শুধু এই সামুদ্রিক বাণিজ্যই নয়। বহু প্ৰাচীন কাল হইতেই উত্তর-পূর্ব চীনের পূর্বতম সমুদ্রোকুল হইতে আরম্ভ করিয়া মধ্য-এশিয়ার মরুভূমি পার হইয়া পামীরের উষ্ট্রপৃষ্ঠ বাহিয়া আফগানিস্তানের ভিতর দিয়া ইরাণ-দেশ অতিক্রম করিয়া একেবারে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যে সুদীর্ঘ আন্তরেশীয় প্রাস্তাতিপ্রান্ত পথ সেই পথ দিয়াও একটা বৃহৎ বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল। প্রথম চন্দ্ৰগুপ্ত মৌর্যের পশ্চিমাভিযানের ফলে ভারতবর্য সর্বপ্রথম এই পথের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্বন্ধসূত্রে আবদ্ধ হয় এবং তাহার কিছুদিন পর হইতেই নানা বিদেশী বণিককুলের সঙ্গে বাণিজ্যসূত্রে ভারতবর্ষ। ধনাগমের এক নূতন পথ খুঁজিয়া পায়। খ্ৰীষ্টপূর্ব ও খ্রীষ্টোত্তর প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে শক-কুষাণ অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে এই পথ বিস্তৃততর এবং বাণিজ্য গভীরতর হয় এবং তাহার ফলে দেশে স্বর্ণপ্রবাহের আর একটি দ্বার উন্মুক্ত হয়। পঞ্চম শতকে গুণাভিযানের পূর্ব পর্যন্ত এই দ্বার উন্মুক্তই ছিল, কিন্তু হ্রণরা মধ্য-এশিয়ার সঙ্গে ভারতবর্ষের এই সম্বন্ধ বিপর্যস্ত করিয়া দেয়।
এই সুবিস্তৃত এবং সুপ্রচুর লাভজনক বৈদেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যই প্রত্যক্ষভাবে দেশের শিল্পকে, বিশেষভাবে দেশের বস্ত্র ও গন্ধশিল্পকে, দস্তু ও কণ্ঠশিল্পকে অগ্রসর করিয়া দেয়, কোনও কোনও কৃষিজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়াইয়া কৃষিকেও অগ্রসর করে। এই সবের ফলে বাণিজ্যলব্ধ ধন সমাজের নানাস্তরে বণ্টিত হইতে আরম্ভ করে এবং সাধারণ কৃষক এবং গ্রামবাসী গৃহস্থেরও জীবনের মান অনেকাংশে উন্নত হয়। সাধারণ গৃহস্থের ভাণ্ডারেও স্বর্ণমুদ্রা এই যুগেরই সামাজিক লক্ষণ।
এই সুবিস্তৃত বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য, এই কয়েক শতাব্দী জুড়িয়া ভারতবর্ষের সর্বত্র সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন; বিশেষত তৃতীয়-চতুর্থ শতক হইতেই এই সুবর্ণমুদ্রা একেবারে নিকষোত্তীর্ণ খাটী সুবর্ণমুদ্রা এবং তাহার ওজন বাড়িতে বাড়িতে প্রমথকুমার গুপ্তের আমলে এই মুদ্রা একেবারে চরম শিখরে উঠিয়া গিয়াছে; ধাতব মূল্যে, শিল্পমূল্যে, আকৃতি-প্রকৃতিতে এই মুদ্রার সত্য কোনও তুলনা নাই! এই কয়েক শতকের রৌপ্যমুদ্রা সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। এ-তথ্যও উল্লেখযোগ্য যে, এই সুবর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রার নাম যথাক্রমে দীনার ও দ্রাহ্ম , এবং এই দুইই এই যুগের লাভজনক বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতীক। আর, এই যুগে নগর-সভ্যতার বিস্তাব ও সমৃদ্ধ নাগরিক আদর্শের যে-পরিচয় বাৎসায়নের কামসূত্রে দেখিতেছি, তাহা তো প্রত্যক্ষভাবে এই সামাজিক ধনের উপরই প্রতিষ্ঠিত।
উত্তর-ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই সুবৃহৎ বৈদেশিক, বিশেষভাবে সামুদ্রিক-বাণিজ্যে বাঙলাদেশ অন্যতম অংশীদার হইয়াছিল এবং সেই বাণিজ্যলব্ধ সামাজিক ধনের কিছুটা অধিকার লাভ করিয়াছিল। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, গঙ্গাবিন্দর ও তাম্রলিপ্তি বাঙলার সমৃদ্ধ সামুদ্রিক বন্দর; খ্ৰীষ্টোত্তর প্রথম শতকের আগে হইতেই এই বন্দরদ্বয়ের কথা নানাসূত্রে শোনা যাইতেছে, আমদানী-রপ্তানীর খবরও পাওয়া যাইতেছে। বাঙলাদেশ, বিশেষভাবে উত্তরবঙ্গ গুপ্তাধিকারে আসিবার পর হইতেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সঙ্গে তাহার যোগসূত্র আরও ঘনিষ্ঠ হয় এবং এই বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ক্রমশ আরও বাড়িয়াই চলে। বস্তুত, পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে দেখিতেছি উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে গ্রামের সাধারণ গৃহস্থও ভূমি কেনাবেচা করিতেছেন স্বর্ণমুদ্রায়। স্বর্ণমুদ্ৰাই যে এ-যুগের মুদ্রামান, এ-সম্বন্ধে বোধ হয় সন্দেহ করা চলে না। তাহা ছাড়া বাঙলাদেশের সর্বত্র এই যুগে দেখিতেছি, শাসনাধিকরণগুলিতে রাজ্যপাদোপজীবী ছাড়া আর যে তিনজন থাকিতেন। তাঁহাদের একজন নগরশ্রেষ্টী, একজন প্রথম সার্থিবাহ, একজন প্রথম কুলিক, অর্থাৎ প্রত্যেকেই শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রতিনিধি। সমসাময়িক সমাজ ও রাষ্ট্র শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যকে কতখানি মূল্য দিত। তাহা এই তথ্যে সুস্পষ্ট।
বস্তুত, কিছুটা পরিমাণে কৃষিনির্ভরতা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ ও বাঙলার এই কয়েক শতকের সমাজ প্রধানত ও প্রথমত ব্যাবসা-বাণিজ্য ও শিল্পনির্ভর, অর্থাৎ ধনোৎপাদনের প্রথম ও প্রধান উপায় শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য, কৃষি অন্যতর উপায় মাত্র। তাহা ছাড়া, যেহেতু বৈদেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যে শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদাই ছিল বেশি সেই হেতু ব্যবসা-বাণিজ্যলব্ধ অর্থ শ্রেষ্টী ও সার্থিবাহিকুল এবং রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীকৃত হওয়ার পরও মোটামুটি একটা বৃহৎ অংশ শিল্পীকুলের হার্তেও গিয়া পৌঁছিত। অধিকন্তু, গ্রামবাসী গৃহস্থের ভূমি কেনাবেচায় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন দেখিয়া মনে হয় গৃহপতি এবং কৃষক সমাজেও উৎপাদিত ধনের কিছু অংশ আসিয়া পড়িত। ইহারই প্রত্যক্ষ ফল জীবনধারণের মানের উন্নতি ও প্রসার এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি।
কিন্তু ৪৭৫ খ্ৰীষ্ট শতকে বিরাট রোম-সাম্রাজ্য ভাঙিয়া পড়িল; পূর্ব-পৃথিবীর সঙ্গে তাহার ব্যাবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত হইয়া গেল। তবু, যতদিন পর্যন্ত মিশর দেশ ও আফ্রিকার পূর্ব কুলে কৃলে সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল ততদিন তাহাকে আশ্রয় করিয়া বিগত সুদীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর সুবিস্তৃত বাণিজ্যের অবশেষ আরও কিছুদিন বঁচিয়া রহিল; সে-জৌলুস বা সে-সমৃদ্ধি বহুলাংশে কমিয়া গেল, সন্দেহ নাই, কিন্তু একেবারে অন্তৰ্হিত হইল না। সমস্ত ষষ্ঠ শতক এবং সপ্তম শতকের অর্ধাংশ প্রায় এই ভাবেই চলিল, কিন্তু ইতোমধ্যেই মহম্মদ-প্রবর্তিত ইসলামধর্মকে আশ্রয় করিয়া আরবদেশ আবার ধীরে ধীরে মাথা তুলিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং ৬০৬-৭ খ্রীঃ তারিখের পর একশত বৎসরের মধ্যে স্পেন হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে চীনদেশের উপকূল পর্যন্ত আরব বাণিজ্যতরী ও নৌবাহিনী সমস্ত ভূমধ্য-সাগর, লোহিত্য-সাগর, ভারত-মহাসাগর এবং প্রশান্ত-মহাসাগর প্রায় ছাইয়া ফেলিল। ৭১০ খ্রীষ্ট শতকে পশ্চিম-ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম আশ্রয় সিন্ধুদেশ চলিয়া গেল আরব বণিকের হাতে এবং সিন্ধু গুজরাটের স্বর্ণদ্বার প্রায় বন্ধ হইয়া গেল বলিলেই চলে। রোম-সাম্রাজ্যের ধ্বংসের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় ভূখণ্ডে ভারতীয় শিল্প ও গন্ধ দ্রব্যাদির চাহিদাও গেল কমিয়া। অন্যদিকে পূর্ব-ভারতে তাম্রলিপ্তির বন্দরও একাধিক কারণে বন্ধ হইয়া গেল।