বহুদিন আগে বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন, “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না…।” তিনি শুধু রাজা ও রাষ্ট্রের ইতিহাস-রচনা কামনা করেন নাই; চাহিয়াছিলেন বাঙলার সেই ইতিহাস যে-ইতিহাস বলিবে :
… রাজ্যশাসন প্রণালী কিরূপ ছিল, শান্তিরক্ষা কিরূপে হইত। রাজসৈন্য কত ছিল, কি প্রকার ছিল, তাহদের বল কি, বেতন কি, সংখ্যা কি?…কতপ্রকার রাজকর্মচারী ছিল…? কে বিচার করিত…রাজা কি লইতেন, মধ্যবর্তীরা কি লইতেন, প্রজারা কি পাইত, তাহাদের সুখদুঃখ কিরূপ ছিল? চৌর্য, পূর্ত, স্বাস্থ্য এসকল কিরূপ ছিল?…কোন ধর্ম কতদূর প্রচলিত ছিল? …তখনকার লোকের সামাজিক অরস্থা কিরূপ? সমাজভয় কিরূপ? ধর্মভয় কিরূপ-বাণিজ্য কিরূপ, কি কি শিল্পকার্যে পারিপাট্য ছিল? কোন কোন দেশোৎপন্ন শিল্প কোন কোন দেশে পাঠাইত? … ভিন্ন দেশ হইতে কি কি সামগ্ৰী আমদানি হইত, পণ্যকার্য কি প্রকারে নির্বাহ হইত?
আজ বহুদিন পর বঙ্কিমচন্দ্রের এই কামনা কিছু সার্থক হইয়াছে, বলা যায়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুকূল্যে শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদারের সুযোগ্য সম্পাদনায় এবং প্রভূত শ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে ইংরাজি ভাষায় রচিত বাঙলার ইতিহাসের সুবৃহৎ প্রথম খণ্ড, অর্থাৎ প্রাচীন বাঙলার পরিপূর্ণ সুপরীক্ষিত, সআলোচিত তথ্যবহুল একটি সামগ্রিক ইতিহাস প্রকাশিত হইয়াছে। প্রায় সাতশত পৃষ্ঠায় বারোজন বাঙালী পণ্ডিত ও মনীষীর সমবেত প্রচেষ্টায় প্রসূত এই গ্রন্থকে বাঙলার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে বিগত ৭৫ বৎসরের সম্মিলিত গবেষণার সমষ্টিগত ফল বলা যাইতে পারে। আলোচনারম্ভেই যে অভাব সম্বন্ধে অভিযোগ করা হইয়াছে, এই গ্রন্থ প্রকাশের ফলে সেই অভাব কিছুটা মিটিয়াছে এ কথা বোধ হয় বলা যায়। এ গ্রন্থ বাঙালীর পণ্ডিত ও মনীষার গৌরব, এমন উক্তি করিলে খুব অত্যুক্তি কিছু করা হয় না। সম্প্রতি রমেশবাবু এই সুবৃহৎ গ্রন্থের একটি বাঙলা সংক্ষিপ্তসারও প্রকাশ করিয়াছেন।
কিন্তু তৎসত্ত্বেও বাঙলার এই ইতিহাসকে বাঙালীর ইতিহাস বোধ হয় বলা চলে না। তাহার কারণ একটু সংক্ষেপে বলা যাইতে পারে। প্রথমত, ইতিহাসের কোনও যুক্তি, কার্যকরণ-সম্বন্ধের কোনও ব্যাখ্যা বা ইঙ্গিত এই ইতিহাস-পরিকল্পনার পশ্চাতে নাই; তাহা না থাকিবার ফলে প্ৰত্যেকটি অধ্যায় সুপরীক্ষিত, সুআলোচিত ও তথ্যবহুল হওয়া সত্ত্বেও এই গ্রন্থে সমসাময়িক বাঙালীর সমগ্র জীবনধারার যথার্থ পরিচয় ফুটিয়া উঠিতে পারে নাই। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন বাঙলায় যাহাদের বলা যায় জনসাধারণ, যাঁহারা বর্ণসমাজের বাহিরে, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বাহিরে অথবা বৌদ্ধধর্মের বাহিরে, যাহারা রাষ্ট্রের দরিদ্র ভূমিহীন প্রজা বা স্বল্পভূমিবান প্রজা বা সমাজশ্রমিক তাহাদের কথা এই গ্রন্থে যথেষ্ট স্থান পায় নাই; অথচ তাঁহারাই যে ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এ সম্বন্ধে তো সন্দেহ নাই। যে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবী, গ্রাম্য জনসাধারণের জীবনযাত্রা, গ্রামের সঙ্গে নগরের পার্থক্য ও-যোগাযোগের অধিকতর তথ্য, যে অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর সমগ্র জীবনধারা প্রবহমান তাহার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা জনসাধারণের এই ইতিহাসকে পূর্ণতর ও উজ্জ্বলতর করিতে পারিত, তাহা পরিপূর্ণ মর্যাদায় এই গ্রন্থভুক্ত হইতে পারে নাই | সত্য বটে, ইঁহাদের কথা বলিবার মতো যথেষ্ট তথ্য হয়তো আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই; তবু, যতটুকু জানা যায় ততটুকু অন্তত প্রাচীন বাঙলাদেশকে বেশি জানা। তৃতীয়ত, এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি অধ্যায় বিচ্ছিন্ন; একে অন্যের সঙ্গে অপরিহার্য অনিবার্য সম্বন্ধসূত্রে গ্রথিত নয়। সুলিখিত এবং তথ্যবহুল রাজকাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের আলোচনা এই গ্রন্থের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অধিকার করিয়া আছে; কিন্তু এত বেশি মূল্য পাওয়া সত্ত্বেও রাজ্য ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন দিকের যোগাযোগ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু সচেতনতা এই অধ্যায়গুলিতে নাই। ভাষা এবং সাহিত্য গম্বন্ধে অধ্যায় দুইটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ, তথ্যবহুল এবং অত্যন্ত সুলিখিত; কিন্তু ইঁহাদের মধ্যেও সাহিত্যের সঙ্গে সমসাময়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের এবং অর্থনৈতিক অবস্থার সম্বন্ধের ইঙ্গিত অত্যন্ত কম। ধর্মের অধ্যায়ে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবীর অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রায় নাই বলিলেই চলে; অথচ, বাঙলাদেশে উচ্চতর বর্ণসমাজে যে ধর্মের প্রচলন তাহার ভিত্তিভূমিই হইতেছে লোকধর্ম, লৌকিক দেবদেবী ও লৌকিক আচারানুষ্ঠান। সমাজ কথাটিও অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; তবু জনসাধারণের কথা যাহা কিছু তাহা সমাজ-অধ্যায়েই আছে। একমাত্র এই অধ্যায় এবং ইহার পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থার অধ্যায়েই জনসাধারণ আমাদের দৃষ্টির বাহিরে পড়িয়া থাকে নাই। কিন্তু, এসব ক্ষেত্রেও ধর্ম, সমাজ ও আর্থিক অবস্থার সঙ্গে রাজা ও রাষ্ট্রের এবং গণ বিন্যস্ত, শ্রেণী-বিন্যস্ত বৃহত্তর সমাজের সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা যথেষ্ট করা হয় নাই।
রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আর্থিক বিন্যাস প্রভৃতি সমস্ত কিছুই গড়িয়া তোলে মানুষ; এই মানুষের ইতিহাসই যথার্থ ইতিহাস। এই মানুষ সম্পূর্ণ মানুষ; তাহার একটি কর্ম অন্য আর একটি কর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন নয় এবং বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিলে দেখা ও পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না; একটি কর্মের সঙ্গে অপরাপর কর্মকে যুক্ত করিয়া দেখিলে তবেই তাহার সম্পূর্ণ রূপ ও প্রকৃতি দৃষ্টিগোচর হয়। দেশকালধৃত মানুষের সমাজ সম্বন্ধেও এ কথা সত্য এবং সর্বত্র স্বীকৃত। এই সত্য স্বীকৃতি না পাইলে ইতিহাস যথার্থ ইতিহাস হইয়া উঠিতে পারে না। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত যে ভারতবর্ষের ইতিহাস ব্রিটিশ ইতিহাস-রচনার আদর্শ এবং আমরা আমাদের দেশে যে আদর্শ ও পদ্ধতি এ-যাবৎ অনুসরণ করিয়া আসিয়াছি তাহার মূলে পূর্বোক্ত তার স্বীকৃতি যথেষ্ট নাই। ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির যুক্তি না লিয়াও বলা যায়, উনবিংশ শতকের মধ্যপাদ হইতেই মানবিক তথ্য ও তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও আলোচনায় এই সত্য স্বীকৃত যে, মানুষের সমাজই মানুষের সর্বপ্রকার কর্মকৃতির উৎস, এবং সেই সমাজের বিবর্তন-আবর্তনের ইতিহাসই দেশকালধৃত মানব-ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করে। আমাদের দেশে ইতিহাসালোচনায় এই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টি ও আলোচনা-পদ্ধতি আজও পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করে নাই। তাহা ছাড়া, এই দেশে রাজকাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্র-কাহিনী আজও ঐতিহাসিক গবেষণা ও আলোচনার একটা প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে। ইহার কারণ অবশ্য সহজবোধ্য ও সুপরিজ্ঞাত। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের রাজসভায় রাজা ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যে-সব গ্রন্থ রচিত হইত তাহার মধ্যে রাজকাহিনী, রাষ্ট্রকাহিনী গ্রন্থের অপ্রাচুর্য ছিল না—রাজসভায় তাহা হইয়াই থাকে—কিন্তু এইসব গ্রন্থে দেশের সমাজবিন্যাস বা জ্ঞান-বিজ্ঞান সৃষ্টি ও আলোচনার যথেষ্ট স্থান বা মূল্য ছিল না। অথচ, রাজা ও রাষ্ট্র ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় কখনও একান্ত হইয়া থাকে নাই। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বত্র আমাদের জীবন ছিল একান্তই সমাজকেন্দ্রিক, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়; আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের যাহা কিছু কর্মকৃতি সমস্তই আবর্তিত হইত সমাজকে ঘিরিয়া। কিন্তু, উনবিংশ শতকে ইতিহাস-রচনার যে রীতিপদ্ধতি ও আদর্শের সন্ধান আমরা ইংরাজি শিক্ষার ভিতর দিয়া পাইয়াছি তাহা একান্তই রাজা ও রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক। বিংশ শতকে তাহ অনেকটা সমাজ ও সংস্কৃতি আলোচনার দিকে মোড় ফিরিয়াছে সত্য, কিন্তু এখনও সমাজকেন্দ্ৰিক হইয়া উঠে নাই।