নিম্নবর্ণের বাঙালীর এবং বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ভিতর যে জনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, নরতত্ত্ববিদেরা তাঁহাদের নামকরণ করিয়াছেন আদি-অষ্ট্রেলীয় (proto-Austroloid)। তাঁহারা মনে করেন যে, এই জন এক সময় মধ্য-ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণ-ভারত, গলে হইতে একেবারে অষ্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মোটামুটিভাবে ইহাদের দেহ বৈশিষ্ট্যের স্তরগুলি ধরা পড়ে ভারতবর্ষে, বিশেষভাবে মধ্য ও দক্ষিণ-ভারতের আদিম আধিবাসীদের মধ্যে, সিংহলের ভেড্ডাদের মধ্যে এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে। এই তথ্যই বোধ হয় আদি-অষ্ট্রেলীয় নামকরণের হেতু যাহা হউক, মধ্য ও দক্ষিণ-ভারতের আদিম আধিবাসীরা যে খর্বকায়, কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘমুণ্ড, প্রশস্তনাস, তাম্ৰকেশ এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের বংশধর এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। পশ্চিম-ভারতে এবং উত্তর-ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশে যে সব লোকের স্থান হিন্দু সমাজবিন্যাসের প্রান্ততম সীমায় তাহারা, মধ্য-ভারতের কোল, ভীল, করোয়া, খারওয়ার, মূল ভূমিজ, মালপাহাড়ী প্রভৃতি লোকেরা, দক্ষিণ-ভারতের চেঞ্চু, কুরুব, য়েরুব প্রভৃতি লোকেরা, সকলেই সেই আদি অষ্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর লোক। বেদে যে নিষাদদের উল্লেখ আছে, বিষ্ণু-পুরাণে যে নিষাদদের বর্ণনা করা হইয়াছে অঙ্গার-কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায়, চ্যাপটামুখ বলিয়া, ভাগবত পুরাণ যাহাদের বর্ণনা করিয়াছে কাককৃষ্ণ, অতি খর্বকায়, খর্ববাহু, প্রশস্তনাস, রক্তচক্ষু এবং তাম্রকেশ বলিয়া, সেই নিষাদরাও আদি-অষ্ট্রেলীয়দেরই বংশধর বলিয়া অনুমান করিলে অন্যায় হয় না। পুরাণোক্ত ভীল্ল-কোল্লরাও তাহাই। বর্তমান বাঙলা দেশের, বিশেষভাবে রাঢ় অঞ্চলের সাঁওতাল, ভূমিজ মুণ্ডা, বাঁশফোঁড়, মালপাহাড়ী প্রভৃতিরা যে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এ অনুমান নরতত্ত্ববিরোধী নয়। এই আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে পূর্বতন নিগ্রোবটুদের কোথায় কোথায় কতখানি রক্তমিশ্রণ ঘটিয়াছিল তাহা বলা কঠিন, তবে কোথাও কোথাও কিছু কিছু যে ঘটিয়াছিল তাহা অনস্বীকার্য। তাহা না হইলে মধ্য-ভারতের, দক্ষিণ-ভারতের এবং বাঙলাদেশের আদি অষ্ট্রেলীয়দের মধ্যে দেহ-বৈশিষ্ট্যের যে পার্থক্য দেখা যায়, তাহার যথেষ্ট ব্যাখ্যা খুঁজিয়া পাওয়া যায়না। এ প্রসঙ্গে বলা উচিত, ফন আইকস্টেডট মোটামুটি এই আদি-অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর যে অংশ মধ্য ও পূর্ব-ভারতবর্ষের অধিবাসী তাঁহাদের নামকরণ করিয়াছেন ‘কেলিড্’ এবং সিংহলীয় অংশের ‘ভেডিড্’। ‘কোলিড্’ বা ‘কোলসম’ নামকরণ ভারতীয় ঐতিহ্যের সমর্থক; সেই কারণে আইকস্টেডটের এই নামকরণ গ্রহণযোগ্য।
ভারতবর্ষের জনবহুল সমতল স্থানগুলিতে যে জনের বাস তাঁহাদের মধ্য হইতে পূর্বোক্ত আদিম আধিবাসীদের দেহলক্ষণগুলি বাদ দিলে কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হয়। এই জনের লোকেরা দেহদৈর্ঘ্যে মধ্যমাকৃতি, ইহাদের মুণ্ডাকৃতি দীর্ঘ ও উন্নত, কপাল সংকীর্ণ মুখ খর্ব এবং গণ্ডাস্থি উন্নত, নাসিকা লম্বা ও উন্নত কিন্তু নাসামুখ প্রশস্ত, ঠোঁট পুরু এবং মুখগহুর বড়, চোখ কালো এবং গায়ের চামড়া সাধারণত পাতলা হইতে ঘন বাদামী। দক্ষিণ-ভারতের অধিকাংশ লোক এবং উত্তর ভারতের নিম্নতর শ্রেণীর প্রায় সকলেই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দীৰ্ঘমুণ্ড জনের বংশধর, এবং এই দীর্ঘমুণ্ড জনেরাই ভারতীয় জনপ্রবাহে যে দীর্ঘমুণ্ডধারা বহমান তাহার উৎস। বাঙলাদেশেও উত্তম ও মধ্যম সংকর এবং অন্ত্যজ পর্যায়ে যে দীর্ঘমুণ্ডের ধারাচিহ্ন দেখা যায়, তাহাও মূলত এই নরগোষ্ঠীরই দান। এই গোষ্ঠীর আদি বাসস্থান কোথায় এবং বিস্তৃতি কোথায় ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই, তবে বিরজাশংকর গুহ মহাশয় প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, এক সময় এই দীর্ঘমুণ্ডগোষ্ঠী উত্তর-আফ্রিকা হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতের উত্তর-পশ্চিম দেশগুলি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; পরে নব্যপ্রস্তর যুগে ইহারা ক্রমশ মধ্য, দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃতি লাভ করে এবং এইসব দেশে আদি-অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে ইহাদের কিছু রক্তসংমিশ্রণ ঘটে।
এই সদ্যকথিত জন ছাড়া আরও দুইটি দীর্ঘমুণ্ড জন কিছু পরবর্তীকালেই ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাস করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। এই দুই জনের কিছু কিছু কঙ্কালাবশেষ পাওয়া গিয়াছে সিন্ধু নদীর উপত্যকায়। মাকরান, হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োর নিম্নস্তরে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলি হইতে মনে হয় ইহাদের মধ্যে একটির দেহগঠন ছিল সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ, মগজ বড়, ভূ-অস্থি স্পষ্ট, কানের পিছনের অস্থি বৃহৎ। এইসব দেহলক্ষণ পাঞ্জাবের সমরকুশল, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ কোনও কোনও শ্রেণী ও বর্ণের ভিতর এখনও দেখা যায়। কিন্তু এই জন পাঞ্জাব অতিক্রম করিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে আর অগ্রসর হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। দ্বিতীয় দীর্ঘমুন্ড জনের পরিচয়ও মহেন-জো-দড়োর কোনও কোনও কঙ্কালাবশেষ হইতেই পাওয়া যায়। এই জনের লোকদের দেহগঠন তত সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ নয়, বরং ইহারা দৈর্ঘ্যেও একটু খর্ব, কিন্তু মুখাবয়ব তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট, নাসিকা তীক্ষ্ণ ও উন্নত, কপাল ধনুকের মতো বঙ্কিম। ইহাদের মধ্যে ভূমধ্য নরগোষ্ঠীর দেহলক্ষণের সাদৃশ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট, এবং অনুমান করা যায়, সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার যে পরিচয় হরপ্পা ও মহেন-জো-দড়োতে আমরা পাইয়াছি তাহা ইহাদেরই সৃষ্টি। উত্তর-ভারতে সর্বত্র সকল বর্ণের মধ্যেই, বিশেষভাবে উচ্চবর্ণের লোকদের ভিতর, এই দীর্ঘমুণ্ড নরবংশের রক্তধারা প্রবহমান এবং এই রক্তপ্রবাহের তারতম্যের ফলেই উত্তর-ভারত ও দক্ষিণ-ভারতের লোকদের মধ্যে এ ধারার কিছুটা অস্তিত্ব অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বাঙলাদেশে এই দীর্ঘমুণ্ড জনের রক্তপ্রবাহের ধারা কতখানি আসিয়া পৌঁছিয়াছিল তাহা নিশ্চয়ই করিয়া বলা যায় না; কতকটা স্রোতস্পর্শ যে লাগিয়াছিল সে সম্বন্ধে সন্দেহ কী?