- বইয়ের নামঃ ভূমিকা : বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন রায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০১. ভূমিকা : ইতিহাসের যুক্তি
১. বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
প্রথম পরিচ্ছেদ। বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ
বাঙলার ইতিহাস ও বাঙালীর ইতিহাসে প্রভেদ কোথায় এ কথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয় না। যে বিষয়ের আলোচনার জন্য এই গ্রন্থ, তাহাকে বাঙলার ইতিহাস বলিলে আপত্তি করিবার কিছু নাই; তবু, বাঙালীর ইতিহাস যখন বলিতেছি তখন তাহার কারণ নিশ্চয়ই একটু আছে।
বাঙালীর ইতিহাসের অর্থ
স্বর্গত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ইংরেজি ভাষায় রচিত বাঙলার পাল রাজবংশের কাহিনী এবং তাহার বাঙ্গালার ইতিহাস বহুদিন প্রাচীন বাঙলার প্রামাণিক ইতিহাস বলিয়া গণ্য। কয়েক বৎসর আগে শেষোক্ত গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে; এখনও যে সে গ্রন্থের মূল্য পণ্ডিতমহলে স্বীকৃত ইহাই তাহার প্রমাণ স্বগত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের ‘গৌরাজমালা’ও ঐতিহাসিকের কাছে সুপরিচিত এবং মূল্যবান গ্রন্থ। ‘গৌড়রাজমালা’ প্রকাশিত হইবার পর শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, বিনয়চন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র রায়, রাধাগোবিন্দ বসাক, প্রমোদলাল পাল, স্বগত ননীগোপাল মজুমদার, গিরীন্দ্রমোহন সরকার এবং আরও অনেক প্রখ্যাত পণ্ডিত ও মনীষী প্রাচীন বাঙলার রাজকীয় ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় রচনা করিয়া তুলিয়াছেন। এ কথা স্বীকার করিতেই হয় যে ইঁহাদের এবং অন্যান্য আরও অনেক গবেষকের সম্মিলিত চেষ্টা ও সাধনার ফলে আজ প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস আমাদের কাছে অল্পবিস্তর সুপরিচিত; অন্তত মোটামুটি কাঠামো সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা কিছু নাই। কিন্তু, একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে, আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসরের গবেষণার ফলে, সমবেত চেষ্টার ফলে, প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের যাহা জানিবার সুযোগ হইয়াছে তাহার অধিকাংশই প্রাচীন রাজবংশাবলীর কথা– রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়পরাজয়ের কথা। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি এবং রাজকর্মচারীদের সম্বন্ধে কিছু কিছু সংবাদ জানিবার সুযোগও হইয়াছে। প্রাচীন বাঙলাদেশ সম্বন্ধে যে সমস্ত লেখমালা ও যে কয়েকখানি সাহিত্যগ্রন্থ সম্পাদিত ও প্রকাশিত হইয়াছে তাহা হইতেও এইসব রাজকীয় সংবাদ ছাড়া কিংবা রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতির কথা ছাড়া আর কিছু আহরণ করিবার চেষ্টা কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত বিশেষ কিছু হয় নাই। কোনও কোনও সম্পাদক, যেমন স্বগর্ত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, ননীগোপাল মজুমদার, গঙ্গামোহন লস্কর, পারজিটার, নগেন্দ্রনাথ বসু, লালমোহন বিদ্যানিধি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কীলহর্ন, শ্ৰীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী, রাধাগোবিন্দ বসাক, দীনেশচন্দ্র সরকার, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ পণ্ডিতেরা সমাজ সম্বন্ধেও কিছু কিছু তথ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। কিন্তু এই সমাজ সর্বত্রই বর্ণাশ্রমবদ্ধ সমাজ, এবং তাঁহাদের আহৃত সমাজ-সংবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চতর বর্ণের সমাজ-সংবাদ। এ-যাবৎ সামাজিক অবস্থা বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘সমাজ’ কথাটা অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে, উচ্চতর বর্ণ-সমাজ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; এবং সে সংবাদও অত্যন্ত অপ্রচুর। মোটামুটি ইহাই ছিল কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও বাঙলার ইতিহাসের উপাদান। গ্রন্থাকারে বা প্রবন্ধকারে প্রাচীন বাঙলার যত ইতিহাসাধ্যায় রচিত হইয়াছে তাহতে রাজ্য, রাজা, রাজকর্মচারী, রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি এবং উচ্চতর বর্ণ-সমাজসম্পৃক্ত সংবাদ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। ইহাই আমাদের বাঙলার ইতিহাস।
আরও কিছু আছে। ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্য সম্বন্ধেও আমাদের কিছু কিছু জানিবার সুযোগ আছে। এ বিষয়ে সর্বাগ্রে স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের নাম করিতে হয়। প্রাচীন বাঙলার সাহিত্য এবং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বরূপ সম্বন্ধে তিনিই সর্বপ্রথম আমাদের সজাগ করিয়াছিলেন। তাহার এবং স্বৰ্গত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের প্রদর্শিত পথে শিল্প, সাহিত্য, ভাষা ও ধর্ম-সম্পৃক্ত সংবাদ আহরণ ও আলোচনায় স্বৰ্গত নগেন্দ্রনাথ বসু, গিরীন্দ্রমোহন সরকার, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, শ্ৰীযুক্ত জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সরসীকুমার সরস্বতী, অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, নলিনীনাথ দাশগুপ্ত, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, যোগেশচন্দ্র রায়, শ্রীমতী স্টেলা ক্রামরিশ প্রভৃতি পণ্ডিত ও মনীষীরা নানাদিকে উল্লেখযোগ্য উদ্যম প্রকাশ করিয়া বাঙলার ইতিহাসের সীমা ও পরিধি বিস্তৃত করিয়াছেন। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, ঢাকার সরকারী চিত্রশালা এবং বাঙলার ও বাঙলার বাহিরের অন্যান্য ক্ষুদ্র বৃহৎ সাধারণ ও ব্যক্তিগত প্রত্নবস্তু-সংগ্রহের সহায়তায় প্রাচীন বাঙলার ভাষা ও সাহিত্য, ধর্ম ও শিল্প সম্বন্ধে আজ আমাদের জ্ঞান ও দৃষ্টি অনেকটা সুস্পষ্ট। ইঁহার এবং এইসব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকদের পথ সুগম করিয়াছেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও এ কথা সত্য ছিল যে, কি বাঙলা কি ইংরাজি, কি অপর কোনও ভাষায় প্রাচীন বাঙলার সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপূর্ণ একটা রূপ কেহ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করেন নাই। ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা যাহা জানিতাম তাহার অধিকাংশই বর্ণ-ধর্মের কথা—সে ধর্ম বৌদ্ধই হউক আর পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মই হউক,—সভাশিল্প বা নাগর সমাজের অভিজাত শিল্পের কথা, সংস্কৃত সভা-সাহিত্যের কথা। যে ধর্ম বর্ণাশ্রমীদের, যে শিল্প বা সাহিত্য রাজসভায় বা বিত্তশালী বণিক অথবা গৃহস্থের পোষকতায় পুষ্ট ও লালিত, যে শিল্প বা সাহিত্য বর্ণাশ্রম ধর্মের, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ও শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসন, সাধন-পদ্ধতি এবং লক্ষণদ্বারা শাসিত, সেই ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যের কথাই এ-যাবৎ আমরা পড়িয়া আসিয়াছি। লোকধর্ম, লোকশিল্প, লোকসাহিত্য প্রভৃতি সম্বন্ধে আমরা বহুদিন একেবারে সজাগই ছিলাম না। স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় মাঝে মাঝে আমাদের একটু সজাগ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন মাত্র।