ইহা ছাড়াও আর একটি খর্বদেহ দীৰ্ঘমুন্ড জাতির অস্তিত্ব অনুমান করিয়াছেন নরতত্ত্ববিদ ফিশার সাহেব, এবং ইহাদের নামকরণ করিয়াছেন প্রাচ্য বা Oriental বলিয়া। ইহারা পাতলা গৌর, কিন্তু ইহাদের চুল ও চোখ কৃষ্ণবর্ণ এবং নাসিকা দীর্ঘ ও উন্নত। উত্তর আফগানিস্তানের বাদক্ষীরা, দীর্ হইতে খাইবার গিরিবর্ত্ম পর্যন্ত যে সব লোক বাস করে, চিত্রল হইতে হিমালয়ের সানুদেশ ধরিয়া নেপালের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত যে সব পার্বত্য জনের বাস, ইহারা সকলেই কমবেশি সেই প্রাচ্য জনের বংশধর। পঞ্জাবের হিন্দুসমাজের কোনও কোনও শ্রেণীতে এবং মুসলমানদের উচ্চশ্রেণীতে এই জনের শীর্ণ প্রবাহ কিছুটা ধরা পড়ে, কিন্তু বাঙলাদেশে ইহাদের রক্তধারা আসিয়া পৌঁছিতে পারে নাই, এমন-কি পর্বতশায়ী উত্তরাংশেও নয়। ফন্ আইকস্টেডট এই নরগোষ্ঠীর নামকরণ করিয়াছেন ‘উত্তর-ইন্ডিড’ বলিয়া; এবং ডেনিকার ও জিউফ্রিডা-রাগ্গেরী ইহাদেরই বোধ হয় বলিয়াছেন ‘ইন্দো-আফগানীয়’।
মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাররবর্ষের ঘনিষ্ঠতম পরিচয় পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে। এইসব মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ছড়াইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু ভারতবর্ষের জনপ্রবাহে ইহাদের স্পর্শ গভীরভাবে কোথাও লাগে নাই, একমাত্র আসাম, উত্তরের হিমালয়শায়ী নেপাল-ভোটান এবং পূর্ব প্রান্তে ব্ৰহ্মদেশশায়ী প্রত্যন্ত জনপদ ও অরণ্যবাসী লোকদের মধ্যে ছাড়া। চৈনিক তুর্কীস্থানের তুকী-ভাষাভাষী অথবা খিরগিজ, উজবেক প্রভৃতি লোকদের মতো যথার্থ মোঙ্গোলীয় জন বা কোম আজ পর্যন্ত ভারতীয় নরতত্ত্বের বহির্ভূত। তবে উত্তরে হিমালয়সানুদেশবাসী লিম্বু লেপচা, রংপা প্রভৃতি কোমের লোকদের মধ্যে তিব্বতী রক্তধারা সুস্পষ্ট। ইহাদের দেহাকৃতি মধ্যম হইতে দীর্ঘ, মুণ্ডাকৃতি গোল, গণ্ডাস্থি উন্নত এবং নাসিকাকৃতি দীর্ঘ ও চ্যাপটা। নেপালেও এই রক্তধারার প্রভাব ধরা পড়ে, তবে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ক্রমশ ক্ষীয়মাণ।
আসামের উত্তর-পূর্বপ্রান্তশায়ী পার্বত্য দেশগুলিতে আবার একটি পৃথক মোঙ্গোলীয় রক্তধারার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহাদের মুণ্ডাকৃতি ঠিক গোল নয়, গোলের ঠিক উল্টা অর্থাৎ দীর্ঘ, এবং অক্ষিপুট সম্মুখীন। ইহারা যে মোঙ্গোলীয় তাহার প্রমাণ ইহাদের চ্যাপটা নাক, উন্নত গণ্ডাস্থি, বঙ্কিম চক্ষু, উদ্দণ্ড কেশ, কেশবিহীন দেহ ও মুখমণ্ডল। দক্ষিণ-পশ্চিম চীন হইতে ইহারা ক্রমশ ব্ৰহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ ও পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী দেশ ও দ্বীপগুলিতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; পথে উত্তর-পূর্ব আসামে এবং উত্তর ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকায় মিরি, নাগা, বোদো বা মেচ প্রভৃতি লোকদের ক্তিতর, কোচ, পালিয়া, রাজবংশী প্রভৃতি লোকদের ভিতর ইহাদের একটি ধারাপ্রবাহ ধরা পড়িয়া গিয়াছে। আসামে এই ধারা সর্বত্রই, সমাজের সকল স্তরেই প্রবহমান, তবে উচ্চবর্ণগুলির ভিতর গোলমুন্ড অ্যালপাইন এবং কিছু পরিমাণে দীর্ঘমুণ্ড আদি-নর্ডিক ধারাও সুস্পষ্ট; এই শেষোক্ত দুই ধারাই আসামের হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাধুত ধারাটির একটি প্রবাহ ঐতিহাসিক কালে বাঙলাদেশে আসিয়া ঢুকিয়া পড়ে, এবং রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে এইভাবেই খানিকটা মোঙ্গোলীয় প্রভাব আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, কিন্তু তাহা সাধারণত সমাজের নিম্নস্তরে।
ব্ৰহ্মদেশে যে মোঙ্গোলীয় জনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তাহারা খর্বদেহ, তাঁহাদের মণ্ডাকৃতি গোল,—দীর্ঘ নয়, এবং চামড়ার রং আরও ঘোর। দীর্ঘমুণ্ড অহোমীয় মোঙ্গোলীয়দের সঙ্গে ইহাদের আত্মীয়তা থাকিলেও ইহারা একগোত্রীয় নয়; বরং ব্রহ্মদেশীয় গোলমুণ্ড মোঙ্গোলীয়দের সঙ্গে সমগোত্রীয়তা আছে ত্রিপুরা জেলার চাকমাদের, টিপরাইদের এবং আরাকানের এবং চট্টগ্রামাঞ্চলের মগদের। বাঙলাদেশের অন্যত্র কোথাও এই ব্ৰহ্ম-মোঙ্গোলীয় প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না এবং বাঙলার জনগণের রক্তপ্রবাহে ইহারা বিশেষ কোনও চিহ্ন রাখিয়া বায় নাই।
ভারতবর্ষের নরগোষ্ঠীপ্রবাহ সম্বন্ধে উপরে যাহা বলা হইল, পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকেরা
ইতিহাসের গোড়ার কথা। ৩৫
মোটামুটি তাহা স্বীকার করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে লাইপত্সিগ স্যাক্সন ইনস্টিটিউটের ভারতীয় নৃতত্ত্বাভিযানের নেতা ব্যারন ফন আইকস্টেডট সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়িয়া যে সুবিস্তৃত শারীর পরিমিতি গণনা করিয়াছেন, তাহার ফলে ভারতীয় নরগোষ্ঠীপ্রবাহে কিছু নতুন আলোকপাত হইয়াছে। ফন আইকস্টেডটের বিশ্লেষণ ও মতামত আমাদের দেশে বহুলপ্রচারিত নয়; অথচ নানা কারণে তাঁহার মতামত আলোচিত হইবার দাবি রাখে। প্রথমত, ভারতীয় নরতত্ত্ব জিজ্ঞাসায় তিনিই বোধহয় সর্বপ্রথম সমস্ত ভারতবর্ষ তাহার গণনা ও বিশ্লেষণের বিষয়ীভূত নিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, তিনিই সকলের চেয়ে বেশি সংখ্যায় পরিমিতি লইয়াছেন। তৃতীয়ত, সমস্ত পরিমিতি একই মানদণ্ডানুযায়ী গৃহীত হইয়াছে; এবং চতুর্থত, যে বিচার পদ্ধতি অনুযায়ী পরিমিতি বিশ্লেষিত হইয়াছে তাহা একান্ত আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। পূর্বতন সকল মতামত বিচার করিয়া এবং সুবিস্তৃত ও সুগভীর গবেষণার ফলে তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন, তাহার সংক্ষিপ্ত একটু পরিচয় লওয়া এ প্রসঙ্গে অবাস্তর নয়। তিনি বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর যে নামকরণ করিয়াছেন, তাহা অনন্যপূর্ব না হইলেও একটু অসাধারণ। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিবেচনা করিলে দেখা যাইবে, নামকরণ যাহাই হোক, বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর যে যে বিশিষ্ট দেহলক্ষণের উপর এই নামকরণের নির্ভর সেই দেহলক্ষণ সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতের বিভিন্নতা খুব বেশি নাই। শ্রেণীনির্ধারণ সম্বন্ধে মতের বিভিন্নতা অবশ্যই লক্ষণীয়।