উপরোক্ত দীর্ঘমুণ্ড জনেরা যে জনস্তর গড়িয়া তুলিয়াছিল, উত্তর-পশ্চিম হইতে তাহার উপর এক গোলমুণ্ড জন আসিয়া নিজেদের রক্তপ্রবাহ সঞ্চারিত করিল। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইহাদের সঙ্গে গোলমুন্ড মোঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর কোনই সম্বন্ধ নাই। এই জনের সর্বপ্রাচীন সাক্ষ্য সংগৃহীত হইয়াছে হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োতে প্রাপ্ত মুণ্ডকঙ্কাল হইতে। ইহাদের সঙ্গে পূর্ব-ইউরোপের দীনারায় এবং কতকাংশে আর্মানীয় জাতির সম্বন্ধ সুস্পষ্ট। এই জাতিই লাপোং, রিজলি, লুসসান ও রমাপ্রসাদ চন্দ-কথিত অ্যালপাইন (Homo Alpinus) নরগোষ্ঠী, বিরজাশংকর গুহ কথিত অ্যালপো-দীনায়ীয় নরগোষ্ঠী, ফন আইকস্টেডট কথিত পশ্চিম ও পূর্ব ‘ব্র্যাকিড’ বা গালমুণ্ড নরগোষ্ঠী। বাঙলাদেশের উচ্চবর্ণের ও উত্তম সংকর বর্ণের জনসাধারণের মধ্যে যে গোল ও মধ্যম মুণ্ডাকৃতি, তীক্ষ্ণ ও উন্নত এবং মধ্যম নাসাকৃতি ও মাধ্যমিক দেহ-দৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অনেকাংশে এই নরগোষ্ঠীরই দান। বস্তুত, বাঙলাদেশের যে জন ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানত অ্যালপাইন ও আদি-অষ্ট্রেলীয়, এই দুই জনের লোকদের কীর্তি। পরবর্তী কালে আগত আর্যভাষাভাষী আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ ও সংস্কৃতি তাহার উপরের স্তরের একটি ক্ষীণ প্রবাহ মাত্র, এবং এই প্রবাহ বাঙালীর জীবন ও সমাজবিন্যাসের উচ্চতর স্তরেই আবদ্ধ; ইহার ধারা বাঙালীর জীবন ও সমাজের গভীর মূলে বিস্তৃত হইতে পারে নাই। যাহাই হোক, পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল্পস পর্বত, দক্ষিণ আরব ও ইউরোপের পূর্বদেশবাসী এই অ্যালপাইন জনের বংশধরেরা বর্তমান ভারতবর্ষে ছড়াইয়া আছে নানা স্থানে—গুজরাটে, কর্ণাটে, মহারাষ্ট্রে, কুর্গে, মধ্যভারতে, বিহারে নাগর ব্রাহ্মণদের মধ্যে, বাঙলায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য এবং উপরের বর্ণস্তরের সকল লোকদের মধ্যে। সর্বত্র সমানভাবে একই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নাই, এ কথা সত্য, কিন্তু ভারতবর্ষে গোলমুণ্ড, উন্নতনাস মানুষের রক্তধারা যেখানে যে পরিমাণে আছে তাহার মূলে এই গোলমুণ্ড, উন্নতনাস অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী উপস্থিত। ফন আইকস্টেডটের মতে এই নরগোষ্ঠীর তিন শাখা : পশ্চিম ব্র্যাকিড, যাহাদের বংশধর বর্তমান মহারাষ্ট্র ও কুর্গের অধিবাসীরা, গাঙ্গেয় উপত্যকার দীর্ঘদেহ ব্র্যাকিডরা এবং বাঙলা ও উড়িষ্যার পূর্ব ব্র্যাকিডরা। এই তিন শাখাই, তাঁহার মতে, আর্যভাষী ‘ইণ্ডিড’ নামক বৃহত্তর নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু যে জন বিশিষ্ট ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্মদাতা এবং যাহারা পূর্বতন ভারতীয় সংস্কৃতির আমূল রূপান্তর সাধন করিয়া তাহাকে নবকলেবর নবরূপ দান করিয়াছিল, তাহারা এই অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী হইতে পৃথক। এই নূতন জনের নরতত্ত্ববিদ্দত্ত নাম হইতেছে আদি-নর্ডিক (proto-Nordic) | এই আদি-নর্ডিক জনই বৈদিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সৃষ্টিকর্তা ভারতবর্ষে ইহাদের সুপ্রাচীন কোনও কঙ্কালাবশেষ আবিষ্কৃত হয় নাই; তবে, তক্ষশীলার ধর্মরাজিকা বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে কয়টি নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়াছে তাহা হইতে অনুমান হয়, ইহাদের মুখাবয়ব দীর্ঘ সুদৃঢ় ও সুগঠিত নাসিকা সংকীর্ণ ও সুউন্নত, মুণ্ডাকৃতি দীর্ঘ হইলেও গোলের দিকে ঝোঁক সুস্পষ্ট এবং নিচের দিকে চোয়াল দৃঢ় মাথার খুলি এবং মুখাবয়ব হইতে মনে হয়, ইহাদের দেহ ছিল খুব বলিষ্ঠ ও দৃঢসংবদ্ধ। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, হিন্দুকুশ পর্বতের কাফীর প্রভৃতি কোমের লোকেরা, পঞ্জাব ও রাজপুতনার উচ্চশ্রেণীর ও বর্ণের লোকেরা ইহাদেরই বংশধর, যদিও শেষোক্ত দুই স্থানে পূর্বতন দীর্ঘমুণ্ড জাতির সঙ্গে ইহাদের সংমিশ্রণ একটু বেশি ঘটিয়াছে বলিয়া মনে হয়। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সর্বত্রই ইহাদের ধারাচিহ্ন পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা সর্বত্র খুব বলিষ্ঠ ও বেগবান নয়। উত্তর-যুরোপের নর্ডিক জাতির সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই, তবে পার্থক্যও আছে, বিশেষভাবে চুল ও গায়ের রঙে। ভারতীয় নর্ডিক জাতির চুলের রং সাধারণত ঘন বাদামী হইতে ঘনকৃষ্ণ এবং চামড়া বাদামী হইতে রক্তিম গৌর। উত্তর-য়ুরোপের নর্ডিকদের চামড়া রক্তিম শ্বেত এবং কেশ পাতলা বাদামী হইতে শ্বেতোপম। এই পার্থক্য কতকটা জলবায়ু-নির্ভর সন্দেহ নাই, কিন্তু মূলত কতকটা পূর্বাপর ইতিহাসগত তাহাও অস্বীকার করা যায় না। সম্ভবত, বৈদিক আর্যসভ্যতার নির্মাতা নর্ডিকেরাই আদি-নর্ডিক, এবং ইহারাই পরবর্তীকালে উত্তরে যুরোপখণ্ডে গিয়া ক্রমশ নুতন দেহলক্ষণ উদ্ভব করিয়াছিল। ফন আইকস্টেডট এই বলিষ্ঠ ও দুর্জয় নরগোষ্ঠীর নামকরণ করিয়াছেন ‘ইন্ডিড’। যাহাই হউক, ইহাদেরই আর্যভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কালে বহু শতাব্দী ধরিয়া ধীরে ধীরে বাঙলাদেশে সঞ্চারিত হইয়া পূর্বতন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আত্মসাৎ করিয়া নূতনরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠনে এই আদি-নর্ডিক জনের বক্ত ও দেহগঠন বৈশিষ্ট্যের দান অত্যন্ত অল্প; সে ধারা শীর্ণ ও ক্ষীণ, এত শীর্ণ ও ক্ষীণ যে বাঙলাদেশের ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তাহা খুব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সত্ত্বেও সহসা ধরা পড়ে না। বর্তমান যুক্তপ্রদেশ, রাজপুতনা বা পঞ্জাবের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নরতত্ত্বের দিক হইতে বাঙালী ব্রাহ্মণের কোনও সম্বন্ধই যে প্রায় নাই তাহার কারণ এই তথ্যের মধ্যে নিহিত। ঐসব দেশের ব্রাহ্মণেরা যে সামাজিক ক্ষেত্রে বাঙালী ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বের দাবি সম্পূর্ণ স্বীকার করেন না তাহার অন্যতম কারণ এই জনপার্থক্য নয় কি?