ফন আইকস্টেডটের মতে ভারতবর্ষে মোটামুটি তিনটি নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ উপস্থিত। প্রত্যেক গোষ্ঠীতেই কয়েকটি শাখাগোষ্ঠী সংলগ্ন।
১. ভেড্ডিড্ বা ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠী—উত্তর-দক্ষিণাত্যের পাতলা রং ও বলিষ্ঠ গড়নের উত্তর-গোণ্ডীয় গোষ্ট্ৰীয় লোকেরা এবং দক্ষিণ ভারতের ঘোরকৃষ্ণ ‘মেলিড্’ ও সিংহলের ভেড্ডারা এই ভেড্ডিড্ বা ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠীর শাখা। লক্ষণীয় যে, কোল-মুণ্ডা নরগোষ্ঠীকে ফন আইকস্টেডট। বৃহত্তর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করিতেছেন না।
২. ‘মেলানিড্’ বা ‘ভারতীয় মেলানিড্’–এই নরগোষ্ঠীর প্রধান বাসস্থান দক্ষিণ ভারতের সমতল প্রদেশ, এবং বর্তমান তামিলভাষী লোকেরা ইহাদের বংশধর। উত্তরে হোদের মধ্যে এই ‘মেলানিড্’ রক্তস্পর্শ সুস্পষ্ট এবং আরও উত্তর গাঙ্গেয় উপত্যকায় ইহাদের কোনও কোনও ক্ষুদ্রতর শাখার দর্শন দুর্লভ নয়, বিশেষত, তথাকথিত নিম্নজাতদের ভিতর। কোলীয়রাও ইহাদেরি একটি সুবৃহৎ শাখা। এই হিসাবে ফন আইকস্টেডট কোল-মুণ্ডা নরগোষ্ঠীকে বর্তমান দ্রাবিড়ভাষী মেলানিড্ নরগোষ্ঠীর আত্মীয় বলিয়া মনে করিতেছেন; কোল-মুণ্ডা খাসিয়ারা যে আন পৃথক নরগোষ্ঠীর লোক তাহা বলিতেছেন না। তাহা ছাড়া, অন্যান্য নৃতাত্ত্বিকেরা বর্তমান দ্রাবিড়ভাষী লোকদের যে সব দেহলক্ষণসমূহের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহাদের সঙ্গে ভারতবহির্ভূত মিশর-এশীয় বা ভূমধ্য নরগোষ্ঠীর আত্মীয়তার সন্ধান পাইতেছেন, মোটামুটি সেই দীর্ঘমুণ্ড উন্নতনাস নরগোষ্ঠীর লোকদেরই তিনি বলিতেছেন ভারতীয় ‘মেলানিড্’।
৩. ‘ইন্ডিড্’’ বা ভারতীয় নরগোষ্ঠী—ইহাদের প্রধানত তিন শাখা : ক. যথার্থ ‘ইন্ডিড্’; ইহারাই মোটামুটি যাহাদের আগে বলা হইয়াছে আদি-নর্ডিক; খ উত্তর ‘ইন্ডিড্’; অর্থাৎ মোটামুটিভাবে ফিশাল যাহাদের বলিয়াছেন প্রাচ্য বা ‘ওরিয়েন্টাল’; এবং গ. ‘ব্র্যাকিড’; ইহারা আর-একটি গালমুণ্ড নরগোষ্ঠী অর্থাৎ মোটামুটিভাবে আগে যাহাদের বলা হইয়াছে অ্যালপাইন বা আল্পো-দীনারীয়। এই ‘ব্র্যাকিড’দের আবার তিন উপধারা; অ. মহারাষ্ট্র দেশের ‘পশ্চিম ব্রাকিড্’; আ. বাঙলা ও উড়িষ্যার ‘পূর্ব ব্র্যাকিড’, এবং ই. গাঙ্গেয় উপত্যকার ‘দীর্ঘদেহ ব্র্যাকিড্’। যথার্থ ‘ইন্ডিড’দের বিস্তার বিনশন-প্রয়াগধৃত আর্যাবর্তে বা মধ্যদেশে, দক্ষিণ-ভারতের কেরল ভূমিতে এবং মিশ্রিতরূপে সিংহল দ্বীপেও।
ফন আইকস্টেডট আরও বলেন যে, দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পশ্চিমাংশের কোনও কোনও অধিবাসীদের ভিতর আদি মোঙ্গোলীয় রক্তপ্রভাব সুস্পষ্ট, এবং তাহা বোধ হয় অপেক্ষাকৃত আধুনিক কোলভাষী লোকদের রক্তধারা দ্বারা স্পষ্ট। এই আদি-মোঙ্গোলীয় প্রভাব ভারতবর্ষের সর্বত্র সমভাবে বিস্তৃত নয়, তবে এখানে-ওখানে আকীর্ণ চিহ্ন পৃথক পৃথক ভাবে নানা স্থানে ধরা পড়ে। ইহা হইতে তিনি অনুমান করেন যে, ভারতবর্ষে এই মোঙ্গোলীয় প্রভাব খুব সুপ্রাচীন নয়।
দক্ষিণ-ভারতের অধিবাসীরা, তাঁহার মতে, নৃতত্ত্বের দিক হইতে অধিকতর সমন্বিত এবং সমন্বয়ের মূল ভিত হইতেছে সুবিস্তৃত আদিমতম নেগ্রিড রক্তপ্রবাহ। এই সমন্বিত নরগোষ্ঠীই ফন আইকস্টেডট-কথিত ‘মেলানিড্’ নরগোষ্ঠী এবং তাহাদেরই বংশধর বর্তমান মধ্যস্তরের তামিল। উচ্চ ও নিম্নস্তরে এই সমন্বয়ের সমগ্র ও সুস্পষ্ট রূপটি ধরা পড়ে না, কারণ উভয় স্তরেই অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক বা প্রাচীনতর কালের অন্য নরগোষ্ঠীর রক্তস্পর্শ লাগিয়াছে; উচ্চস্তরে বোধহয় ‘ইন্ডিড’দের এবং নিম্নস্তরে ‘মালিড’দের। এই ‘মালিডা’রা পর্বতবাসী ভেড্ডিড নরগোষ্ঠীর সঙ্গে কমবেশি আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ। ইহাদের কাহারও মধ্যেই অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের নিগ্রোবটু রক্তস্পর্শের চিহ্নমাত্র নাই, যদিও আদিমতম নিগ্রোবটু রক্তম্পর্শের কমবেশি প্রভাব সকলের মধ্যেই আছে, তবে সে প্রভাবও বহুদিন আগেই শুকাইয়া উবিয়া গিয়াছে।
সংখ্যায় ও বিস্তৃতিতে ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষ বলিষ্ঠ নরগোষ্ঠী হইতেছে ‘ইণ্ডিড্’রা। ফন আইকস্টেডটের মতে ইহারাই প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারী এবং দ্রাবিড় ও বিশিষ্ট “ভারতীয়” আত্মিক সাধনার যথার্থ প্রতিনিধি। ‘ইণ্ডিড’ নরগোষ্ঠীর উত্তর-পশ্চিমাংশ বারবার মধ্য এশিয়ার নানা জন ও কোম দ্বারা আক্রান্ত ও পর্যুদস্ত হইয়াছে; আর্যভাষা কিন্তু তাহাতে কখনও শিথিলমূল হয় নাই, বরং তাহার প্রতাপ বরাবরই অম্লান ও অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু আর্যভাষীদের বাস্তব সভ্যতা ও মানস-সংস্কৃতি বারবার রূপান্তর ও সমন্বয় লাভ করিয়াছে। আর্যভাষাকে আশ্রয় করিয়া কিছু নর্ডিক রক্তপ্রবাহ, পরবর্তীকালে কিছু শক ও হুন রক্তপ্রবাহ এবং আরও পরবর্তীকালে মুসলমান অভিযান আশ্রয় করিয়া কিছু ওরিয়েন্টাল বা প্রাচ্য নরগোষ্ঠীর রক্তধারা ‘ইণ্ডিড্’ প্রবাহে সঞ্চারিত হইয়াছে। মূলে এই ‘ইণ্ডিড্’ নরগোষ্ঠী আদিমতম ভেড্ডীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অতি প্রাচীনকাল হইতেই উত্তর হইতে ‘ইণ্ডিড্’দের দক্ষিণমুখী চাপে ক্রমশ ‘মেলানিড্’ নরবংশের সৃষ্টি এবং ভেড্ডিডদের চাপে ক্রমশ ‘মালিড’দের।
‘ইণ্ডিড্’ ও ‘মেলানিড’ নরগোষ্ঠী ও তাঁহাদের ভাষা সম্বন্ধে ফন আইকস্টেডটের উক্তি উদ্ধারযোগ্য। আমার মনে হয়, দ্রাবিড়ভাষীদের নরতত্ত্ব সম্বন্ধে একান্ত সাম্প্রতিক কালেও নরতাত্ত্বিকদের মধ্যে যে জিজ্ঞাসা বর্তমান তাহার একটা সন্তোষজনক মীমাংসা এই উক্তির মধ্যে পাওয়া যায়