বাঙালীর জনতত্ত্ব নিরূপণের কিছুটা সহায়ক উপায়, বাঙলা ভাষার বিশ্লেষণ। অবশ্য এ কথা সত্য যে ভাষাবিশ্লেষণের সাহায্যে নরতত্ত্ব ঠিক নির্ণয় করা চলে না ; কারণ মানুষ নানা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অথবা ধর্মগত কারণে ভাষা বদলায় ; এক জন অন্য জনের ভাষা গ্রহণ করে এবং সেই ভাষাই দুই-তিন পুরুষ পরে নিজেদের জাতীয় ভাষায় পরিণতি লাভ করে ; ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই। কাজেই ভাষার উপর নির্ভর করিয়া নরতত্ত্ব নির্ণয়ের চেষ্টা স্বভাবতই অযৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পস্থার বিরোধী। তবে জননির্ণয়ে ভাষা-বিশ্লেষণ যে অন্যতম সহায়ক এ কথাও একেবারে উড়াইয়া দেওয়া যায় না। কোনও জনের ভাষা বিশ্লেষণ করিয়া যদি দেখা যায় সেই ভাষার জীবনচর্যার মূল শব্দগুলি কিংবা পদরচনারীতি কিংবা পদভঙ্গি অথবা মানুষ ও স্থান ইত্যাদির নাম অন্য কোনও জনের ভাষা হইতে গৃহীত বা উদ্ভূত, তখন স্বভাবতই এ অনুমান করা চলে যে, সেই পূর্বোক্ত জনের সঙ্গে শেষোক্ত জনের রক্তে সংমিশ্রণ না হোক, মেলামেশা ঘটিয়াছে। এই মেলামেশা নানা সামাজিক ও অন্যান্য কারণে সমাজ-কাঠামোর সকল স্তরে নাও হইতে পারে, যে যে স্তরে হইয়াছে সেখানেও সর্বত্র সমভাবে হইয়াছে এ কথাও বলা যায় না। যাহাই হউক, ভাষাবিশ্লেষণের ইঙ্গিত নরগোষ্ঠী নির্ধারণে না হউক, জন-নিরূপণে অনেকখানি সাহায্য করিতে পারে ; আর সেই ইঙ্গিতের মধ্যে যদি নরতত্ত্ব-বিশ্লেষণলব্ধ ইঙ্গিতের সমর্থন পাওয়া যায়, তাহা হইলে পূরক সাক্ষ্য হিসাবে জনতত্ত্ব নির্ণয়ের কাজেও লাগিতে পারে।
বাঙলাদেশ ও বাঙলার সংলগ্ন প্রত্যন্ত দেশগুলির ভাষার বিশ্লেষণ অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। আচার্য গ্রিয়ার্সন হইতে আরম্ভ করিয়া সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় পর্যন্ত কয়েকজন খ্যাতনামা পণ্ডিত বাঙলা ভাষার জন্ম ও জীবনকথা নিরূপণ করিতে সার্থক প্রয়াস করিয়াছেন। ফরাসী পণ্ডিত জ্যাঁ পশিলুস্কি, জুল ব্লখ ও সিলভ্যাঁ লেভি এবং তাঁহাদের অনুসরণ করিয়া সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় আর্যপূর্ব ও দ্রাবিড়পূর্ব ভারতীয় ভাষা ও জন সম্বন্ধে যে মূল্যবান গবেষণার সূত্রপাত করিয়া দিয়াছেন, তাহাও প্রাচীন বাংলার ভাষা ও জন সম্বন্ধে নূতন আলোকপাত করিয়াছে, এবং তাহার ফলে বাঙলার জন-নিরূপণ-সমস্যা সহজতর হইয়াছে ।
বাঙালীর জনতত্ত্ব নিরূপণের অন্যতম সহায়ক উপায়, প্রাচীন ও বর্তমান বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতির বিশ্লেষণ। যেমন ভাষায় তেমনই বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতিতেও বিভিন্ন জনের সংমিশ্রণের ইতিহাস লুক্কায়িত থাকে। প্রত্যেক জনের ভিতর এই দুই বস্তু একটা রূপ গ্রহণ করে, এবং নানা উপায় ও উপকরণ, রীতি ও অনুষ্ঠান, আদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়া তাহা আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকে। কালচক্রে আবর্তে সেই জন যখন অন্য জনের দ্বারা পরাভূত অথবা মিত্র বা শক্ররূপে পরস্পরের সম্মুখীন হয়, একের সঙ্গে অন্যের আদান-প্রদান ঘটে তখন কোনও জনই নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে অন্যের প্রভাব হইতে মুক্ত রাখিতে পারে না। ব্যক্তির জীবনে সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মে যাহা ঘটে জনের জীবনেও তাঁহাই। অবশ্য, অধিকতর পরাক্রান্ত ও বীর্যবান যে জন সে প্রভাবান্বিত বেশি করে, নিজে প্রভাবান্বিত হয় কম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও স্তরে এই নৈকট্যের ফলে কমবেশি আদান-প্রদান চলিতেই থাকে এবং একটা সমন্বয়ও সঙ্গে সঙ্গে চলিতে থাকে। জীবধর্মের নিয়মই এইরূপ । আঘাত হইলেই প্রত্যাঘাতও অনিবার্য এবং দুইয়ে মিলিয়া একটা সমন্বিত গতিও সমান অনিবার্য। বাঙলাদেশে প্রাচীনকালে, এবং কতকটা বর্তমানেও, যে সমন্বিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি রূপ দেখিতে পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করিলে বিভিন্ন জনের বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতির কিছু কিছু পরিচয় সহজেই ধরা পড়ে, এবং ভাষা ও নৃতত্ত্ব বিশ্লেষণের সাহায্যে তাহা হইতে জন-নির্ণয়ের কাজটাও কিছুটা সহজ হয়। এ কথা অবশ্যই সত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিশ্লেষণ একক কখনোই জননির্দেশক হইতে পারে না। কিন্তু তাহা যে ইঙ্গিত দেয়, ভাষা ও নৃতত্ত্বের ইঙ্গিতের সঙ্গে তাহা যোগ করিলে জনতত্ত্বের স্বরূপ তাহাতে অল্পবিস্তর ধরা পড়িতে বাধ্য।
এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণের কাজ আমাদের দেশে খুব যে অগ্রসর হইয়াছে তাহা বলা যায় না । সংস্কৃতি, বিশেষভাবে ধর্ম ও মূর্তিতত্ত্ব এবং আচার-অনুষ্ঠানের বিশ্লেষণ কিছু কিছু যদি বা হইয়াছে, বাস্তব সভ্যতার বিশ্লেষণ একেবারেই হয় নাই। এক্ষেত্রে ভাষা-বিশ্লেষণের সাহায্য অপরিহার্য। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ যাহা হইয়াছে তাহার মধ্যে সমাজের উচ্চ ও নিম্নস্তরের লোকাচার ও লোকধর্ম অল্পই স্থান পাইয়াছে এবং পুরাণানুমোদিত ধর্মের স্থানও যথেষ্ট হয় নাই ; অথচ জনতত্ত্বের অনেক নিশানা ঐ গুহাগুলির মধ্যে নিহিত । এই সমস্ত উপায় ও উপকরণ সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য জানিবার উপায় নাই এবং জন ও ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে সব প্রশ্ন এই উপলক্ষে মনকে অধিকার করা সম্ভব, তাহার সবকিছুর উত্তর পাওয়া যাইবে, তাহাও বলা যায় না। তবে মোটামুটি কাঠামোটা ধরা পড়িতে পারে, এই আশা করা যায়। বাঙালীর ইতিহাসের জন্য বাঙলাদেশের নরতত্ত্ব ও তৎসংলগ্ন অন্যান্য সমস্যা সম্বন্ধে যে সব আলোচনা-গবেষণা ইত্যাদি হইয়াছে তাহার বিশদ ও বিস্তারিত পরিচয় ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন এখানে কিছু নাই। এই আলোচনা ও গবেষণার মোটামুটি ফলাফল একত্র করিতে পারিলে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণের ফলাফলের সম্বন্ধ নির্ণয় করিতে পারিলেই ইতিহাসের প্রয়োজন মিটিতে পারে।