রিজলির মত যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য মনে না করিবার কারণ অনেক। প্রথমত, দ্রাবিড় কোনও নরগোষ্ঠীর নাম নয়, এমন কি জনের নামও নয়, ভাষাতাত্ত্বিক শ্রেণীবিভাগের অন্যতম নাম মাত্র। দ্বিতীয়ত, গঙ্গাতট হইতে আরম্ভ করিয়া সিংহল পর্যন্ত দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত নাই; মধ্যভারতের জঙ্গলময় আটবী ও পার্বত্য ভূমিতে অস্ট্রিক-ভাষাভাষী লোকের বাস এখনও বিদ্যমান। তৃতীয়ত, রিজলি যে সব তথাকথিত দ্রাবিড় উপজাতিদের নাম করিয়াছেন, মস্তিষ্কাকৃতির দিক হইতে তাহারা সকলেই মোটামুটি দীর্ঘমুণ্ড হইলেও প্রত্যেক সমাজের উচ্চতম কোমগুলিতে গোল মুণ্ডাকৃতিরও কিছু অভাব নাই। নাসাকৃতিও মোটামুটি উন্নত ও তীক্ষ্ণ হইতে একেবারে চ্যাপটা পর্যন্ত। কাজেই দ্রাবিড় ভাষাভাষী বিচিত্র জন লইয়া সমগ্র সমষ্টিটাকেই দ্রাবিড় বলাটা খুব যুক্তিসংগত নয়। চতুর্থত, রিজলি যাহাঁদের বলিয়ছিলেন দ্রাবিড়, নরতত্ত্বের বিশ্লেষণে তাঁহাদের মধ্যে অন্তত দুইটি বিভিন্ন জনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে : ১. আদি-নিগ্রোবটু : ইহাদের মাথা দীর্ঘ ও উচ্চ, নাক তীক্ষ্ণ ও সুউচ্চ, ২ আদি-অষ্ট্রেলীয় : ইহাদের মাথা দীর্ঘ ও অনুচ্চ, নাক মধ্যম। ইহাদের সঙ্গে বাঙালীর জনতত্ত্বের সম্বন্ধ কী এবং কোথায়, এবং থাকিলে কতটুকু সে আলোচনা পরে করা যাইবে। আপাতত এইটুকু বলা চলে, রিজলি কথিত দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীদের কাছে অগ্রাহ্য। রিজলি কথিত মোঙ্গলীয় প্রভাব সম্বন্ধে প্রথমেই বলিতে হয়, বাঙলার ও ভারতের পূর্ব ও উত্তর-শায়ী প্রত্যন্তদেশগুলির সকল ভোট-চৈনিক গোষ্ঠীর লোকেরাই গোলমুণ্ডাকৃতি নয়। দ্বিতীয়ত, আর্যদের ভারতীগমনের পূর্বে আর্যভাষা বিস্তৃতিলাভের আগে, বাঙলা, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর পর্যন্ত মোঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর লোকেরা বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, ইতিহাসে এমন কোনও প্রমাণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। দীর্ঘকরোটি কোচ, পলিয়া, বা উত্তর-বাঙলার বাহে, রাজবংশী প্রভৃতি ভোট-চৈনিক গোষ্ঠীর লোকেরা হিমালয় অঞ্চল বা ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকা হইতে আসিয়া ঐতিহাসিক যুগেই উপনিবিষ্ট হইয়াছে। তৃতীয়ত, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এইসব মোঙ্গোলীয়ের বেশির ভাগই দীৰ্ঘমুণ্ড; কাজেই, বাঙালীর মধ্যে যে গোল মুণ্ডাকৃতি দেখা যায় তাহা এইসব মোঙ্গোলীয় জাতির প্রভাবের ফলে হইতেই পারে না। উত্তরের লেপচা, ভোটানী, চট্টগ্রামের চাকমা প্রভৃতি লোকেরা গোলমুণ্ড বটে, কিন্তু ইহাদেরই রক্তপ্রভাবে যদি বাঙালীর মাথা গোল হইত তাহা হইলে স্বভাবতই এইসব দেশের কাছাকাছি দেশখণ্ডগুলিতেই গোলমুণ্ড, প্রশস্তনাস বাঙালীদের দেখা যাইত, কিন্তু যথার্থ তথ্য এই যে, এই বৈশিষ্ট্যগুলি বেশি দেখা যায় দক্ষিণে, পূর্বে ও উত্তরে নয়। চতুর্থত, মোঙ্গোলীয় জাতির লোকদের বঙ্কিম চক্ষু, শক্ত চুল, অক্ষিকোণের মাংসের পর্দা, উন্নত গণ্ডাস্থি, কেশস্বল্পতা, চ্যাপটা নাসাকৃতি এবং পীতাভ বর্ণ বাঙলাদেশে আমরা আরও বেশি করিয়া গভীর ও ব্যাপকভাবে পাইতাম, যদি যথার্থই মোঙ্গোলীয় প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে থাকিত। পঞ্চমত, বিরজাশংকর গুহ মহাশয় বাঙলার উত্তর ও পূর্ব-প্রান্তশায়ী মোঙ্গোলীয় অধিবাসীদের পরিমিতি গণনা করিয়া দেখাইয়াছেন যে, গারো, খাসিয়া, কুকী, এমন কি মৈমনসিংহের উত্তরতম প্রান্তের গারোদের এবং অন্যান্য কোমের লোকদের মুণ্ডাকৃতি মধ্যম, খুব বড় জোর গোলের দিকে একটু ঝোঁক আছে। কাজেই বাঙালীদের মধ্যে যে গোলমুন্ডের দিকে ঝোঁক তাহা মোঙ্গোলীয় জনদের গোলমুণ্ড অথবা মধ্যমমুণ্ডের প্রভাবের ফল হইতে পারে না। এইসব নানা কারণে রিজলির মোঙ্গোলীয়-দ্রাবিড় সাংকর্যের মত এখন আর গ্রাহ্য নয়।
কিন্তু, রিজলি বাঙালীর জনতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্যনির্দেশে খুব ভুল কিছু করেন নাই; ভুল করিয়াছিলেন সেই বৈশিষ্ট্যের মূল অনুসন্ধানে। মূল যে মোঙ্গোলীয়-দ্রাবিড় সংমিশ্রণের মধ্যে নাই, এ বিষয়ে নরতত্ত্ববিদেরা এখন আর কিছু সন্দেহ করেন না; সেই মূলের সন্ধান পাওয়া যায় ভারতীয় নরতত্ত্বের নব-নির্ণত ইতিহাসের মধ্যে। কাজেই, তাহার পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক নয়। এই নব-নির্ণীত ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ ও নির্দোষ নয়, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভারতীয় নরতত্ত্বের এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর জনরহস্যের কাঠামোটা আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়িতে বাধে না।
৩. ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান
ভারতীয় জনতত্ত্বে বাঙালীর স্থান
নৃতত্ত্ববিদেরা মনে করেন ভারতীয় জনসৌধের প্রথম স্তর নেগ্ৰিটো বা নিগ্রোবটু জন। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এবং মালয় উপদ্বীপে যে নেগ্ৰিটো জনের বসবাস ছিল এ তথ্য বহু পুরাতন। কিছুদিন আগে হাটন, লাপিক ও বিরজাশংকর গুহ মহাশয় দেখাইয়াছিলেন যে, আসামের অঙ্গামি নাগাদের মধ্যে এবং দক্ষিণ ভারতের পেরাম্বকুলম এবং আন্নামালাই পাহাড়ের কাদার ও পুলায়ানদের ভিতর নিগ্রোবটু রক্তপ্রবাহ স্পষ্ট। ভারতীয় নিগ্রোবটুদের দেহবৈশিষ্ট্য কিরূপ ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় কম, কারণ বহুযুগ পূর্বেই ভারতবর্ষের মাটিতে তাহারা বিলীন হইয়া গিয়াছিল। তবে বিহারের রাজমহল পাহাড়ের আদিম অধিবাসীদের কাহারও কাহারও মধ্যে কখনও কখনও যে ধরনের ক্ষুদ্রকায়, কৃষ্ণাভ ঘনশ্যাম, উর্ণাবৎ কেশযুক্ত, দীৰ্ঘমুণ্ডাকৃতির দেহবৈশিষ্ট্য দেখা যায়, কাদারদের মধ্যে যে মধ্যমাকৃতি নরমুণ্ডের দর্শন মেলে, তাহা হইতে এই অনুমান করা যায় যে, ভারত ও বাঙলার নিগ্রোবটুরা দেহগঠনে কতকটা তাহাদের প্রতিবাসী নিগ্রোবটুদের মতনই ছিল; বিশেষভাবে মালয় উপদ্বীপে সেমাং জাতির দেহগঠনের সঙ্গে তাঁহাদের সাদৃশ্য ছিল বলিয়া গুহ মহাশয় অনুমান করেন। বাঙলার পশ্চিম প্রান্তে রাজমহল পাহাড়ের বাগদীদের মধ্যে, সুন্দরবনের মৎসশিকারী নিম্নবর্ণের লোকদের মধ্যে, মৈমনসিংহ ও নিম্নবঙ্গের কোনও কোনও স্থানে কচিৎ কখনও, বিশেষভাবে সমাজের নিম্নতম স্তরের লোকদের ভিতর, যশোহর জেলার বাঁশফোঁড়দের মধ্যে মাঝে মাঝে যে কৃষ্ণাভ ঘনশ্যামবর্ণ, প্রায় উর্ণাবৎ কেশ, পুরু উল্টানো ঠোঁট, খর্বকায়, অতি দাপট নাকের লোক দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা তো নিগ্রোবটু রক্তেরই ফল বলিয়া মনে হয়। নিগ্রোবটুদের এই বিস্তৃতি হইতে অনুমান করা চলে যে, এখন তাঁহাদের অবশেষ প্রমাণসাপেক্ষ হইলেও এক সময়ে এই জাতি ভারতবর্ষে এবং বাঙলার স্থানে স্থানে সুবিস্তৃত ছিল। কিন্তু বিচিত্র জনসংঘর্ষের আবর্তে তাহারা টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। জার্মান পণ্ডিত ফন আইকস্টেডট্র কিন্তু ভারতবর্ষে নিগ্রোবটুদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, এ দেশে সন্ধানসম্ভাব্য আদিমতম স্তরে নিগ্রোবটুসম অর্থাৎ কতকটা ঐ ধরনের দেহলক্ষণবিশিষ্ট একটি নরগোষ্ঠীর বিস্তার ছিল, কিন্তু তাহারা যে নেগ্ৰিটো বা নিগ্রোবটু নরগোষ্ঠীরই লোক, এ কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।