পূর্বোক্ত-কৌমচেতনা ও সদ্যোক্ত আঞ্চলিক চেতনা পরিপুষ্টি লাভ করিয়াছে প্রধানত দুইটি কারণে— একটি কারণ ধনোৎপাদনপদ্ধতিগত, আর একটি রাষ্ট্রবিন্যাসগত।
এই দুই চেতনার পুষ্টির কারণ : ভুমিনির্ভর কৃষিজীবন
প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের একেবারে আদিতে সামাজিক ধনের প্রধান উৎস ছিল শিকার, কৌম কৃষি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহশিল্প। দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ মোটামুটি খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয়-দ্বিতীয়-প্রথম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত উন্নতপ্রণালীর কৃষি এবং গৃহশিল্প অর্থোৎপাদনের বড় উপায় ছিল, সন্দেহ নাই, কিন্তু প্ৰধানতম উপায় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্তু শেষ পর্যায়ে, অর্থাৎ অষ্টম শতক হইতে আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত বাঙালী জীবন একান্তই ভূমি ও কৃষিনির্ভর। মোটামুটি ভাবে বলা চলে, স্বল্প কয়েকটি শতাব্দী ছাড়া বাঙলাদেশের ঐকান্তিক কৃষি ও ভূমি-নির্ভরতা কখনও ঘুচে নাই। ভূমি স্থির ও অবিচল, এবং সেই ভূমিকে আশ্রয় করিয়া যাহাদের জীবন ও জীবিকা তাহারা ভূমির অঞ্চলটিকে এবং সেই অঞ্চলের মানবগোষ্ঠীকে। আঁকড়াইয়া থাকিবেন, উহাদের কেন্দ্ৰ করিয়াই তাহাদের ভাবনা-কল্পনা আবর্তিত হইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। অপরপক্ষে শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যনির্ভর জীবনে ভূমির প্রতি আকর্ষণ অপেক্ষাকৃত শিথিল। ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে বণিক, সাির্থবাহু, সদাগরদের দেশে বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত; তখনকার দিনে এক একবার ঘর ছাড়িয়া বাহির হইলে বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া যাইত দূরদেশে, দেশান্তরে; গৃহের,-পরিবারের, কোম ও গোষ্ঠীর বন্ধন স্বতই হইয়া পড়িত শিথিল, গ্রামের ও অঞ্চলের বন্ধন হইত শিথিলন্তর। কিন্তু গ্ৰাম কৃষিনির্ভর জীবনে হইত। তাহার বিপরীত। কাজেই সেই জীবনে পরিবারের, কোমের ও অঞ্চলের চেতনার প্রাচীর ভাঙিয়া পড়িবার কোনও সুযোগ সম্ভাবনাই ছিল না; বরং তোহা আরও লালিত ও পুষ্ট হইবার সুযোগই ছিল বেশি।
রাষ্ট্রবিন্যাসের ক্ষেত্রে কৌমতন্ত্র ধীরে ধীরে রাজতন্ত্রে বিবর্তিত হইয়াছিল, এ কথা রাষ্ট্রবিন্যাস অধ্যায়ে বলিয়াছি। কিন্তু এই বিবর্তন বাঙলাদেশের সর্বত্র একই সময়ে একই সঙ্গে হয় নাই। পরাক্রমশালী রাজবংশের প্রভুত্ব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এক একটি কোম ও জন ধীরে ধীরে রাজতন্ত্রের সীমার মধ্যে আসিয়া স্থান অধিকার করিয়াছে। কিন্তু রাজতন্ত্র গড়িয়া ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজতন্ত্রের প্রায় অচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে সামন্ততন্ত্রও গড়িয়া উঠিয়াছিল। একটু বিশ্লেষণেই ধরা পড়িবে, এই সামন্তরা প্রায় সকলেই এক একজন পৃথক পৃথক এক একটি অঞ্চলের কৌম বা জননায়ক, এবং সেই সেই বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের লোকদের প্রাথমিক আনুগত্য আঞ্চলিক ও কৌমসামন্ত-নায়কটির প্রতি; দেশের বা প্রান্তের রাজা বা সম্রাট তাহাদের কাছে দূরাগত ধ্বনি মাত্র। বাঙলার ইতিহাসের আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিন্যাসের এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তুহার ফলে কৌমচেতনা ও আঞ্চলিক চেতনা লালন ও পুষ্টিলাভ করিবে ইহা কিছু বিচিত্র নয়।
০২. ইতিহাসের অসম গতি : Historical Laq– তাহার কারণ
বলিয়াছি, ইতিহাসের প্রথম পর্বে আদিবাসী জীবন একান্ত কোমবদ্ধ। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই সব কোম। ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র বৃহৎ জনে বিবর্তিত হইতে থাকে। সকল কোমই একই সঙ্গে একই সময়ে সভ্যতার অধিকার লাভ করে নাই; শতাব্দীর পর শতাব্দীতে অক্তি ধীরে ধীরে এক একটি কোম সভ্যতার অধিকার পাইয়াছে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক একটি স্তর অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইয়াছে। তাহার ফলে বাঙলা দেশের সর্বত্র এবং সমগ্র বাঙালী জীবন ব্যাপিয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির একই স্তর বা ক্রম বিস্তৃত নয়; এমন কি একই সত্যতা এবং সংস্কৃতিও নয়; আজও নয়, প্রাচীনকালেও ছিল না। সুবিস্তৃত বাঙালী সমাজের একটি অংশ যখন উন্নত প্রণালীর কৃষিকার্যে নিরত, আর একটি অংশ হয়তো তখনো কাঠের ফলার লাঙলে বা হাত-খুরপির সাহায্যে পাহাড়ের ঢাল গাত্র ধাপে ধাপে কাটিয়া সেখানে ধানের চাষ করিতেছে। একটি অংশ যখন বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিরত, উচ্চশ্রেণীর ধাতব মুদ্রায় কেনালেঢ়ায় অভ্যস্ত, তখন হয়তো আর একটি অংশে মুদ্র প্রচলিতই নয়, দ্রব্যা-বিনিময়ে কেনাবেচা, চলিতেছে, অথবা খুব বড় জোর কড়ির সাহাযে{। একটি অংশে যখন ঔপনিষদিক ব্রহ্মকদের প্রচলন, উচ্চশ্রেণীর মুনিন ও কল্পনার প্রসার, আর একটি অংশে তখনও ভূতপ্রেতিবাদ, যাদুশক্তিতে বিশ্বাস, গাছপূজা, পাথরপূজা প্রভৃতি নিরঙ্কুশভাবে চলিতেছে। অথবা, পাশাপাশি বাস করিবার দরুন, একই সমন্বিত সমাজে বাস করিবার দরুন, একই সঙ্গে উন্নত ও আদিম কৃষি, ধাতব মুদ্রা ও বিনিময়ে কেনাবেচা, স্বর্ণমুদ্রা ও কড়ি, ব্ৰহ্মবাদ ও মাজিক এমন অব্যাহত ও সহজভাবে চলিতেছে যেন ইহাদের মধ্যে বিরোধ কোথাও কিছু নাই! আজিও যেমন প্রাচীন বাঙলায়ও তেমনই ছিল, বরং আরও বেশিই ছিল। ইহার কারণ খুব সহজবোধ্য। তবু, তাহা একটু ব্যাখ্যা করিয়া বলা যাইতে পারে, কারণ আমাদের সমাজে এই চেতনা আজও খুব সজাগ নয়।
আজিকার ভারতবর্ষে যে হিন্দুসমাজ ও ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি দৃষ্টিগোচর তাহার ইতিহাস অনুসরণ করিলে দেখা যায়, এই সমাজ ও ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিভিন্ন স্তরে প্রাক-আর্য ও অনার্য, কিছু কিছু বৈদেশিক নরগোষ্ঠীর সমাজ ও ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গ্রাস বা আত্মসাৎ করিয়া করিয়া অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে; আজও তাহার বিরাম নাই। যে প্রাক-আর্য বা অনার্য কোম যে সভ্যতা বা সংস্কৃতি-স্তরের সেই অনুযায়ী বৃহত্তর হিন্দুসমাজে তাহার স্থান নির্ণীত হইয়াছে, এবং নানা বিধি-বিধান দ্বারা সেই স্থানটিকে সুনির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। যাহারা সজ্ঞানে সচেতনভাবে পারিপার্শ্বিকের সুযোগ-সুবিধা লইয়া, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক ঘটনা ও আবর্তের সাহায্য লইয়া সেই সব বিধি-বিধানকে অগ্রাহা করিয়া বৃহত্তর সমাজে স্থান লইতে পারিয়াছে তাহারা ক্রমশ সভ্যতা ও সংস্কৃতিতেও অগ্রসর হইয়া গিয়াছে। কিন্তু সচরাচর তাহার সুযোগ-সুবিধা খুব বেশি ছিল না; বিধি-বিধানের প্রাচীর ছিল সুদৃঢ়। তাহার ফলে বৃহৎ হিন্দুসমাজ ও ধর্মের, সভ্যতা সংস্কৃতির ভিতর নানা স্তর, নানা আকৃতি-প্রকৃতি নানা রূপ, নানা বৈচিত্রা কিন্তু সব কিছুই একটা বৃহত্তর সীমার মধ্যে একীকৃত ও বহুলাংশে সমন্বিত।