পশ্চিমবঙ্গের খবর পাওয়া যাইতেছে বিজয়সেনের মল্লসারুল লিপি (ষষ্ঠ শতক) এবং জয়নাগের বপ্যঘোষবাট লিপিতে (সপ্তম শতক)। শেষোক্ত লিপিটিদ্বারা মহাপ্রতীহার সূৰ্যসেন বপ্যঘোষবাটনামক একটি গ্রাম ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী নামে এক ব্ৰাক্ষণকে দান করিতেছেন, এই লিপিতেই খবর পাওয়া যাইতেছে কুককুট গ্রামের ব্রাহ্মণদেব ভট্ট উন্মীলন স্বামী এবং প্রবলি স্বামী নামে আরও দুইটি ব্রাহ্মণের দেখা এখানেও মিলিতেছে। এক্ষেত্রেও নাম-পদবী স্বামী। মল্লাসারুল লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, দৈনিক পঞ্চ মহাযজ্ঞ নিম্পন্নের জন্য মহারাজ বিজয়সেন বৎসস্বামীনামক জনৈক ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমি দান করিতেছেন। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে রাঢ় রাষ্ট্রেও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা যষ্ঠ-সপ্তম শতকেই স্বীকৃত ও প্রসারিত হইয়াছে। এই তথ্যের প্রমাণ আর ও পাওয়া যায় সদ্য আবিষ্কৃত শশাঙ্কের মেদিনীপুর লিপি দুইটীতে। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে দণ্ডভূক্তিদেশে ও যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা স্বীকৃত হইয়াছিল তাহা সিদ্ধান্ত করা যায় ইহাদের সাক্ষ্যে।
মধ্য ও পূর্ব বঙ্গেও এই যুগে অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীত হইতেছেন লৌহিত্য তীরবাসী জনৈক কান্বগোত্রীয় ব্রাহ্মণ, ভট্টগোমীদত্ত স্বামী। যে-মণ্ডলে (বারকমণ্ডলে; ফরিদপুর জেলায়) দত্ত ভূমির অবস্থিতি তাহার শাসনকর্তাও ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, তাঁহার নাম বৎসপাল স্বামী। এই বংশের আর এক রাজা ধর্মাদিত্যের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীতা হইতেছেন ব্রাহ্মণ চন্দ্রস্বামী, আর একটির জনৈক বসুদেব স্বামী। শেষোক্ত পট্টোলিতে গর্গস্বামী নামে আর এক ব্রাহ্মণের ভূমিরও খবর পাওয়া যাইতেছে। তখনও বারকমণ্ডলের শাসনকতা একজন ব্ৰাহ্মণ, নাম গোপালস্বামী। ধর্মাদিত্যের প্রথম পট্টোলিটিতে গ্রামবাসিদের মধ্যেও দুইজন ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে বলিয়া মনে হয় একজনের নাম বৃহচ্চট, আর একজনের কুলস্বামী। মহারাজ সমাচার দেবের ঘুগ্রাহাটি লিপির দত্তভূমির দানগ্রহীতা ও একজন ব্রাহ্মণ, নাম সুপ্রতীক স্বামী এবং দান-গ্রহণের উদ্দেশ্য বলিচরুসত্ৰ প্রবতন। যষ্ঠ শতকের ফরিদপুর ছাড়িয়া সপ্তম শতকের ত্রিপুরার লোকনাথ লিপির সাক্ষ্য ও একই প্রকার; এখানে ও দেখিতেছি জনৈক ব্রাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশর্মণ অনন্তনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ২১১ জন চাতুবির্দ্য ব্রাহ্মণের বসতি করাইবার জন্য পশুসংকুল বনপ্রদেশে ভূমিদান গ্রহণ করিতেছেন। গ্রামকুটম্বি অর্থাং গৃহস্থদের মধ্যে শর্মা ও স্বামী পদবীযুক্ত অনেক নাম পাইতেছি, যথা মঘশর্মা, হরিশর্মা, রুষ্টশর্মা, অহিশর্মা, গুপ্তশর্মা, ক্রমশর্মা, শুক্রশর্মা, কৈবর্তশর্মা, হিমশর্মা, লক্ষ্মণশর্মা, নাথশর্মা, অলাতস্বামী, ব্রহ্মস্বামী, মহাসেনভট্টস্বামী, বামনস্বামী, ধনস্বামী, জীবস্বামী, ইত্যাদি।
শুধু যে ব্রাহ্মণেরাই ভূমিদান লাভ করিতেছেন তাহাই নয়; জৈন ও বৌদ্ধ আচার্যরা এবং তাঁহাদের প্রতিষ্ঠানগুলিও অনুরূপ ভূমিদান লাভ করিয়াছেন। পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে পাহাড়পুর অঞ্চলে প্রাপ্ত একটি লিপিতে দেখিতেছি (৪৭৮-৭৯ খ্ৰী) জনৈক ব্রাহ্মণ নাথশর্মা এবং তাহার স্ত্রী রামী এক জৈন আচার্য গুহনন্দির বিহারে দানের জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন। ষষ্ঠ শতকে (গুনাইঘর লিপি, ৫০৭-৮ খ্রী) ত্রিপুরা জেলায় জনৈক মহাযানাচার্য শান্তিদেব প্রতিষ্ঠিত আর্য অবলোকিতেশ্বরের আশ্রম বিহারের মহাযানিক অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘের জন্য মহারাজ রুদ্রদত্ত কিছু ভূমি দান করিতেছেন। এই লিপিটিতেও একজন ব্রাহ্মণ কুমারামাত্য বেরজ্জ স্বামীর সংবাদ পাইতেছি। সপ্তম-অষ্টম শতকে ঢাকা জেলার আস্রফপুর অঞ্চলে দেখিতেছি জনৈক বৌদ্ধ আচার্য বন্দ্য সংঘমিত্র তাঁহার বিহার ইত্যাদির জন্য স্বয়ং রাজার নিকট হইতে প্রচু্র ভূমিদান লাভ করিতেছেন।
০৪.১ ব্রাহ্মণদের পদবী ও গাঞি পরিচয়
উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ হইতে দেখা যাইতেছে শর্মণ ও স্বামী পদবী ছাড়া ব্রাহ্মণদের বোধ হয় অন্য পদবী-পরিচয়ও ছিল। যেমন, বৃহচ্চট নামে চট্ট, ভট্ট গোমিদত্ত স্বামী, ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী, ভট্ট উন্মীলন স্বামী, ভট্ট বামন স্বামী, মহাসেন ভট্ট স্বামী, এবং শ্রীনেত্ৰ ভট (ভট্ট) প্রভৃতি নামে ভট্ট, এবং বন্দ্য জ্ঞানমতি ও বন্দ্য সংঘমিত্র নামে বন্দ্য। বৃহচ্চট্টের চট্ট নামের অংশমাত্র বলিয়া মনে হইতেছে না। ব্রহ্মবীর, উন্মীলন, বামন এবং মহাসেন যে ব্রাহ্মণ তাহা তাহাদের স্বামী পদবীতেই পরিশগকার; কিন্তু তাহার পরেও যখন তাঁহাদের নামের পূর্বে অথবা মধ্যে ভট্ট ব্যবহৃত হইতেছে তখন ভট্ট যেন তাঁহাদের “গাঞি” পরিচয় বলিয়াই মনে হইতেছে। পরবর্তী কালের ভাট অর্থ এই ক্ষেত্রে গ্রহণেযাগ্য বলিয়া মনে হয় না। শ্রীনেত্র ভট স্পষ্টই শ্রীনেত্র ভট্ট এবং এক্ষেত্রে ভট্ট ব্যবহৃত হইয়াছে নামের পরে। বন্দ্য পূজনীয় অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকিতে পারে, অন্ততঃ আচার্য বন্দ্য সংঘ মিত্রের ক্ষেত্রে; কিন্তু বন্দ্য জ্ঞানমতির ক্ষেত্রেও কি তাহাই? এক্ষেত্রেও বন্দ্য “গাঞি” পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। চট্ট, ভট্ট এবং বন্দ্য, এই কটিই যে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অসংখ্য “গাঞি” পরিচয়ের মধ্যে তিনটি, এ-তথ্য পববর্তী স্মৃতি ও কুলজী গ্রন্থে জানা যায়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই এই “গাঞ্চি” পরিচয়ের রীতি প্রচলিত হইয়াছিল, ইহা অসম্ভব এবং অনৈতিহাসিক নাও হইতে পারে।