সমাজ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবনে যেমন, পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় জীবনেও তেমনই সমগ্র ভারতবর্ষের সঙ্গে বাঙলাদেশের একটা যোগাযোগ সর্বদা ছিল এবং ভারতীয় রাষ্ট্ৰীয় জীবনে তাহার বড় একটা অংশও ছিল। মৌর্য সম্রাটদের কাল হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত সে-সম্বন্ধ কখনও ক্ষুন্ন হয় নাই; বস্তুত, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস শুধু অবাঙালীর ইতিহাস নয়। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাস মধ্য-ভারতের বাম বাহু প্রসারণের ইতিহাস এবং তাহার ফল বাঙলার কৌম রাষ্ট্রীয় জীবনে কি পরিবর্তন-বিবর্তন হইতেছে তাহারই ইতিহাস। এই পরিবর্তন-বিবর্তনের কোনও বিবরণ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই, তবে প্রান্তের বাহির হইতে কোনও ক্ষমতাবান রাজশক্তি যখন অপরিণত কৌমকেন্দ্ৰিক খণ্ড খণ্ড সংস্থার দিকে হাত বাড়াইয়া বৃহত্তর পরিধির ভিতর সেগুলিকে টানিয়া লইতে চায় তখন স্বাভাবিক কারণেই কী পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটিতে পারে তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। যাহাই হউক, ষষ্ঠ শতকের শেষ ও সপ্তম শতকের গোড়া হইতেই বাঙলাদেশ দুই বাহু বাড়াইয়া উত্তর-ভারতের বৃহত্তর রাষ্ট্ৰীয় জীবনের উন্মুখর স্রোতে ঝাপাইয়া পড়ে এবং ক্ৰমে ক্ৰমে উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতের সাধারণ রাজনৈতিক জীবনে নিজের একটি বিশিষ্ট স্থান করিয়া লয়। অষ্টম ও নবম শতকের বহুলাংশ জুড়িয়া যে তিনটি প্রধান রাষ্ট্রশক্তি সর্বভারতীয় প্ৰভুত্ব ও প্রাধান্যের জন্য লড়িয়াছিল। তাহার মধ্যে একটির কেন্দ্র ছিল বাঙলাদেশে ও আশ্রয় ছিল পাল-রাজবংশ। খুব সম্ভব, এই সময় কিংবা ইহার কিছু আগে, মাৎস্যন্যায়ের কালে বাঙলাদেশ নিজের সস্তানদের ক্রোড়বিচুর্থাৎ করিয়া পঠাইয়াছিল পঞ্জাবের পার্বত্য অঞ্চলে নূতন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য। দশম শতকে বরেন্দ্ৰভূমির গদাধর রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয়-কৃষ্ণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করিয়া দক্ষিণ-ভারতে বেলারি জেলায় একটি ক্ষুদ্র সমস্তরাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই শতকে প্রথম-মহীপালের রাজ্য ও রাষ্ট্ৰশক্তি উত্তর-ভারতের অন্যতম শক্তি বলিয়া পরিগণিত হইত। একাদশ শতক হইতে দক্ষিণ-ভারতের সঙ্গে বাঙলার রাজনৈতিক সম্বন্ধ বাড়িয়া যায় এবং ক্রমশ বাঙলাদেশ দক্ষিণী রাষ্ট্ৰীয় প্রভাবের কবলে জড়াইয়া পড়ে। তাহারই ফলে সেনা-বংশের প্রতিষ্ঠা। যাহাই হউক, একদিকে বাঙলার সীমা ডিঙ্গাইয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করা এবং তাঁহাকে সৃষ্টি ও শক্তি সম্ভাবনায় পূর্ণ করিয়া তোলা যেমন বার বার বাঙালীর পক্ষে সম্ভব হইয়াছিল, তেমনই জয়-পরাজয়ের ভিতর দিয়া বাঙলাদেশ ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যোগরক্ষা করিতেও পশ্চাদপদ হয় নাই। শুধু রাষ্ট্রীয় সম্বন্ধ আশ্রয় করিয়াই নয়, ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং ধর্ম ও সংস্কৃতিগত সম্বন্ধ আশ্রয় করিয়াও বাঙলাদেশ নিখিল ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করিয়া চলিত, কাশ্মীর হইতে সিংহল এবং গুজরাট হইতে কামরূপ পর্যন্ত। ভারতবর্ষের বাহিরে— তিব্বতে, ব্ৰহ্মদেশে, সুবর্ণদ্বীপে, পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী অন্যান্য দেশ ও দ্বীপগুলিতেও— তাহার যোগাযোগ নানা সূত্রে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। কাজেই, প্রান্তীয় দেশ বলিয়া প্রাচীন বাঙলাদেশ শুধু তাহার পুকুর পাড়ে, বটের ছায়ে ঘরের দাওয়ায় বসিয়া নিজের ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ লইয়া একান্ত আত্মকেন্দ্ৰিক জীবন যাপন করিত, এমন মনে করিবার কোনও কারণ নাই।
রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বাতন্ত্র্য
খ্রীষ্টোত্তর তৃতীয়-চতুর্থ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসে ওঠা-পড়া ভাঙা-গড়ার শেষ নাই। কিন্তু ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়া বাঙলাদেশ একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ সম্বন্ধে সর্বদা সজাগ ছিল— সে তাহার রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বীকৃতি। গুপ্ত-পর্বে যখন এই দেশ উত্তরভারতীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত তখনও এই আদর্শ একেবারে বিস্মৃত নয়। কিন্তু শশাঙ্কের সময় হইতেই এ-সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়িয়া যায়। আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প-গ্রন্থে যখন গৌড়তন্ত্রের কথা পড়িতেছি তখন তাহার মধ্যেও এই সচেতনতার সুপরিস্ফুট। পরবর্তীকালে তো স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তার আদর্শ ক্রমশ আরও পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছে, বিশেষত পাল-আমলে। এই স্বাধীন স্বতন্ত্র সন্তার চেতনাই বাঙলার রাষ্ট্রীয় চেতনা। নানা অন্তৰ্দ্ধন্দ্ব, নানা রাষ্ট্ৰীয় কলকোলাহল এই চেতনাকে বার বার বিপর্যস্ত করিয়াছে, কিন্তু বার বারই বাঙলাদেশ সেই আদর্শকে ফিরিয়া পাইতে চেষ্টাও করিয়াছে। প্রাচীন বাঙালীর এই আদর্শের তথা রাষ্ট্ৰীয় সচেতনতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মাৎস্যন্যায়োৎপীড়িত বাঙালীর গোপালদেবকে রাজপদে নির্বাচন। এই ধরনের সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয় শুভবুদ্ধির দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিরল।
অথচ এই আদর্শ খণ্ডিতও হইয়াছে বার বার নানা আঞ্চলিক চেতনাসঞ্জাত অনৈক্য ও অন্তৰ্দ্ধান্দ্বের ফলে এবং তাহার ফলে বার বার জাতীয় জীবন বিপন্নও হইয়াছে। এই অনৈক্য ও অন্তৰ্দ্ধান্দ্বের মূলে যে শক্তি ছিল সক্রিয়, তাহা সামন্তন্ত্রের; বস্তুত আঞ্চলিক সামন্তরাই নেতৃত্ব ও সংঘশক্তিতে স্থায়ীভাবে কখনও সবল ও সমৃদ্ধ হইতে দেন নাই, দীর্ঘস্থায়ী অখণ্ড রাজ্য এবং রাষ্ট্রও গড়িতে দেন নাই।