যাহাঁই হউক, প্রাচীন বাঙালীর স্বতন্ত্র রাষ্ট্ৰীয় সত্তার চেতনা যত প্ৰবলই হউক না কেন, সে চেতনা তাহার সর্বভারতীয় চেতনাকে নিরস্তু করিয়া রাখে নাই; অন্তত শশাঙ্ক হইতে আরম্ভ করিয়া ধর্মপাল-দেবপাল পর্যন্ত ভারতবৃদ্ধি অক্ষুন্ন। প্রান্তীয় স্বাতন্ত্রা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দৃষ্টিটি ভারতব্যাপী। কিন্তু, পাল-পর্বের দ্বিতীয় পর্যায় হইতেই যেন রাষ্ট্ৰীয় দৃষ্টি সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছে, নিজের প্রান্তীয় স্বতন্ত্র সত্তা এবং প্রান্তীয় লাভক্ষতিটাই যেন বড় হইয়া দেখা দিতেছে। বৈদেশিক মুসলিম অভিযাত্রীরা যখন সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও পঞ্জাব অধিকার করিয়া ফেলিয়াছে, উত্তর-ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন হিন্দুরাজশক্তি যখন মুসলিম অভিযাত্রীদের ঠেকাইয়া রাখিবার প্রাণান্তকর সংগ্রামে রত তখন মহীপালের আচরণ, অথবা পরে গাহিড়বাল রাজশক্তিকে দুর্বল করিবার মধ্যে লক্ষ্মণসেনের যে-আচরণ তাহাতে তো মনে হয়। ভারতবুদ্ধি অপেক্ষা প্রান্তীয় সচেতনতাটাই ছিল প্রবলতর, অন্তত এই পর্বে।
ধর্ম ও রাষ্ট্র
প্রাক-আর্য নানা কৌম ধর্মবিশ্বাস ও অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নানা মত, পথ ও অনুষ্ঠান, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম প্রভৃতির নানা আদর্শ ও আচার উচ্চকোটি ও লোকায়াত স্তরের বাঙালী জীবনে প্রচলিত ছিল। ধর্মমত ও পথ লইয়া বাদ-বিসংবাদ কলহ-কোলাহল ছিল না। এমন বলা যায় না; ধর্মমত বা বিশ্বাস বা বিশেষ কোনও সম্প্রদায়গত আচারানুষ্ঠানের জন্য কেহ কখনো হয়তো রাজার বা রাষ্ট্রের রোষাকর্ষণও করিয়া থাকিবেন, যদিও প্রাচীনতর কালে তেমন প্রমাণ কিছু জানা নাই। রাজা এবং রাজবংশের লোকেরা যে যাহার ইচ্ছা ও বিশ্বাসানুযায়ী এক এক ধর্মের অনুসরণ করিতেন, পোষকতাও করিতেন; হয়তো কখনো কখনো অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট হইয়া অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা ও কপিয়া থাকিবেন। সব সময়ই যে পরধর্মবিদ্বেষ হেতুই তাহা হইত, এমনও বলা যায় না; কখনো কখনো তাহার পশ্চাতে অনুক্ত রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কারণও সক্রিয় থাকিত, সন্দেহ নাই। তৎসত্ত্বেও সাধারণভাবে এ-কথা বলা চলে যে, রাজা বা রাজবংশের ব্যক্তিগত ধর্ম যাহাই হউক না কেন, তাহাতে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ ও সংস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই; জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাত্ৰাও রাজার বা রাজবংশের ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয় নাই। অন্তত পাল-পর্ব পর্যন্ত এই আদর্শ অক্ষুঃ। সেনা-বর্মণ পর্বে খুব সম্ভব এই আদর্শের ব্যত্যয় কিছু ঘটিয়াছিল; এই পর্বের একাধিক রাষ্ট্রনায়ক পরধর্ম সম্বন্ধে যে-ভাষা ব্যবহার ও যে মনোবৃত্তি প্রকাশ করিয়াছেন তাহাতে এই সন্দেহ জাগা কিছু বিচিত্র নয় এবং হয়তো তাহার ফলে রাষ্ট্রে ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে ধৰ্মগত সংকীর্ণতার কিছুটা স্পর্শ লাগিয়া থাকিবে। তাহার প্রমাণ যে একেবারে নাই, এমন নয়!
পতন ও অবসানের হেতু
বাঙলাদেশে, তথা সমগ্র উত্তর-ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র ও রাজত্বের পতন ও অবসানের প্রধান কারণ ব্যক্তিগত সাহস বা শৌর্যবীর্যের অভাব নয়; সে-কারণ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এবং সঙ্ঘশক্তির অভাব, এবং তাহার হেতু একাধিক। কৌমচেতনা, আঞ্চলিক চেতনা, সামন্ততন্ত্র, বর্ণবিন্যাসের অসংখ্য স্তরভেদ, সংকীর্ণ স্থানীয় রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রভৃতি সমািপ্তই তাহার মূলে; এ সব কথা বিস্তুত র্যাখ্যার কোনও অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয়ত, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া প্রাচীন বঙ্গদেশে, তথা ভারতবর্ষে চিরাচরিত চতুরঙ্গব্বল-রণপদ্ধতির কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই। খ্ৰীষ্টপর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্দারের অভিযান ও রণপদ্ধতি হইতে যে উন্নত ওর শিক্ষা গ্ৰহণ করা উচিত ছিল, ভারতবর্ষ তাহা করে নাই। প্ৰায় দেড় হাজার বৎসর ধরিয়া সৈন্যচালনা এবং চতুরঙ্গবলসজ্জা ও ব্যবহারের পদ্ধতি মোটামুটি একই থাকিয়া গিয়াছে। তাহার ফলে দুর্ধর্ষ মুসলিম অভিযাত্রীরা যখন বিদ্যুৎগামী অশ্বপষ্ঠে চড়িয়া বর্শা ও তরবারি হতে শ্লথগতি হস্তাশ্বরথাপদাতিক বাহিনীর বৃহের উপর ঝাপাইয়া পড়িত তখন সৈন্যাধ্যক্ষ বা সেনাবাহিনীর ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত শৌর্যবীর্য বিশেষ কোনও কাজে লাগিতা না, বিপর্যয় ঘটিত অতি সহজেই; তৃতীয়ত, বহুদিন একটি সুপ্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির এবং সুপ্রতিষ্ঠিত, সুবিন্যস্ত সমাজ ও রাষ্ট্রবিন্যাসের মধ্যে জীবনযাপনের ফলে ভারতবাসীর দহমানে এক ধরনের সনাতনী নিশ্চিস্ততা ও ভাগনির্ভরতার ধূসর আকাশ বিস্তুতি লাভ করিয়ছিল। অন্যদিকে, যে সব মুসলিম অভিযাত্রীর দল তরঙ্গের পর তরঙ্গে ভারতবর্ষের বুকের উপর ঝাপাইয়া পড়িতেছিল। তাহারা বয়সে নবীন; মারু ও পাহাড়ের প্রাকৃত্তিক ও সামাজিক আবেষ্টনে তাহাদের দেহমান দৃঢ় ও কঠোর; খাদ্য ও ধনলুণ্ঠন তাঁহাদের অন্যতম জীবনোপায়; নূতন জীবনভূমি আবিষ্কারে তাহারা বদ্ধপরিকর।; পরধর্মের প্রতি তাহাদের অপরিমেয় বিদ্বেষ এবং সর্বোপরি তাহারা সংগ্রামোন্মত্ত। দশম হইতে দ্বাদশ শতকে উত্তর-ভারতে যে নিরবসর সংগ্রাম তাহা দুই ভিন্নমুখী, বিপরীত চরিত্রের জীবনপ্রবাহের সংগ্রাম। ভারতবর্ষের জীবনপ্রবাহ অন্যতর প্রবাহকে ঠেকাইতে পারিত যদি তাহার নেতৃত্ব থাকিত, সংঘশক্তি থাকিত, রণপদ্ধতি উন্নততর হইত, রাষ্ট্ৰীয় দৃষ্টি দূরপ্রসারী হইত, জাতীয় চরিত্র আত্মশক্তিনির্ভর হইত, সমাজবিন্যাসে ভেদবুদ্ধি না থাকিত এবং দেহগত বিলাসব্যসনে সমাজ নিরক্ত, নিবীৰ্য না হইত। এ-সব কথার সবিস্তারে আলোচনা রাজবৃত্ত, ও অন্যান্য প্রসঙ্গে করিয়াছি; এখানে আর পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই। দ্বাদশ শতকের বাঙলাদেশে কোনও প্রকার প্রতিরোধের মনোবৃত্তি যে ছিল না। তাহা সুস্পষ্ট + বিজয়ী যবনবীরের প্রশস্তি গাহিয়া উমাপতিধর যে শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন, তাহাঁই তাহার একমাত্র প্রমাণ নয়। রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ এখন যে-রূপে পাইতেছি। তাহা খুব প্রাচীন না হইলেও তাহাতে, তুর্কী-বিজয়ের অব্যবহিত পরে বাঙালী হিন্দুর মনোভাবের একটু পরিচয় পাওয়া যায়।