সামাজিক ধনের উৎপাদন ও বণ্টন
খ্ৰীষ্টপূর্ব-শতকীয় বাঙলার আদিম কৌমস্তরে সামাজিক ধনের উৎপাদন ও বণ্টন পদ্ধতি কী ছিল ও তাহার ক্রমবিবর্তন কী ভাবে হইয়াছিল। তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই। তবে, আদিম সমাজের গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী কী হওয়া সম্ভব সে সম্বন্ধে অনুমান করা খুব কঠিন নয়; তাহা এই গ্রন্থেরই নানা অধ্যায়ে ব্যক্ত করিয়াছি। কাজেই, সেই সুদূর কাল সম্বন্ধে অনুমানসিদ্ধ তথ্যের পুনরুক্তি এখানে আর করিতেছি না। তবু, একথা বলা বোধ হয় প্রাসঙ্গিক যে, মোটামুটি খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া আনুমানিক খ্ৰীষ্টোত্তর প্রথম শতক পর্যন্ত গাঙ্গেয় ও প্রাচ্য ভারতবর্যের প্রধান ধনোৎপাদন উপায় ছিল কৃষি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত ও যৌথ গৃহশিল্প এবং কিছু ব্যাবসা-বাণিজ্য। ধন কেন্দ্রীয়কৃত হইত বড় বড় গৃহপতিদের এবং শ্রেষ্ঠী ও সার্থিবাহদের হাতে। জাতকের গল্প ও অন্যান্য প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে নানা প্রমাণ এ-সম্বন্ধে বিক্ষিপ্ত এবং মনীষী রিচার্ড ফিখ তাহা খুব ভালো করিয়াই দেখাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু ব্যাবসা-বাণিজ্যের পুরাপুরি সুবিধাটা গাঙ্গেয় ও প্রাচ্য-ভারত অপেক্ষা বেশি পাইত উত্তর, পশ্চিম ও মধ্যভারত। একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে, পুণ্ড্রবর্ধন, তাম্রলিপ্তি, পাটলীপুত্র প্রভৃতি সত্ত্বেও প্রধান প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ও বন্দরগুলি ছিল বেশির ভাগই উত্তর-পশ্চিমে, মধ্য-ভারতে এবং বিশেষ ভাবে পশ্চিম-ভারতের সমুদ্রোপকূলে! বস্তুত, সমসাময়িক ভারতবর্ষের সমস্ত বাণিজ্যপথগুলির গতি একান্তই পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমমুখী। কিন্তু ব্যাবসা-বাণিজ্যের কথা যতই থাকুক, শ্রেষ্ঠীসােৰ্থবাহদের কথা যতই পড়া যাক, প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য বিশ্লেষণ করিলে বুঝিতে বাকী থাকে না যে, অন্তত গাঙ্গেয় ও প্রাচ্য-ভারতের জীবন ছিল একান্তই কৃষিকেন্দ্রিক। ব্যাবসা-বাণিজ্য সাধারণত বোধ হয় বিনিময়েই চলিত; চিহ্রাঙ্কিত মুদ্রার প্রচলন যথেষ্ট ছিল, পাওয়াও গিয়াছে প্রচুর, কিন্তু তাহার ভিতর স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা প্রায় দেখিতেছি না। ইহার অর্থ বোধ হয় এই যে, ব্যাবসা-বাণিজ্য সত্ত্বেও আধুনিক ধনবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা যাহাকে বলি বাণিজ্যসাম্য বা ব্যালেন্স অফ ট্রেড তাহা ভারতবর্ষের স্বপক্ষে ছিল না, অথবা থাকিলেও স্বর্ণ এবং রৌপ্য (মুদ্রার আকারেই হোক আর তালের আকারেই হোক) কেন্দ্রীকৃত হইয়া থাকিত মুষ্টিমেয় শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, গৃহপতি প্রভৃতি এবং রাষ্ট্রের হাতেই, অর্থাৎ সামাজিক ধন সমাজের সকল স্তরে বণ্টিত হইত না, ছড়াইয়া পড়িবার বেশি উপায় ছিল না; উদ্ধৃত্তি ধনের পরিমাণও বোধ হয় খুব বেশি ছিল না। বাঙলাদেশ গাঙ্গেয় ভারতের অন্যতম পূর্বপ্রত্যন্ত দেশ। পুণ্ড্রবর্ধনের মত বাণিজ্য-নগর এবং তাম্রলিপ্তির মতন বন্দর-নগর তাহার ছিল সত্য, কিন্তু তৎসত্ত্বেও উত্তর-ভারতের ব্যাবসা-বাণিজ্যে বাঙলার এবং তদানীন্তন বাঙালীর স্থান খুব বেশি ছিল বলিয়া মনে হয় না, কারণ বাঙালীর সমাজ তখনও একান্তই কৌমাবদ্ধ; সর্বভারতীয় সভ্য জীবনের তরঙ্গাভিঘাত তখনও ভালো করিয়া সেই সমাজে লাগেই নাই। বহুদিন পর্যন্ত বাঙলাদেশ ছোট ছোট গৃহশিল্প, পশুপালন ও কৃষিলব্ধ জীবনোপায়েই অভ্যস্ত ছিল। কিছু কিছু বহির্দেশী ব্যাবসা-বাণিজ্য যাহা ছিল তাহা উত্তর-গাঙ্গেয় ভারতের সঙ্গে তুলনীয় নয়, এমন কি খুব উল্লেখযোগ্যও বোধ হয় নয়।
বৈদেশিক বাণিজ্যের বিবর্তন ও সামাজিক ধন
শ্ৰীক্টোত্তর প্রথম শতকের মাঝামাঝি হইতেই ভারতবর্যের সর্বত্র এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আরম্ভ হয় এবং সামাজিক ধন উত্তরোওর বর্ধিত হইয়া, জীবনধারণের মান উত্তরোত্তর উন্নত হইয়া চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে, ভারতবর্ষ যথার্থতি সোনার ভারতে পরিণতি লাভ করে; এই দুই শতাব্দী জুড়িয়া যথাযথ এবং আক্ষরিক অর্থে ভারতবর্ষে স্বর্ণযুগের বিস্তৃতি। এই বিবর্তন-পরিবর্তনের প্রধান কারণ, ব্যাবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতি। বস্তুত, এই কয়েক শতক ধরিয়া ব্যাধসা-বাণিজ্য, বিশেষভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান এবং এই ব্যাবসা-বাণিজ্যই সামাজিক ধনোৎপাদনের প্রধান উপায়। খ্ৰীষ্টোত্তর প্রথম শতকের মাঝামাঝি হইতে উত্তর ও দক্ষিণ-ভারত সুবিস্তুত রোম-সাম্রাজ্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়। তাহার আগেও বহুশতাব্দী ধরিয়া পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে জলপথে ভারতবর্ষের একটা বাণিজ্য সম্বন্ধ ছিল; এই দেশগুলিতে ভারতীয় নানা দ্রব্যাদির চাহিদাও ছিল; কিন্তু বাণিজ্যটা প্রধানত ছিল আরব বণিকদের হাতে। কিন্তু মোটামুটি ৫০ খ্ৰীষ্ট তারিখ হইতে নানা কারণে রোম সাম্রাজ্য এবং ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষভাবে এই বাণিজ্য ব্যাপারে লিপ্ত হইবার সুযোগ লাভ করে এবং দেশে ধনাগামের একটি স্বর্ণদ্বার ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়। বস্তুত, এই বাণিজ্য ব্যাপারে সাক্ষাৎভাবে আমাদের দেশ এত লাভবান হইতে আরম্ভ করে, এত রোমক সোনা বহিয়া আসিতে আরম্ভ করে যে, দ্বিতীয় শতকে ঐতিহাসিক প্লিনি অত্যন্ত দুঃখে বলিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, যে-ভাবে ভারতবর্ষে সোনা বহিয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছে। এ-ভাবে বেশি দিন চলিলে সমস্ত রোমক সাম্রাজ্য স্বর্ণহীন, রক্তহীন হইয়া পড়িবে। সিন্ধুদেশের সমুদ্রোপকূল হইতে আরম্ভ করিয়া গঙ্গা-বন্দর ও তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত সমস্ত উপকূল বহিয়া কুড়িটিরও বেশি ছোট বড় সামুদ্রিক বন্দর, প্রতি বন্দরে বৈদেশিক বাণিজ্যোপনিবেশ। এই সব বন্দর, বিশেষভাবে পশ্চিম ভারতের ভৃগুকচ্ছ, সুরাষ্ট্র, কল্যাণ প্রভৃতি বন্দর আশ্রয় করিয়া জাহাজে জাহাজে রোমক সোনার স্রোত বহিয়া আসিত সমুদ্রতীরস্থ ভারতবর্ষে সর্বত্র। বস্তুত, পশ্চিম-ভারতে এই স্বর্ণদ্বারের অধিকার লইয়াই তো শাক-সাতবাহন সংগ্রাম, দ্বিতীয়-চন্দ্রগুপ্তের পশ্চিম-ভারত অভিযান, স্কন্দগুপ্তের বিনিদ্র রজনী যাপন। কারণ, এই দ্বার করাঢ়াত হওয়ার অর্থই হইতেছে দেশে ধনাগমের একটি প্রশস্ত পথ বন্ধ হওয়া। দক্ষিণ-ভারতের দ্বার ছিল অনেক; কাজেই দুর্ভাবনার কারণ ছিল না; কিন্তু উত্তর-ভারতের প্রধান পথ ঐ গুজরাটের বন্দরগুলি আর স্বল্পাংশে গঙ্গা ও তাম্রলিপ্তি বন্দর। এই বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্যলব্ধ স্বণই গুপ্ত আমলের স্বর্ণ যুগের ভিত্তি। এই সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া মনন ও কল্পনা, ধর্ম ও জ্ঞান-বিজ্ঞান, কলা ও সাহিত্যে ভারতীয় বৃহৎ ও গভীর চেতনা সঞ্চারের মূলে, জীবনধারণের মানকে উন্নত স্তরে উত্তীর্ণ করিবার মূলে; এই মান উন্নত না হইলে, চেতনা সঞ্চারিত না হইলে সাংস্কৃতিক জীবন উন্নত হয় না।