এই গ্রন্থের যুক্তিপৰ্যায় অনুসরণ কবিয়াই একে একে তাহ করা যাইতে পারে। কিন্তু আলোচ্য প্রসঙ্গে আমি আর কোনও সাক্ষাপ্রমাণ উপস্থিত করিব না, করিবার প্রয়োজনও নাই, কারণ সে-সব সাক্ষ্যপ্রমাণ এই গ্রন্থের পূর্বোক্ত তেরোটি অধ্যায়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। আমার মন্তব্যগুলি প্রায় সমস্তই প্রত্যক্ষভাবে সে-সব সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, তবে কিছু কিছু এমন মন্তব্যও আছে যাহা শুধু সাক্ষ্য প্রমাণের পরোক্ষ ইঙ্গিত অথবা যাহা অনুমানসিদ্ধ মাত্র। ইতিহাসে এই ধরনের ইঙ্গিত বা অনুমানের স্থান নাই, এমন বলা চলে না।
কৌম চেতনা
আজ আমরা যাহাদের বাঙালী বলিয়া জানি তাহারা সকলেই একই নরগোষ্ঠীর লোক নহেন, এ-তথ্য সর্বজনবিদিত; বিচিত্র নরগোষ্ঠীর লোক লইয়া বৃহত্তর বাঙালী জনের গঠন। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে, বাঙলাদেশে বহুদিন পর্যন্ত ইহাদের অধিকাংশই ছিল কোমবদ্ধ গোষ্ঠীবদ্ধ জন এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া ইহারা একান্ত কৌমজীবনেই অভ্যস্ত হইয়া আসিয়াছিল। এক একটি কোম এক একটি বিশিষ্ট স্থান লইয়া মোটামুটি ভাবে স্ব-স্বতন্ত্রপরায়ণ স্ব-সম্পূৰ্ণ জীবন যাপন করিত, অন্য কোমের সঙ্গে যোগাযোগ বড় একটা থাকিত না, বিধিনিষেধের বাধাও ছিল নানা প্রকারের। তাহার ফলে এই সব বিচিত্র কোমের মধ্যে বৃহত্তর জনচেতনা বলিয়া কিছু গড়িয়া উঠিবার সুযোগ বিশেষ ছিল না, সমাজগঠনে তাহার প্রভাব তো দূরের কথা। পরবর্তী কালে সভ্যতা বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, নানাপ্রকারের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক ঘটনা-প্রবাহের ফলে এই সব বিচিত্র কোমের মধ্যে নানাপ্রকারের আদান-প্রদান চলিতে থাকে, এবং তাহারই ফলে বৃহত্তর অঞ্চলকে আশ্রয় করিয়া ধীরে ধীরে নানা ক্ষুদ্র বৃহৎ কোমের একত্র সমবায়ে বৃহত্তর কোমের (বঙ্গাঃ, রাঢ়াঃ, পুণ্ডাঃ, সুহ্মাঃ ইত্যাদির) উদ্ভব ঘটে। কিন্তু বৃহত্তর কোম বা এই সব জন গড়িয়া ওঠার পরও কৌমসও ও কৌমস্মৃতি কখনও বিলুপ্ত হয় নাই। প্রাচীন বাঙলার ইতিহাসে এই কৌমচেতনা পূর্বাপর সর্বত্র সক্রিয়; সমাজের বর্ণ, বৃত্তি ও শ্ৰেণী-বিন্যাসে, অর্থ উৎপাদন ও বণ্টনে, গ্রাম ও নগরের বিভিন্ন পল্লীর বিন্যাসে, রাষ্ট্রগত ক্রিয়াকর্মে এমন কি যুদ্ধবিগ্রহে, ধর্মকর্মে, এক কথায় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই কৌমচেতনার প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল। ক্ষুদ্র বৃহৎ কোম এবং গোষ্ঠীকে কেন্দ্ৰ করিয়াই আমাদের সমস্ত ভাবনা-কল্পনা, সমস্ত ক্রিয়াকর্ম আবর্তিত হইত। অন্তত, প্রাচীন বাঙলার শেষ পর্যন্ত এই কৌমচেতনা সমভাবে বিদ্যমান, এমন কি মধ্যযুগেও। এখনও তোহা নাই এমন বলা চলে না। বস্তুত, বাঙলাদেশের ইতিহাসের গভীরে তাকাইয়া যদি বলা যায়, এই কৌমস্মৃতি ও কৌমচেতনা আজও বহমান তাহা হইলেও খুব অন্যায় বলা হয় না।
আঞ্চলিক চেতনা
কৌমস্মৃতি ও কৌমচেতনার সঙ্গে প্রায় অঙ্গাঙ্গী জড়িত আঞ্চলিক স্মৃতি ও আঞ্চলিক চেতনা। রাঢ়াঃ, সুহ্মাঃ, গৌড়াঃ, পুণ্ডাঃ প্রভৃতি যে-সব জনদের কথা সাহিত্যে ও লিপিমালায় পড়িতেছি, সে-সব জনেরাও তো এক একটি অঞ্চলকে আশ্রয় করিয়া ক্রমশ রাঢ়, সুহ্ম, বঙ্গ, গৌড়, পুণ্ড্র প্রভৃতি জনপদ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের অগ্রগতির সঙ্গে এই সব পৃথক পৃথক ক্ষুদ্র বৃহৎ জনপদকে একটি বৃহত্তর প্রান্ত বা দেশখণ্ডে একত্র ও সমন্বিত করিয়া তাহাকে একটা সমগ্র রূপ দিবার সজাগ চেষ্টা অন্তত শশাঙ্কর সময় হইতেই দেখা দিয়াছিল এবং পাল-পর্বে পাল-সম্রাটেরা ও পরবর্তী কালে সেনা-রাজারাও এ-সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সাধারণভাবে প্রান্ত বা দেশের সামগ্রিক ঐক্যচেতনা জনসাধারণের মধ্যে গড়িয়া উঠিতে পারে। নাই, অন্তত প্রাচীন বাঙলায় তেমন প্রমাণ, বিশেষ নাই! পাল ও সেনা-বংশের রাজারা যখন গৌড়েশ্বর বলিয়া আত্মপরিচয় দিতেছেন তখনও সাহিত্যে ও লিপিমালায়, তথা জনসাধারণের চিত্তে যে সব স্মৃতি ও চেতনা সক্রিয় তাহা বিশিষ্ট জনশ্রিত বিশেষ বিশেষ জনপদের— রাঢ়ের, পুণ্ডের, সুহ্মের, বরেন্দ্রের, বঙ্গের, হরিকেলের, সমতটের। বস্তুত, প্রাচীন বাঙালী নিজেদের আঞ্চলিক জনপদ সত্তাকে বৃহত্তর দেশ বা প্রান্তসত্তায় মিশাইয়া দিতে বা দুয়ের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া বাহির করিতে শেখে নাই। আজও যে তাহা খুব সহজ হইয়াছে, এমন বলা চলে না। বস্তুত স্থানীয় আঞ্চলিক সত্তা ও বৃহত্তর দেশসত্তার বিরোধ শুধু যে বাঙলার ইতিহাসেই সক্রিয় এমন নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের বৃহওর ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তাহাই, এবং কোনও কোনও, ঐতিহাসিক ইতিপূর্বেই তাহার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। একদিকে আমাদের চিন্তানায়ক, ধর্মগুরু এবং রাষ্ট্রবিধাতাদের কেহ কেহ সর্বভারতীয় চেতনাবোধটিকে সদাজাগ্রত রাখিতে চেষ্টা করিয়াছেন, নানা উপায়ে; অন্যদিক ইহাদেরই অনেকে আবার আমাদের আঞ্চলিক সংকীর্ণ বুদ্ধিটিতে নানাভাবে পরিতুষ্ট ও পরিপোষণ করিয়াছেন। আমাদের ধর্ম ও অধ্যাত্ম-জীবনে একদিকে যেমন ঐক্য ও সাম্যের জয়গান তেমনই অন্যদিকে আবার নানা ভেদ বৈষম্যের এবং অনৈক্যের সৃষ্টি। যাহাই হউক, প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসে আঞ্চলিক চেতনা অত্যন্ত প্রত্যক্ষ, এবং এই চেতনার ফলেই সেই ইতিহাসে দেশের বা প্রান্তের সামগ্রিক বোধ কোনও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। এই আঞ্চলিক চেতনাই শশাঙ্ক বা পাল ও সেনারাজাদের চেষ্টাকে পরিণামে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিল।