এই দুই শত বৎসরের বাণিজ্যিক অবস্থার সদ্যোক্ত বিবর্তন-পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ছাপ পড়িয়াছে সমসাময়িক স্বর্ণমুদ্রার উপর, কারণ, আমি আগেই বলিয়াছি, প্রাচীন ভারতবর্ষে স্বর্ণমুদ্রার উন্নত বা অবনত অবস্থা বা অপ্রচলন আমাদের সমৃদ্ধ বা অবনত বৈদেশিক বাণিজ্যের দোতক। ইতিহাসের যে-পর্বে বৈদেশিক বাণিজ্য-সমতার লাভ আমাদের পক্ষে, আধুনিক পরিভাষায় আমরা যে পরিমাণে favourable trade balance আহরণ করিয়াছি তখন সেই পরিমাণে আমাদের স্বর্ণমুদ্রা উন্নত ও সমৃদ্ধ, প্রচলন বিস্তৃত; যখন তাহা নাই তখন স্বর্ণমুদ্রাও নাই, অথবা থাকিলেও তাহার নিকষামূল্য, ওজন্যমূল্য এবং শিল্পমূল্য আপেক্ষিকত কম। রৌপ্যমুদ্রা সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা বলা চলে। এ-কথার প্রমাণ পাওয়া যাইবে, ষষ্ঠ ও সপ্তম-শতকের উত্তর-ভারতীয় মুদ্রার ইতিহাসে। এই দুই শতক জুড়িয়া মুদ্রার ক্রমাবনতি কিছুতেই ঐতিহাসিকের দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। প্রথম স্তরে দেখা যাইবে স্বর্ণমুদ্রার ওজন ও নিকষামূল্য ক্রমশ কমিয়া যাইতেছে; দ্বিতীয় স্তরে স্বর্ণমুদ্রা নকল ও জাল হইতেছে; তৃতীয় স্তরে রৌপ্যমুদ্র স্বর্ণমুদ্রাকে হাঁটাইয়া দিতেছে; চতুর্থ স্তরে রৌপ্যমুদ্রা অবনত হইতেছে, পঞ্চম স্তরে রৌপ্যমুদ্রাও অন্তৰ্হিত। ভারতবর্ষের সর্বত্রই যে একেবারে একই সময়ে বা একেবারে সুনির্দিষ্ট স্তরে স্তরে এইরূপ হইয়াছে তাহা নয়; কোথাও কোথাও হয়তো গচ্ছিত স্বর্ণ বা স্বর্ণমুদ্রা পরবর্তীকালে গলাইয়া নূতন স্বর্ণমুদ্র চালাইবার চেষ্টা হইয়াছে, কিন্তু সে-চেষ্টা বেশিদিন চলে নাই বা পরিণামে সার্থক হয় নাই, বা তাহার ফলে উচ্চ শ্রেণীর ধাতবমুদ্রার যে গতিপ্রকৃতির কথা এইমাত্ৰ বলিলাম। তাহারও ব্যত্যয় বিশেষ হয় নাই।
ধনসম্বল অধ্যায়ে বাঙলাদেশে মুদ্রার বিবর্তন সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি; এখানে আর তাহার-পুনরুক্তি করিব না। সেই বিবরণ-বিশ্লেষণে সুস্পষ্ট ধরা যায় যে, মুদ্রার এই ক্রমাবনতির প্রধান ও প্রথম কারণ বৈদেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যের অবনতি। সেই অবনতির হেতু একাধিক। সে-সব কারণ এই গ্রন্থেই নানাস্থানে উল্লেখ ও আলোচনা করিয়াছি। ব্যাবসা-বাণিজ্যের এই অবনতিতে শিল্প-প্রচেষ্টারও কিছুটা অবনতি ঘটিয়াছিল সন্দেহ নাই, গুণ বা নিপুণতার দিক হইতে না হউক, অন্তত পরিমাণের দিক হইতে। কারণ, বহির্দেশে যে-সব জিনিসের চাহিদা ছিল সে-সব চাহিদা কমিয়া গিয়াছিল; তাহা ছাড়া এই বাণিজ্যে দেশের বণিকদের প্রত্যক্ষ অংশ যখন পরোক্ষ অংশে পরিণত হইয়া গেল তখন সঙ্গে সঙ্গে লাভের পরিমাণ কিছুটা কমিয়া যাইবে ইহা কিছু বিচিত্র নয়। এই সব কারণে সমাজে কৃষি-নির্ভরতা বাড়িয়া যাওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং অষ্টম শতক হইতে দেখা যাইবে গাঙ্গেয় ভারতে, বিশেষভাবে বাঙলাদেশে ঐকান্তিক কৃষিনির্ভরতা ক্রমবর্ধমান এবং আদিপর্বের শেষ অধ্যায়ে, অর্থাৎ অষ্টম হইতে ত্ৰয়োদশ শতকের বাঙলাদেশ একান্তই কৃষিনির্ভর, অর্থাৎ কৃষিই ধনোৎপাদনের প্রথম ও প্রধান উপায়, শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য অন্যতম উপায় হইলেও তেমন লাভবান নয়, অর্থাৎ বাণিজ্য-সমতা দেশের স্বপক্ষে আর নাই; পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী দ্বীপ ও দেশগুলির সঙ্গে কিছু কিছু ব্যাবসা-বাণিজ্য থাকা সত্ত্বেও নাই!
ঐকান্তিক ভূমি ও কৃষিনির্ভরতায় রূপান্তর
অষ্টম শতকের গোড়া হইতেই পূর্ব ভূমধ্য-সাগর হইতে আরম্ভ করিয়া প্রশান্ত-মহাসাগর পর্যন্ত ভারতবর্ষের সমগ্র বৈদেশিক সামুদ্রিক ব্যাবসা-বাণিজ্য আরব ও পারসীক বণিকদের হাতে হস্তান্তরিত হইয়া যাইতে আরম্ভ করে এবং দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত সে-প্রভাব ক্রমবর্ধমান। দক্ষিণ-ভারত বহুদিন পর্যন্ত, কতকাংশে হইলেও, এই আরব বণিকশক্তির সঙ্গে (এবং পূর্ব-সমুদ্রে চীনা বণিক-শক্তির সঙ্গে) কিছুটা পরিমাণে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করিয়া নিজেদের বাণিজ্য লব্ধ ধনের ভারসাম্য রক্ষা করিয়াছিল, কিন্তু উত্তর-ভারতে তাহা সম্ভব হয় নাই! তাহার সমস্ত পথই গিয়াছিল। রুদ্ধ হইয়া; এবং তাঙ্গার ফলে বাঙলাদেশও এই বৃহৎ বািণজ্যসম্বন্ধ হইতে বিচু্যত হইয়া পড়িয়াছিল। তবু প্ৰাচ্যদেশের বাঙলা-বিহার পালরাজাদের আমলে একটা সজ্ঞান, সচেতন চেষ্টা করিয়াছিল স্থলপথে হিমালয়শায়ী কাশ্মীর, তিব্বত, নেপাল, ভূটান, সিকিম প্রভৃতি দেশের সঙ্গে একটা বাণিজ্য-সম্বন্ধ গড়িয়া তুলিতে এবং কিছুদিনের জন্য অন্তত কিছুটা পরিমাণে সে-চেষ্টা সার্থকও হইয়াছিল, সন্দেহ নাই। এই ধরনের একটা চেষ্টা পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী ব্ৰহ্মদেশ, শ্যাম, চম্পা, কম্বোজ, যবন্দ্বীপ, বলিদ্বীপ, সুবর্ণদ্বীপ প্রভৃতির সঙ্গেও হইয়াছিল। কিন্তু কোনও চেষ্টাই যথেষ্ট সার্থকতা লাভ করিয়া এই পর্বের বাঙলার ঐতিহাসিক কৃষিনির্ভরতা ঘুচাইতে পারে নাই, বরং তাহা ক্রমবর্ধমান হইয়া পাল-আমলের শেষের দিকে এবং সেন-আমলে বাঙলাদেশকে একেবারে ভূমিনির্ভর, কৃষিনির্ভর গ্রাম্যসমাজে পরিণত করিয়া দিল। এই পর্কে যে স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা, এমনকি কোনও প্রকার ধাতব মুদ্রার সাক্ষাৎই আমরা পাইতেছি না, ইহার ইঙ্গিত তুচ্ছ করিবার মতন নয়।
এই ঐকান্তিক ভূমি ও কৃষিনির্ভরতা প্রাচীন বাঙলার সমাজ জীবনকে একটা স্বনির্ভর স্বসম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত স্থিতি ও স্বাচ্ছন্দ্য দিয়াছিল, এ-কথা সত্য; গ্রাম্য জীবনে এক ধরনের বিস্তৃত ও পরিব্যাপ্ত সুখশান্তিও রচনা করিয়াছিল, সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহ সমগ্র জীবনকে বিচিত্র ও গভীর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করিতে পারে নাই; ইতিহাসের কোনও পর্বে কোনও দেশেই তাহা সম্ভব হয় নাই, হওয়ার কথাও নয়। আমি আগে বলিতে চেষ্টা করিয়াছি, আমাদের কৌম ও আঞ্চলিক চেতনার প্রাচীর যে আজও ভাঙে নাই তাহার অন্যতম কারণ এই একান্ত ভূমিনির্ভর কৃষিনির্ভর জীবন। শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের বিচিত্র ও গভীর সংগ্ৰামময়, বিচিত্ৰ বহুমুখী অভিজ্ঞতাময় এবং বৃহত্তর মানবজীবনের সঙ্গে সংযোগময় জীবনের যে ব্যপ্তি ও সমৃদ্ধি, যে উল্লাস ও বিক্ষোভ, বৃহতের যে উদ্দীপনা তাহা স্বল্প পরিসর গ্রামকেন্দ্ৰিক কৃষিনির্ভর জীবনে সম্ভব নয়। সেখানে জীবনের ছন্দ শান্ত, সীমিত, তাল সমতাল; সে-জীবনে পরিমিত সুখ ও পারিবারিক বন্ধনের আনন্দ ও বেদনা, সুবিস্তৃত উদার মাঠ ও দিগন্তের, নদীর ঘাট ও বটের ছায়ার সৌন্দর্য। যাহাই হউক, বাঙলাদেশের আদিপর্বের শেষ অধ্যায় এই ভূমি ও কৃষিনির্ভর সমাজ-জীবনই মধ্যপর্বের হাতে উত্তরাধিকারস্বরূপ রাখিয়া গেল, আর রাখিয়া গেল তাহার প্রাচীনতর পর্বের সমৃদ্ধ শিল্প ব্যাবসা-বাণিজ্যের সুউচ্চারিত স্মৃতি। সেই স্মৃতি মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে বহমান। আমাদের প্রাচীন গ্রামবিন্যাস, রাষ্ট্রবিন্যাস, শ্রেণী ও বর্ণবিন্যাস, শিল্প ও সংস্কৃতি, ধর্মকর্ম সমস্তই বহুলাংশে সদ্যোক্ত গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিনির্ভর সমাজ-জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত।
০৫. রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বাতন্ত্র্য
প্রাচীন বাঙলার রাজবৃত্ত ও রাষ্ট্র জীবনের ধারার কথা এই গ্রন্থের দুটি অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। সেই সুবিস্তৃত বিশ্লেষণ হইতে কয়েকটি ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ধরা পড়ে।