তাহা ছাড়া, এই যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া আমি প্রাচীন বাঙলা ও বাঙালীর সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনার প্রয়াসও করিতেছি না। সে সময় হয়তো এখনও আসে নাই। নূতন নূতন উপাদান প্রায়শ আবিষ্কৃত হইতেছে। বর্তমানে উপাদান সুপ্রচুর নয়, উপাদনলব্ধ সংবাদও অল্পতর। আমি শুধু কাঠামো রচনার প্রয়াস করিয়াছি, ভবিষ্যৎ বাঙালী ঐতিহাসিকরা ইহাতে রক্তমাংস যোজনা করবেন, এই আশা ও বিশ্বাসে। আরও একটু আশা এই যে, এই যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া বর্তমান সমাজ-বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তাঁহারা বাঙলার মধ্য ও উত্তর-পর্বের ইতিহাসও রচনা করিয়া তুলিবেন। সুযোগ ও অবসর ঘটিলে নিজের উপরও সে কর্তব্য পালনের দায়িত্ব রহিল, তাহা অস্বীকার করিতেছি না।
আমার কোনও কথাই শেষ কথা নয়। সত্যসন্ধী ঐতিহাসিকের কাছে শেষ কথা কিছু নাই; তাঁহার সব কথাই experiments with truth মাত্র। এই কাঠামো রচনার প্রয়াস সত্যে পৌঁছিবার নিম্নতম স্তর : এই স্তর যদি ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিককে সত্যে পৌঁছিতে কিছুমাত্র সহায়তা করে, তবেই আমার দেশের এবং আমার জাতির এই ইতিহাস-রচনা সার্থক বলিয়া মনে করিব |
০২. ইতিহাসের গোড়ার কথা
১. জনতত্ত্বের ভূমিকা
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
প্রথম পরিচ্ছেদ – জনতত্ত্বের ভূমিকা
জনতত্ত্বের ভূমিকা
একদা রবীন্দ্রনাথ ভারততীর্থকে অগণিত জাতির মিলনক্ষেত্র কল্পনা করিয়া বলিয়াছিলেন,
কেহ নাহি জানে, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা,
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা।
ভারততীর্থের অন্যতম প্রান্তিক দেশ বঙ্গভূমি সম্বন্ধেও এ কথা সমান প্রযোজ্য। গঙ্গা-করতোয়া-লৌহিত্যবিধৌত, সাগর-পর্বতষ্কৃত, রাঢ়-পুণ্ড-বঙ্গ-সমতট এই চতুর্জনপদসম্বদ্ধ বাঙলাদেশে প্রাচীনতম কাল হইতে আরম্ভ করিয়া তুকী অভু্যদয় পর্যন্ত কত বিভিন্ন জন, কত বিচিত্র রক্ত ও সংস্কৃতির ধারা বহন করিয়া আনিয়াছে, এবং একে একে ধীরে কোথায় কে কীভাবে বিলীন হইয়া গিয়াছে ইতিহাস তাহার সঠিক হিসাব রাখে নাই। সজাগ চিত্তের ও ক্রিয়াশীল মননের রচিত কোনও ইতিহাসে তাহার হিসাব নাই এ কথা সত্য, কিন্তু মানুষ তাহার রক্ত ও দেহগঠনে, ভাষায় ও সভ্যতার বাস্তব উপাদানে এবং মানসিক সংস্কৃতিতে তাহা গোপন করিতে পারে নাই। সকলের উপর এই বিচিত্র রক্ত ও সংস্কৃতির ধারা তাহার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রাখিয়া গিয়াছে বাঙালীর প্রাচীন সমাজবিন্যাসের মধ্যে রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসে সে ইঙ্গিত কিছুতেই ধরা পড়িবার কথা নয়।
বাঙলাদেশে আজ জনতত্ত্ব-গবেষণার মাত্র শৈশবাবস্থা। এ কথা অবশ্য সকলেই জানেন, বাঙালী এক সংকর জন(১), কিন্তু কথাটা ঐখানেই শেষ হইয়া যায় না, বরং ঐখানেই কথার আরও । অথচ, কী কী মূল উপাদানের জৈব সমন্বয়ের ফলে বাঙালী আজ এক সংকর জনে পরিণত হইয়াছে, এ কথা কমবেশি নিশ্চয় করিয়া বলিবার মতন যথেষ্ট উপকরণ দেশের সর্বত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত থাকিলেও নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি সেদিকে আজ পর্যন্ত বিশেষ আকৃষ্ট হয় নাই । কেন হয় নাই তাহার কারণ কষ্টবোধ্য না হইলেও এখানে তাহার আলোচনা অবান্তর । বাঙালীর জনতত্ত্ব-নিরূপণ শুধু নৃতাত্ত্বিকের কাজ নয় ; তাহার সঙ্গে ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিকের জ্ঞান ও দৃষ্টির একত্র মিলন না হইলে বাঙালীর জনরহস্য উন্মোচন করা প্রায় অসম্ভব বলিলেই চলে। যে জন যত বেশি সংকর সে জনের ক্ষেত্রে এ কথা তত বেশি প্রযোজ্য ।
বাঙালীর জনতত্ত্ব নিরূপণের একতম এবং প্রধানতম উপায় বাঙলাদেশের আচণ্ডাল সমস্ত বর্ণের এবং সমস্ত শ্রেণীর জনসাধারণের, বিশেষভাবে প্রত্যন্তশায়ী জনপদবাসীদের সকলের রক্ত ও দেহগঠনের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ, এক কথায় নরতত্ত্বের পরিচয় । আমাদের দেশের নৃতত্ত্ব গবেষণায় রক্তবিশ্লেষণ এখনও সাধারণভাবে পণ্ডিতদের দৃষ্টির পরিধির মধ্যে ধরা দেয় নাই । দুই-একজন একটু-আধটু পরীক্ষা আরম্ভ করিয়াছেন মাত্র। দেহগঠনের বিশ্লেষণেরও এ পর্যন্ত যাহা স্বীকৃত ও অনুসৃত হইয়াছে তাহা শুধু নরমুণ্ড, নরকপাল ও নাসিকার পরিমিতি ও পরস্পর অনুপাত, এবং চুল, চোখ ও চামড়ার রং আশ্রয় করিয়া। যুরোপে, বিশেষ করিয়া জার্মানী ও অস্ট্রিয়ায়, গায়ের চামড়ার উপাদানবৈশিষ্ট্য, কেশমূল, কেশবৈশিষ্ট্য, নখবৈশিষ্ট্য, হাত ও পায়ের তালু প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানা গুণ ও বৈশিষ্ট্য লইয়া যে সব আলোচনা হইয়াছে আমাদের দেশের নরতত্ত্ব গবেষণায় আজ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদেও তাহা অল্পই স্থান পাইয়াছে। নরমুণ্ড, কপাল ও নাসিকার পরিমিতি ও পরস্পর অনুপাত বিশ্লেষণ যাহা হইয়াছে তাহাও যথেষ্ট নয়। বহুদিন আগে রিজলি সাহেব বাঙলাদেশের বিভিন্ন স্থানের জনসাধারণের কিয়দংশের পরিমিতি গণনা করিয়াছিলেন ; আজ পর্যন্ত নৃতত্ত্ববিদেরা সাধারণত সেই গণনার উপরই নির্ভর করিয়া আসিয়াছেন । সাম্প্রতিক কালে ফন আইকস্টেডট্র, জে এইচ. হাটন বিরজাশংকর গুহ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, রমাপ্রসাদ চন্দ, শরৎচন্দ্র রায়, হারাণচন্দ্র চাকলাদার, মীনন্দ্রনাথ বসু, তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত কিছু কিছু নূতন পরিমিতি গ্রহণ করিয়াছেন, কিন্তু লোকসংখ্যার অনুপাতে তাহা খুবই অল্প, অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তাহা ছাড়া, যে সব নিদর্শন আহরণ ইহারা করিয়াছেন, সর্বত্র সেগুলির প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করা যায় না, অর্থাৎ সমাজের সকল বর্ণ ও শ্রেণী-স্তরের ও দেশের সকল স্থানের জনসাধারণের মধ্য হইতে নিদর্শন নির্বাচন সর্বত্র যথার্থ ও যথেষ্ট হইয়াছে ; বর্ণ, শ্রেণী ও স্থানের ইতিপরম্পরাগত মূল্য স্বীকৃত হইয়াছে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। তাহা ছাড়া, পরিমিতিগণনায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যে ব্যক্তিগত ভুল থাকার সম্ভাবনা, তাহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তবু, যতটুকু হইয়াছে, যেভাবে হইয়াছে তাহা হইতে কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এবং বাস্তব সভ্যতা ও মানসিক সংস্কৃতি-বিকাশের ইতিহাসের সাহায্যে সেই ইঙ্গিতগুলি ফুটাইয়া তোলা হয়তো অসম্ভব নয়।