অথচ, দেশে রাজা বা রাজপাদোপজীবী কয়জন? রাষ্ট্রশাসনযন্ত্র যাঁহারা পরিচালনা করেন তাঁহারাই বা কয়জন? যুদ্ধবিগ্রহ নিত্য হইত না, সমগ্র ইতিহাসে তাহার স্থান কতটুকু? আজিকার দিনের সামগ্রিক যুদ্ধের মতো তখনকার দিনের যুদ্ধবিগ্রহ সমাজের মূল ধরিয়া টান দিত না। যুদ্ধ সাধারণত যুদ্ধের স্থান, রাজা, সেনাধ্যক্ষ, সৈন্যবাহিনী, রাজসভা, রাজকর্মচারী— ইঁহাদের মধ্যেই আবদ্ধ ও সীমাবদ্ধ থাকিত। যুদ্ধের ফলাফল নিকট ও দূর ভবিষ্যৎকে একান্তভাবে রূপান্তরিতও করিতে পারিত না। রাজা ও রাজসভার বাহিরে ছিল অগণিত জনসাধারণ, বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত, বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসদ্বারা শাসিত, বিভিন্ন শ্রেণীর সীমায় সীমিত, ঠিক এখনও বাঙলাদেশে যেমনটি আমরা দেখি। তবু বর্তমান কালে, রাষ্ট্র যতটা সর্বগ্রাসী, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, প্রাচীনকালে এমনটি এতটা হইবার সুযোগ ছিল না। এক রাজা পরাজিত হইয়াছে, অন্য রাজা রাজমুকুট পরিয়া রাজসিংহাসনে বসিয়াছেন; তাহাতে অগণিত জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনের বৈপ্লবিক রূপান্তর কিছু ঘটে নাই, বৃহত্তর সমাজব্যবস্থারও খুব দ্রুত উলেট-পালট কিছু হইয়া যায় নাই; যাহা হইয়াছে তাহা ধীরে ধীরে এবং সমাজের উচ্চতর স্তরে।
আসল কথা, প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্র সমগ্র সমাজব্যবস্থার রক্ষক ও নিয়ামক মাত্র। রাজা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল এই সমাজব্যবস্থাকে রক্ষণ ও পালন করা, আর সমাজের দায়িত্ব রাজা ও রাষ্ট্রকে প্রতিপালন করা। সমাজ আছে বলিয়াই রাষ্ট্র এবং রাজাও আছেন; সমাজহীন রাষ্ট্র কল্পনাও করা যায় না। রাজা ও রাষ্ট্রের পক্ষে ধন যেমন অপরিহার্য, সমষ্টির পক্ষেও তাহাই। ধনব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা, শ্রেণীব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা—সমস্তই সামাজিক ধনকে কেন্দ্র করিয়া; ধন না হইলে রাজা ও রাষ্ট্র প্রতিপালিত হয় না। এই ধন উৎপাদনের তিন উপায় প্রাচীন বাঙলায় দেখিতে পাওয়া যায়—কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য। এই তিন উপায় তিন শ্রেণীর করায়ত্ত : ভূমিবানশ্রেণী, শিল্পীশ্রেণী, বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী। এই তিন উপায়ে উৎপাদিত অর্থদ্বারা সমাজ-ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিপালিত হইত এবং সদ্যকথিত তিন শ্রেণী ও রাষ্ট্র মিলিয়া উৎপাদিত ধন বণ্টনের ব্যবস্থা করিতেন। কাজেই, রাজা ও রাষ্ট্র ছাড়া সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে এই শ্রেণীর অর্থাৎ ধনোৎপাদক শ্রেণীর একটা বিশেষ স্থান ছিল, এবং রাজা ও রাজকর্মচারীদের অপেক্ষা ইহারা যে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন তাহ সহজেই অনুমেয়। অথচ, ইঁহাদের সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু জানিবার সুযোগ নাই। ধনোৎপাদন, ধনবন্টন, ভূমিব্যবস্থায় ভূমিবানদের সঙ্গে ভূমিহীন কৃষককুল ও কৃষিশ্রমিকদের সম্বন্ধ, শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের সম্বন্ধ, শ্রেণী-ব্যবস্থা ও বর্ণ-ব্যবস্থায় বর্ণের সঙ্গে শ্রেণী, বর্ণের সঙ্গে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে আমাদের কিছু জানিবার সুযোগ আজও অতি অল্পই আছে।
এই মাত্র যে ধনোৎপাদক শ্রেণী ও কৃষিশ্রমিকদের কথা বলিলাম, ইঁহাদের জীবনাচরণ যে শুধুই ধনসর্বস্ব, ধনকেন্দ্রিক ছিল, এ কথা বলা চলে না। ইঁহাদের রক্ষা ও পালন যাহারা করিতেন সেই রাজা ও রাজপাদোপজীবীদের জীবনে ধর্ম ও শিল্পের, শিক্ষা ও সাহিত্যের, এক কথায় সংস্কৃতিরও প্রয়োজন ছিল। সেই সংস্কৃতি স্বভাবতই এমন হওয়া প্রয়োজন ছিল যাহা তদানীন্তন সমাজ-সংস্থানের পরিপন্থী নয়। এই সংস্কৃতির পুষ্টি ও পালন ধনসাপেক্ষ : সেই ধন সমাজের উদকৃত্ত ধন। দৈনন্দিন একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করিয়া যে-ধন থাকিত সেই ধনের কিয়দংশ যাহারা দিতেন ও দিতে সমর্থ ছিলেন তাহারাই পরোক্ষভাবে উচ্চতর সমাজস্তরের সংস্কৃতির আদর্শ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করবেন, ইহাই তো স্বাভাবিক। অপরোক্ষভাবে ইহাকে রূপদান করিতেন সমাজের বুদ্ধিজীবীরা—ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শাস্ত্রবিদেরা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলকরা, এবং ইঁহাদের প্রায় সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ অথবা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য-ধর্মাশ্রয়ী। শিক্ষা ও ধর্মাচরণের, সামাজিক স্মৃতি ও ব্যবহারাদি, নিয়ম-আচার প্রভৃতি প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল তাহদের। এ দায়িত্ব তাহারা পালন করিতেন বলিয়া সমাজের মধ্যে সমর্থ শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ জৈন, বৌদ্ধ, যতি ও ব্রাহ্মণদের প্রতিপালন ও ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করিত। সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ইঁহাদের বর্ণ ও শ্রেণীগত স্থান ও ব্যবহার, রাষ্ট্রের সঙ্গে ইঁহাদের সম্বন্ধ, ধনোৎপাদক ও বণ্টক শ্রেণীদের সঙ্গে সম্বন্ধ ইত্যাদি ব্যাপার, এবং ইঁহাদের সৃষ্ট সংস্কৃতির আদর্শ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করিয়া লইবার সুযোগ আজও কম। ইহারা ছাড়া, সমাজের নিম্নতর স্তরগুলিতে নিরক্ষর জনসাধারণেরও একটা মানস-জীবন ছিল, সংস্কৃতি ছিল। এ সম্বন্ধেও আমাদের জ্ঞান স্বল্পই। অথচ, ইহারাও সমাজের বিশেষ একটি অঙ্গ, এবং এই সংস্কৃতির যথার্থ স্বরূপ ও ইতিহাস বাঙলার ও বাঙালীর ইতিহাসেরই কথা।
রাজা, রাজপাদোপজীবী, শিল্পী, বণিক, কৃষক, কৃষিজীবী, ভূমিবান সম্প্রদায় প্রভৃতি শ্রেণীর অসংখ্য লোকের বিচিত্র প্রয়োজনের সেবার জন্য ছিল আবার অগণিত জনসাধারণ। ইঁহাদের অশন-বসন, বিলাস-আরাম, সুখ-সুবিধা, দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র কর্তব্য প্রভৃতি সম্পাদনার জন্য প্রয়োজন হইত নানা শ্রেণীর, নানা বৃত্তির সমাজসেবক ও সমাজশ্রমিক শ্রেণীর অসংখ্যতর ইতর জনের—প্রাচীন লিপিমালায় যাঁহাদের বলা হইয়াছে অকীর্তিত বা অনুল্লিখিত জনসাধারণ। ইঁহাদের ছাড়াও সমাজ চলিত না, এই অকীর্তিত জনসাধারণও সমাজের অঙ্গবিশেষ, এবং সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে ইঁহাদেরও স্থান ছিল। অথচ, ইঁহাদের কথাও আমরা কমই জানি। ইঁহাদেরও ধর্মবিশ্বাস ছিল, দেবদেবী ছিল, পূজানুষ্ঠান ছিল, সংস্কৃতির একটা ধারা ছিল। উৎপাদিত ধনের খানিকটা— খুব স্বল্পতম অংশ সন্দেহ নাই— ইঁহাদের হাতে আসিত কোনও না কোন সূত্র ধরিয়া। এসব সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টি আজও যথেষ্ট সচেতন নয়।