-উদ্দেশ্য জাতির নিগূঢ় চেতলার গভীর স্থানটিতে আঘাত হানিয়া তাহাকে নিরাশ, বিহ্বল ও বিপর্যস্ত করিয়া দেওয়া। সজ্ঞান সচেতন উদ্দেশ্য যে তাহাঁই ছিল এমন কোনও প্রমাণ নাই; কিন্তু ফলত যে তাহাই হইয়াছিল। তাহাতে আর সন্দেহ কী?
সমাজদূষ্টির সংকীর্ণতা
শেষ পর্যায়ের সামাজিক দৃষ্টি যে সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছিল তাহার প্রমাণ তো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত; নানাপ্রসঙ্গে তাহা উল্লেখও করিয়াছি। পাল-পর্বের মাঝামাঝি পর্যন্তও দেখিতেছি, বাঙলাদেশ আন্তর্দেশিক বৌদ্ধধর্মকে আশ্রয় করিয়া এবং কিছুটা ব্যাবসা-বাণিজ্যকে আশ্রয় করিয়া দেশবিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করিয়াছিল। তাহার ফলে রাষ্ট্রের দৃষ্টি কখনো একান্তভাবে প্রান্তীয় স্থানীয় সীমার মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িতে পারে নাই, গ্রামের ও নগরের সমাজও একান্তভাবে কুপমণ্ডুকতাকে এবং ঐকান্তিক ভাগ্যনির্ভরতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে নাই। তাহা ছাড়া, বর্ণ-বিন্যাস ও ধর্মকর্ম-অধ্যায়ে সবিস্তারে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, পাল-পর্বের শেষ পর্যায়ে, বিশেষভাবে সেন-বৰ্মণ পর্যয়ে মধ্যভারতীয় স্মৃতিশাসন এবং দক্ষিণী-রক্ষণশীল মনোবৃত্তি ক্রমশ বাঙলাদেশে বিস্তার লাভ করিয়া বাঙালীর সমাজকে স্তরে উপস্তরে ভাগ করিয়া এবং সমাজে পুরোহিত-প্রাধান্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া সমাজের ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল। তাহার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন উত্তরোত্তর প্রান্তীয় সীমার মধ্যেই নিজের সার্থকতা লাভের চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করিল। নানাদিক হইতে ব্যাহত হইয়া জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হইয়া ভাগ্যনির্ভরতা অর্থাৎ জ্যোতিষ এবং নানাপ্রকারের বিধিনিষেধই তাহার প্রধান আশ্রয় হইয়া দাঁড়াইল! দিগ্নিদিকে বিছুরিত হইবার, নানা কর্মে লিপ্ত হইবার সুযোগ যেখানে নাই সেখানে জীবন আত্মকেন্দ্ৰিক হইবে, ভাগ্যনির্ভর হইবে, রক্ষণশীল হইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়! বিচিত্র সংগ্রাম, বিচিত্র প্রচেষ্টা, ব্যাবসা-বাণিজ্য, দুঃসাহসিক আবিষ্কার-অভিযান, ধান-মনন, অপরিমেয় শক্তি, উদ্যম, বিশ্বাস প্রভৃতি যেখানে নিরস্ত ও নিঃসুযোগ, জীবন যেখানে বিধিবদ্ধ ও গতানুগতিক সেখানে ভাগ্য এবং পরাজয়ী মনোবৃত্তি রাষ্ট্র এবং সমাজের দৃষ্টিকে গ্রাস করিবে, ইহাই তো স্বভাবের নিয়ম। এই ভাগ্যনির্ভরতা এবং জীবনের স্তিমিত গতি প্রধানতম সমর্থন পাইয়াছিল সমসাময়িক সমাজের ঐকান্তিক ভূমি ও কৃষিনির্ভরতা হইতে। দিনের পর দিন রৌদ্র-বৃষ্টি-কড়ি, প্রকৃতির নানা ভুকুটি প্রভৃতির সঙ্গে লড়িয়া যে-কৃষক মাঠে সোনার শস্য ফলায় এবং হঠাৎ যখন একদিন দুই দণ্ডের শিলাবৃষ্টির ফলে সেই সোনার ধান ঝরিয়া যায় মাটিতে মিশিয়া, অথবা অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিতে যায় ধ্বংস হইয়া এবং তখন যাহার আশ্রয় করিবার মতো অন্য জীবনোপায় কিছু নাই, প্ৰতিকারের শক্তিও যাহার নাই সে তো ভাগ্যনির্ভর হইবেই, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস হারাইবেই। তাহা ছাড়া, কৃষিনির্ভর জীবন তো স্বাভাবিক কারণেই আঞ্চলিক ও রক্ষণশীল এবং পরিবার-গোষ্ঠী-গ্রাম-প্ৰান্ত লইয়াই সে-জীবন স্বয়ংসম্পূৰ্ণ; বৃহত্তর, পরিব্যাপ্ত এবং বৈচিত্ৰ্যময় উন্মুখর জীবনের প্রয়োজনও তাহার কাছে স্বল্প। এই ধরনের জীবনের শান্ত, স্নিগ্ধ, স্তিমিত সৌন্দৰ্য-মাধুর্য নিশ্চয়ই আছে এবং বাহির হইতে শক্তিমান, প্রখর ও প্রবল জীবনস্রোতের আঘাত কিছু না লাগিলে এই জীবনের আয়ু অর্থাৎ স্থায়িত্ব এবং শক্তিও কিছু কম নয়, কিন্তু তেমন আঘাত যখন লাগে তখন বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী; এবং বিপর্যয়ের ফলে রাষ্ট্রশক্তি ও সমাজশক্তি দুয়েরই ভিতর ফাটলও অনিবার্য। এয়োদশ শতকে বাঙালী-জীবনের বিপর্যয় এই কারণেই। কিন্তু বিপর্যয় যাহারা ঘটাইল সেই মুসলিম অভিযাত্রীরা সামরিক শক্তিতেই শুধু দুর্ধর্ষ ছিলেন; তাহারা যখন শাসক অর্থাৎ রাষ্ট্রের কর্ণধার হইয়া বসিলেন তখন কিন্তু গ্রামকেন্দ্ৰিক কৃষিনির্ভর জীবনে কোনও পরিবর্তন দেখা দিল না, জীবনের নূতন কোনও বিস্তারও ঘটিল না, না। শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যে, না দুঃসাহসী কোনও আবিষ্কার-অভিযানে, না ধ্যানে, না মননে। কাজেই মধ্য-পর্বের সুদীর্ঘ শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়িয়া বাঙালীর ভাগ্য বা দৈবনির্ভরতাও ঘুচিল না, আত্মশক্তিতে বিশ্বাসও ফিরিয়া আসিল না।
০৬. প্রাচীন বাঙলায় আর্যপ্রবাহ ক্ষীণ
নানা সূত্রে নানা অধ্যায়ে বলিয়াছি, আর্য ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধনের প্রবাহ বাঙলাদেশে আসিয়া লাগ্নিয়াছে অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে এবং যখন লাগিয়াছে তখনও খুব সবেগে, সবিস্তারে লাগে নাই। প্রবাহটি কখনো খুব গভীরতা বা প্রসারিতা লাভ করিতে পারে নাই; সাধারণত বর্ণসমাজের উচ্চতর স্তরে এবং অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, মার্জিত ও সংস্কৃত সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহা আবদ্ধ ছিল, বিশেষত আর্য ব্ৰাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি। একমাত্র আর্য বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতিই সদ্যোক্ত সীমার বাহিরে কিছুটা বিস্তার লাভ করিয়াছিল, কিন্তু তাহা আরও পরবর্তী কালে— সপ্তম-অষ্টম শতকের পর হইতে। তাহা ছাড়া, আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবাহ গঙ্গার পশ্চিম তীর পর্যন্ত, অর্থাৎ মোটামুটি পশ্চিমবঙ্গে যদি বা কিছুটা বেগবান ছিল, গঙ্গার পূর্ব ও উত্তর-তীরে সে-প্রবাহ ক্রমশ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া গিয়াছে, বিস্তৃতি এবং গভীরতা উভয়ত।