বাঙলাদেশ সম্বন্ধেও ঠিক একই কথা বলা চলে, বরং আর্যস্থানবহির্ভূত পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ বলিয়া একটু বেশিই বলা চলে। প্রাচীন বাঙলা ও বাঙালী জীবনের সর্বত্র ইতিহাসের রথচক্ৰ সমান গতিতে চলে নাই; ভূমিও তো সমতল নয়। তাহার ফলে আমাদের সমাজের ও জীবনের নানা স্থানে নানা অসমতা, অসংগতি; কোথাও গতি একেবারে স্তব্ধ ও নিরস্ত, কোথাও খুব দ্রুত ও চঞ্চল, কোথাও আমরা চলিয়াছি সাম্প্রতিক প্রাগ্রসর পৃথিবীর সঙ্গে সমতালে, কোথাও পড়িয়া আছি। প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতার মধ্যে! নানা স্তরের নানা অনুন্নত সমাজাংশকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির একই স্তরে আনিয়া সমতলে প্রতিষ্ঠিত করিয়া ইতিহাসের গতিকে সহজ, সুসম ও সরল করিয়া দিবার কোনও বৈপ্লবিক চেষ্টা প্রাচীন বাঙলায় হয় নাই; আজ অবধি হয় নাই; এবং সেই জন্যই আজও অবনত বা অনুন্নত বৰ্ণ, শ্রেণী ও সংস্কৃতি-স্তর আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। ভালো মন্দর কথা নয়, ইতিহাসে যাহা ঘটিয়াছে বা ঘটে নাই, তাহাই বলিতেছি।
তবে, অবাস্তর হইলেও এ-প্রসঙ্গে একটি কথা বলা উচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়। ভারতবর্ষের বাহিরে প্রায় সর্বত্রই সভ্য, সংস্কৃতিপূত মানবগোষ্ঠী চেষ্টা করিয়াছে বৃহৎ অনুন্নত আদিম মানবসমাজকে নানাপ্রকারে শোষণ ও পেষণ করিয়া নিঃশেষ করিতে, অথবা একপাশে ঠেলিয়া সরাইয়া রাখিতে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্যাপকভাবে সে-চেষ্টা কখনও হয় নাই, এ-কথা মোটামুটি নিঃসংশয়ে বলা চলে; তবে, কখনও কখনও কোথাও কোথাও হয় নাই, অবশ্য এমন বলা যায় না। বাঙলাদেশ ভারতের পূর্বপ্রত্যন্ত দেশগুলির অন্যতম, এবং এদেশে আদিবাসী কৌমসমাজের প্রতাপ এবং প্রাবল্যও ছিল বেশি। কাজেই, এদেশে মধ্যভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনৈতিক বন্ধন কখনও আদিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং সমাজ ও অর্থনৈতিক বন্ধনকে একেবারে অস্বীকার করিতে পারে নাই, ব্যাপকভাবে সে-চেষ্টাও কেহ। করে নাই। যত নিম্নোই হোক, বিধি-বিধানের বাধা-নিষেধের যত সুদৃঢ় প্রাচীর গড়িয়াই হোক, হিন্দুসমাজ নিজের বৃহৎ সীমার মধ্যে তাহাকে স্থান দিয়াছে, তাহাকে ধারণ ও পোষণ করিয়াছে; তাহার ফলে একটা বৃহৎ সমন্বয়ও গড়িয়া তুলিয়াছে, যত ধীরে ধীরেই হোক যত অসম গতিতেই হোক।
তবু, স্বীকার করিতেই হয়,
যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে।
পশ্চাতে ফেলিছে যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে৷।
কবি তো এখানে ইতিহাসের যুক্তির কথাই বলিতেছেন। সভ্যতা সংস্কৃতির বিভিন্ন স্তরের বৃহৎ মানবগোষ্ঠীকে লইয়া যে বাঙালী-সমাজ, সে-সমাজের নিন্ন ও পশ্চাতের স্তরগুলি যে প্ৰতি, মুহূর্তেই উচ্চতর স্তরকে নিম্নে ও পশ্চাতে টানিতেছে- প্রাচীন কালে এবং মধ্যযুগে টানিয়াছে, আজও টানিতেছে। এই প্লথ, উপলব্যথিত গতি ইতিহাসের রথকে সম ও দ্রুততালে অগ্রসর হইতে দেয় নাই, সমাজদেহকে পঙ্গু ও রুগ্ন করিয়া রাখিয়াছে।
প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের এই অসম গতি পুষ্ট ও লালিত হইয়াছে প্রাচীন বাঙালীর বর্ণ ও শ্ৰেণী-বিন্যাসের সহায়তায়। আমাদের প্রাচীন বর্ণ-বিন্যাস বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইরে, উহার বিভিন্ন স্তর নিণীত হইয়াছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী, বৃত্তির স্তর চেতনা, অর্থাৎ উচ্চনীচ ভাবানুযায়ী। এই স্তরগুলি প্রত্যেকটি নানা বিধি-বিধান, বাধা-নিষেধের বেড়ায় ঘেরা; সে-বেড়া ডিঙাইয়া উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ণ হওয়া খুব সহজ নয়। কারণ; তাহার সঙ্গে আবার শ্রেণী-চেতনাও জড়িত। শিক্ষাদীক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারের তারতম্যও আবার নির্ভর করিত এই বর্ণ, বৃত্তি ও শ্রেণী বিন্যাসের উপর। কাজেই একবার যাহার স্থান সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোনও একটা বিশেষ স্তরে নিণীত হইয়া গিয়াছে, সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সে তাহার স্থান ছাড়িয়া আর অগ্রসর হইতে পারে নাই; ইতিহাসও সেখানে স্তব্ধ ও নিরস্ত হইয়া গিয়াছে।
শ্রেণীবিন্যাস অধ্যায়ে বলিয়াছি, প্রাচীন বাঙলায় তথা ভারতবর্যের সর্বত্রই শ্রেণীচেতনার চেয়ে বর্ণচেতনা কৌমচেতনা ছিল প্রবল। আর, শ্রেণীর সঙ্গে তো বর্ণ ও বৃত্তি অঙ্গাঙ্গী জড়িতই ছিল। বর্ণ ও বৃত্তি যেখানে অনেকাংশে জন্মগত সে-ক্ষেত্রে শ্রেণীও কতকাংশে আচল, অনড় হইবে, ইহা খুবই স্বাভাবিক। শ্রেণীতে শ্রেণীতে যে সক্রিয় বিরোধ এই অনড়, আচল অবস্থাকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া বর্ণ ও বৃত্তিগত বাধা-নিষেধের প্রাচীর কিছুটা ধ্বসাইতে পারিত, সেই সক্রিয় বিরোধের কোনও প্রমাণ, এমন কি সে-সম্বন্ধে সজ্ঞান চেতনার সাক্ষ্যও প্রাচীন বাঙলায় কিছু উপস্থিত নাই। যখন যে-শ্রেণী সামাজিক ধন যো-পরিমাণে বেশি উৎপাদনা করিরয়াছে, সমাজে ও রাষ্ট্রে সেই পরিমাণে তাহারা প্রভাব অর্জন ও ব্রিস্তার করিয়াছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সেই পরিমাণে তাহারা অগ্রসর হইতে পারে নাই, সে-ক্ষেত্রে তাহারা স্বীকৃতিও লাভ করে নাই। আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাব সত্ত্বেও শিক্ষা ও সংস্কৃতি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, ধর্ম ও ভাবনা-কল্পনার ক্ষেত্রে তাহারা নিম্নে ও পশ্চাতেই থাকিয়া গিয়াছে। কারণ, সেই স্থান তাহাদের বর্ণ ও বৃত্তিদ্বারা নির্দিষ্ট।
বর্ণ, বৃত্তি ও শ্রেণীগত যে-সব বাধা ইতিহাসের গতিকে শ্লথ বা নিরস্ত করিয়াছে সে-সব বাধার প্রাচীর কিছুটা ভাঙ্গিয়া পড়িতে পারিক্ত যদি আমাদের সামাজিক ধনোৎপাদন পদ্ধতির উন্নত পরিবর্তন কিছু ঘটিত। আদিম কৌম জীবন ও সমাজের প্রাচীর ভাঙ্গিয়া পড়িয়ছিল উন্নতর কৃষি ও উন্নতর শিল্পের প্রবর্তনে। তারপর যে বৃহত্তর জীবন ও সমাজের পত্তন হইল তাহারও প্রাচীর ভাঙ্গিয়া পড়িতে পারিত যদি আমাদের প্রাচীন কৃষি ও শিল্পের উন্নততর বিবর্তন কিছু ঘটিত। কিন্তু তাহা ঘটে নাই। মাঝখানে কয়েকটি সুদীর্ঘ শতাব্দী বাঙলাদেশ ব্যাবসা-বাণিজ্য আশ্রয় করিয়া একটা বৃহত্তর জীবনের আস্বাদন লাভ করিয়াছিল, সন্দেহ নাই। কিছু বাধাবন্ধন তাহাতে কাটিয়াছিল, ইতিহাসের গতিও কিছুটা বেগ ও প্রেরণা লাভ করিয়াছিল; কিন্তু সে-ক্ষেত্রেও ব্যাবসা-বাণিজ্য যাঁহারা করিতেন। তাঁহারা সাধারণত বৃত্তি ও বর্ণ সীমাকে স্বীকার করিয়াই করিতেন। তাঁহাদের শ্রেণীচেতনা ছিল বর্ণ ও বৃত্তিচেতনার অধীন। কাজেই জীবন ও সমাজের মৌলিক পরিবর্তন তাঁহাতে কিছু হয় নাই এবং সমাজ-প্রবাহের এখানে ওখানে নিরুদ্ধ জলাশয়, বদ্ধস্রোত খালবিল প্রভৃতি থাকিয়াই গিয়াছে।
০৩. প্রাচীন বাঙালীর গ্রামকেন্দ্ৰিক জীবন ও গ্রামীণ সংস্কৃতি
বাঙলায় ইতিহাসের আদিপর্বে— এবং শুধু আদিপর্বেই নয়, সমস্ত মধ্যযুগ ব্যাপিয়া এবং বহুলাংশে এখনও– বাঙালী জীবন প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক, এবং বাঙালীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রামীণ! গ্রামকে কেন্দ্ৰ করিয়াই সাধারণ বাঙালীর দৈনন্দিন জীবন এবং তাহার সমস্ত ভাবনা-কল্পনা আবর্তিত হইত। কিছুদিন আগে পর্যন্তও ইহাই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় কথা। ইহার কারণ বুঝিতে পারা কঠিন নয়।