ত্রয়োদশ অধ্যায় : শিক্ষাদীক্ষা-জ্ঞানবিজ্ঞান-সাহিত্য
ধর্মকর্ম শিল্পকলার মতো সমাজমানসের অভিব্যক্তি দেখা যায় সমসাময়িক সাহিত্যে, জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষায়। প্রাচীন বাঙলায় ইহাদেরও প্রধান আশ্রয় ধর্মকর্ম, ধর্মবিশ্বাস, সমাজ-সংস্কার ইত্যাদি। এইসব সমস্তই মানসোৎকর্ষের বা অপকর্যের, এক কথায় সংস্কৃতির লক্ষণ সন্দেহ নাই। ইহাদের কতক অংশ গড়িয়া উঠিয়ছিল দৈনন্দিন জীবনচর্যার এবং বৃহত্তম সমাজচর্যার বা অন্য ব্যবহারিক প্রয়োজনে, কতক একান্তই সৃষ্টির প্রেরণায়, বুদ্ধিগত, ভাবকল্পনাগত, চিস্তাগত, অভিজ্ঞতাগত মানসের আত্মপ্রকাশের যে স্বাভাবিক বৃত্তি তাহারই প্রেরণায়। এই আত্মপ্রকাশের রূপ ও রীতি বহুলাংশে সমাজবিন্যাস দ্বারা নিয়মিত হইয়া থাকে। আবার, সমাজবিন্যাসও ইঁহাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এই উভয়ের ঘাতপ্রতিঘাতেই যে শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি যুগে যুগে বিবর্তিত হইতে থাকে, এ তত্ত্ব বর্তমান সমাজতত্ত্বাদর্শে ও আলোচনায় স্বীকৃত। সেইজন্যই প্রাচীন বাঙলার ইতিহাসে ধর্মকর্ম-শিল্পকলার মতো শিক্ষাদীক্ষা-সাহিত্য-বিজ্ঞানের আলোচনাও সমসাময়িক সমাজবিন্যাস ও সমাজমানসের পরিচয় হিসাবেই বেশি, বিশুদ্ধ সাহিত্য বা বিজ্ঞান-মূল্যের দিক হইতে ততটা নয়। এই শিক্ষাদীক্ষা-জ্ঞানবিজ্ঞান-সাহিত্য লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের ত্রয়োদশ অধ্যায়।
চতুর্দশ অধ্যায় : শিল্পকলা
এই ধর্মকর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত প্রাচীন বাঙলার শিল্পকলা, নৃত্যগীত ইত্যাদি। শিল্পই হউক আর নৃত্যগীতই হউক, ইঁহাদের প্রথম ও প্রধান আশ্রয় ছিল ধর্মকর্ম, ধর্মকর্মানুষ্ঠান উপলক্ষেই নৃত্যগীতের প্রচলন হইয়াছিল বেশি; মূর্তি ও মন্দির ইত্যাদি তো একান্তভাবেই ধর্মাশ্রয়ী। রাজপ্রাসাদ অভিজাত বংশীয়দের বাসগুহ ইত্যাদি ইট-কাঠ নির্মিত হইত সন্দেহ নাই; চিত্রে, মূর্তিতে গৃহ সজ্জিত হইত; কিন্তু কাল, প্রকৃতি ও মানুষের ধ্বংসলীলার হাত এড়াইয়া আজ আর তাহাদের চিহ্ন বর্তমান নাই; যে দুই-চারিটি চিহ্ন বহু আয়াসে আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা প্রায় সমস্তই ধর্মকর্মশ্রিত। শিল্পকলা-নৃত্যগীতের দিক হইতে ইহাদের যাহা বিশুদ্ধ শিল্পমূল্য বা সংস্কৃতিমূল্য তাহা তো আছেই। ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে প্রাচীন বাঙলার শিল্পকলার একটি বিশেষ স্থানও আছে। কিন্তু বাঙালীর ইতিহাসে তাহার আলোচনার মূল্য সমাজমানসের দিক হইতেই বেশি; এবং তাহাই মুখ্য। এই শিল্পকলা-নৃত্যগীতের মধ্যে প্রাচীন বাঙালীর মন, তাঁহাদের সমাজবিন্যাস, পরিবেশ সম্বন্ধে তাঁহাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কিভাবে প্রকাশ পাইয়াছে, তাহাই আমাদের প্রধান আলোচ্য | এই আলোচনা লইয়া আমাদের ইতিহাসের চতুর্দশ অধ্যায়।
পঞ্চদশ অধ্যায় : ইতিহাসের ইঙ্গিত
ইতিহাস শুধু তথ্যমাত্র নয়। যে তথ্য কথা বলে না, কার্যকারণ-সম্বন্ধের ইঙ্গিত বহন করে না, যাহার কোনও ব্যঞ্জনা নাই, শুধুই বিচ্ছিন্ন তথ্য মাত্র, যে তথ্য কোনও যুক্তিসূত্রে গ্রথিত নয়, ইতিহাসে তাহার কোনও মূল্য নাই। সমস্ত তথ্যের পশ্চাতে কার্যকারণ-পরম্পরার অমোঘ নিয়ম সর্বদা সক্রিয়। এই নিয়মটি ধরিতে পারা, দেশকালধূত নরনারীর গতি-পরিণতির প্রকৃতিটি ধরিতে পারা, সমাজের প্রবহমান ধারাস্রোতের পশ্চাতের ইঙ্গিতটি জানাই ঐতিহাসিকের কর্তব্য। কার্যকারণপরম্পরায়, যুক্তিশৃঙ্খলায় তথ্যসন্নিবেশ করিয়া যাইতে পারিলে তবেই সেই অমোঘ নিয়মটি, ইঙ্গিত ও প্রকৃতিটি জানা যায়। প্রাণহীন, নীরব, নীরস তথ্য তখন সজীব, মুখর ও সরস হইয়া উঠে। আমার তথ্যসন্নিবেশের মধ্যে ইতিহাসের সেই সজীব মুখরতা পরিস্ফুট হইবে কিনা জানি না; তবু সকল তথ্যের পশ্চাতে বাঙালীর আদি ইতিহাসের গতি-প্রকৃতির একটি সমগ্র ইঙ্গিত আমি মনন-কল্পনার মধ্যে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি। সে ইঙ্গিত আলোচ্য অধ্যায়গুলির স্থানে স্থানে পাওয়া যাইবে, বিশেষভাবে পাওয়া যাইবে রাজবৃত্ত অধ্যায়ে। তবু, সর্বশেষ অধ্যায়ে ইতিহাসের ইঙ্গিতটি একটি অখণ্ড অথচ সংক্ষিপ্ত সমগ্রতায় উপস্থিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি।
৫. নিবেদন
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
পঞ্চম পরিচ্ছেদ । নিবেদন
আমি কোনও নূতন শিলালিপি বা তাম্রপট্টের সন্ধান পাই নাই, কোনও প্রাচীন গ্রন্থের খবর নূতন করিয়া জানি নাই, কোনও নূতন উপাদান আবিষ্কার করি নাই। যে-সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থ বা লেখমালা সংকলিত ও সম্পাদিত হইয়াছে, অথবা সংকলন-সম্পাদনের অপেক্ষা করিতেছে নানা গ্রন্থাগার ও চিত্রশালায়, যে-সমস্ত তথ্য ও উপাদান পণ্ডিতমহলে অল্পবিস্তর পরিচিত ও আলোচিত, প্রায় তাহা হইতেই আমি সমস্ত তথ্য ও উপকরণ আহরণ করিয়াছি। কাজেই পূর্ববর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গবেষকদের সকলের কাছেই আমি ঋণী, বিশেষভাবে ঋণী এই অধ্যায়ের প্রথমেই যে সব মনীষীদের নামোল্লেখ করিয়াছি তাঁহাদের কাছে। এই ঋণ সগৌরবে ঘোষণা করিতে এতটুকু দ্বিধা আমার নাই। ইঁহারা যে কোনও দেশের গৌরব, এবং ইঁহাদেরই অকুণ্ঠ অবারিত দানের ঘোষণা এই গ্রন্থের পত্রে পত্রে ছত্ৰে ছত্রে। এই সমস্ত পূর্বাবিষ্কৃত উপাদান ও পূর্বসূরিদের রচনা আমার সম্মুখে বর্তমান না থাকিলে এই প্রয়াস অসম্ভব হইত। আমি শুধু প্রাচীন বাঙলার ও প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাস একটি নূতন কার্যকারণসম্বন্ধগত যুক্তিপরম্পরায় একটি নূতন দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর দিয়া বাঙালী পাঠকের কাছে উপস্থিত করিতেছি মাত্র। এই যুক্তিপারম্পর্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সমাজবিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক যুক্তি ও দৃষ্টি বলিয়া আধুনিক ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, আমিও করি। আমার বিশ্বাস, এই যুক্তি ও দৃষ্টি অনুসরণ করিলে প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের যে সামগ্রিক গলতোভদ্র রূপ দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা অন্য উপায়ে সম্ভব নয়।