দশম অধ্যায় : রাজবৃত্ত
ধনসম্বল, ভূমিবিন্যাস, বর্ণবিন্যাস, শ্রেণীবিন্যাস, গ্রাম ও নগর-বিন্যাস, রাষ্ট্রবিন্যাস প্রভৃতি সবকিছুর সঙ্গে দেশের ইতিবৃত্তকথা, অর্থাৎ বিভিন্ন পৰ্ব-বিভাগের কথা, রাষ্ট্ৰীয় উত্থান-পতনের কথা, রাজা ও রাজবংশের পরিচয, রাষ্ট্ৰীয় আদর্শের পরিণতি, বিগ্রহ ও বিপ্লব, শান্তি ও সংগ্রাম প্রভৃতির বিবরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজবিন্যাস ও রাষ্ট্রীয় ইতিবৃত্ত একে অন্যকে প্রভাবান্বিত করে, এবং দুইয়ে মিলিয়া ইতিহাসচক্রকে আরর্তিত করে। সেইজন্যই সমাজবিন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসাবে এবং অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসাবে রাজবৃত্ত কথা অবশ্য জ্ঞাতব্য– রাজা এবং রাজবংশের স্থল ও বিস্তৃত বিবরণ হিসাবে নয়, সমাজের সঙ্গে ইঁহাদের এবং বিভিন্ন রাজপর্ব ও রাষ্ট্রাদর্শের সম্বন্ধের দিক হইতে। সেইজন্যই রাজবৃত্তকথা লইয়া এই ইতিহাসের অন্যতম সুদীর্ঘ অধ্যায়।
সর্বশেষে আসিতেছে প্রাচীন বাঙালীর মানস-সংস্কৃতির কথা। সংস্কৃতির প্রয়োজন কী? মানুষ তো শুধু খাইয়া পরিয়া দেহগত জীবনধারণ করিয়া বাচিয়া থাকে না। তাহার একটা মানসগত জীবনও আছে। এই মানসগত জীবন সকল মানুষের সমান নয়। যে শ্রেণী অথবা সমাজের সামাজিক ধনসম্বল যত বেশি সেই শ্রেণী ও সমাজের মানসজীবন তত উন্নত। এই মানসজীবনের প্রকাশই সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি সকল শ্রেণী ও বর্ণের লোকদের এক নয়, এক হইতে পারে না। সংস্কৃতির মূলে আছে কায়িক শ্রম হইতে অবসর; যে শ্রেণী ও বর্ণের সামাজিক ধনসঞ্চয় বা উদকৃত্ত ধন বেশি তাহারাই সেই ধনের বলে এই শ্রেণী ও বর্ণের এবং অন্য শ্রেণী ও অন্য বর্ণের কতকগুলি লোককে ধনোৎপাদনগত কায়িক শ্রম হইতে মুক্তি দিয়া অবসরের সুযোগ দিতে পারে। সেই সুযোগে তাহারা চিন্তা, অধ্যয়ন, শিল্পচর্চা ইত্যাদি করিতে পারেন, এবং তাহারা তাহাদের শ্রেণীগত, নিজস্ব ও বৃহত্তর সমাজগত মানসের চিন্তা, কল্পনা, ভাব ও অনুভাবকে রূপদান করিতে পারেন। প্রাচীন বাঙলায়ও তাঁহাই হইয়াছিল; ইহাই প্রাকৃতিক নিয়ম। যাহাই হউক, প্রাচীন বাঙলায় সংস্কৃতির রূপ আমরা দেখিতে পাই ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে, শিল্পকলায় ও নৃত্যগীতে, জ্ঞানবিজ্ঞানে, ব্যবহারিক অনুশাসন সামাজিক অনুশাসন ইত্যাদিতে। এই সংস্কৃতির অর্ধেক পুরাতন ঐতিহ্যজাত; এই ঐতিহ্যের মধ্যে থাকে জনগত, বর্ণগত রক্তের স্মৃতি, পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির স্মৃতি; বাকি অর্ধেক সমসাময়িক সমাজবিন্যাসের প্রয়োজনে গড়িয়া উঠে। কাজেই অতীতের স্মৃতি ও বর্তমানের প্রয়োজন, এই দুই বস্তুই বিশেষ দেশ ও বিশেষ কালের সংস্কৃতির মধ্যে জড়াজড়ি করিয়া মিশাইয়া থাকে। প্রাচীন বাঙলায় এই সংস্কৃতির স্বরূপটি কী, সত্যকার চেহারাটা কী তাহা জানিবার প্রয়াস লইয়াই আমার বাঙালীর ইতিহাসের শেষ কয়েকটি অধ্যায়। সুস্পষ্ট স্বরূপ হয়তো জানা যাইবে না, জানিবার যথেষ্ট উপাদানও এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয় নাই; তবু চেষ্টা করিতে দোষ নাই, মোটামুটি আভাস একটু পাওয়া যাইবে তো! তাহা ছাড়া, মানস-সংস্কৃতি প্রকাশ পায় নরনারীর দৈনন্দিন জীবনচর্যার ভিতর দিয়া, তাহদের আহার-বিহারে, বসন-বাসনে, আচার-ব্যবহারে। জনসাধারণের জীবনেতিহাস জানিতে হইলে এ সমস্ত বিষয়েরও আলোচনা অপরিহার্য।
একাদশ অধ্যায় : আহার-বিহার, বসন-বাসন, আচার-ব্যবহার, দৈনন্দিন জীবন
জনসাধারণের মানস-সংস্কৃতির পরিচয় শুধু ধর্মকর্ম, শিল্পকলা, সাহিত্য-বিজ্ঞানের মধ্যেই আবদ্ধ হইয়া থাকে না। শিথিলভাবে বলিতে গেলে, ইহারা মানস-সংস্কৃতির পোশাকী দিক : কিন্তু সংস্কৃতির আর-একটা আটপৌরে দিক আছে, এবং সেই দিকটাতেই জনসাধারণের জীবনচর্যার ঘনিষ্ঠতম পরিচয়। আহার-বিহার, বসন-বাসন, আমোদ-আহ্লাদ, দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখ, উৎসব-আচার-ব্যবহার প্রভৃতির মধ্যে এই পরিচয় যেমন পাওয়া যায় এমন আর কোথাও নয়। দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে দিকটা লইয়া জনসাধারণের জীবনেতিহাসের অন্যতম প্রধান, অপরিহার্য এবং অবশ্য জ্ঞাতব্য একাদশ অধ্যায়।
দ্বাদশ অধ্যায় : ধর্মকর্ম
প্রাচীন বাঙালীর মানস-সংস্কৃতির প্রথম ও প্রধান পরিচয় তাহদের ধর্মকর্মে। বিচিত্র ধর্মসংস্কার, বিশ্বাস, পূজা, আচার-অনুষ্ঠান, বারো মাসে তেরো পার্বণ, অসংখ্য দেবদেবী ও অন্যান্য প্রতীক লইয়াই প্রাচীন বাঙালীর জীবন; তাহার দৈনন্দিন জীবনও এইসব লইয়াই একই সঙ্গে মধুর ও দায়িত্বময়। তাহার প্রাগৈতিহাসিক কৌম বিশ্বাস, সংস্কার, পূজা, আচার, অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপর উত্তরকালে ক্রমে ক্রমে জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য প্রভৃতি আর্যধর্মের নানাপ্রকার তান্ত্রিক আচার, পদ্ধতি ও অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রভাব পড়িয়া যে ধর্মবিশ্বাস কর্মানুষ্ঠান প্রভৃতি বিবর্তিত হইয়াছে, তাহার সঙ্গে উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের পার্থক্য প্রচুর। সমাজবিন্যাসের উপরও এইসব বিশ্বাস-অনুষ্ঠানের প্রভাব কম পড়ে নাই। বিশেষ বিশেষ বর্ণ ও শ্রেণীতে বিশেষ বিশেষ দেবদেবীর, বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসের প্রচারের মধ্যেও সমসাময়িক সমাজবিন্যাসের পরিচয় সুস্পষ্ট। ধর্মকর্মের বিবর্তন-ইতিহাসের ভিতর দিয়াও গইন জনসাধারণের জীবনের এবং সমাজবিন্যাসের ইতিহাস উজ্জ্বলতর হয়। সেইজন্য ধর্মকর্মের কথা লইয়া প্রাচীন বাঙালীর ইতিহাসের দ্বাদশ অধ্যায়।