প্রাথমিক পরাভব ও যোগাযোগের পর বাংলাদেশের এইসব দস্যু ও ম্লেচ্ছ কোমগুলি ধীরে ধীরে আর্যসমাজ ব্যবস্থায় কথঞ্চিৎ স্বীকৃতি ও স্থান লাভ করিতে অরম্ভ করিল। এই স্বীকৃতি ও স্থানলাভ যে একদিনে ঘটে নাই, তাহা তো সহজেই অনুমেয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া একদিকে বিরোধ ও সংঘর্ষ অন্যদিকে স্বীকৃতি ও অন্তর্ভূক্তি চলিয়াছিল— কখনও ধীর শান্ত, কখনও দ্রুত কঠোর প্রবাহে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। রাষ্ট্ৰীয় ও অর্থনৈতিক পরাভব ঘটিয়াছিল আগে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরাভব ঘটিয়াছিল ক্রমে ক্রমে, অনেক পরে, এ সম্বন্ধেও সন্দেহের অবসর কম। মানবধর্মশাস্ত্রে আযাঁবর্তের সীমা দেওয়া হইতেছে পশ্চিম সমূদ্র হইতে পূর্ব সমূদ্র তীর পর্যন্ত, অর্থাং প্রাচীন বাংলাদেশের অন্ততঃ কিয়দংশ আযাঁবর্তের অন্তর্গত, এই যেন ইঙ্গিত।(২৪) মনু পুণ্ড্র, কোমের লোকদের বলিতেছেন ‘ব্রাত্য’ বা পতিত ক্ষত্রিয়, এবং তাগাদের পংক্তিভুক্ত করিতেছেন দ্রাবিড, শক, চীন প্রভৃতি বৈদেশিক জাতিদের সঙ্গে। মভাভারতের সভাপর্বে।(২৫) কিন্তু বঙ্গ ও পুণ্ড্রদের যথার্থ ক্ষত্রিয় বলা হইয়াছে; জৈন প্রজ্ঞাপনা গ্রন্থেও বঙ্গ এবং রাঢ় কোম দুটিকে আর্য কোম বলা হইয়াছে।(২৬) শুধু তাহাই নয়, মহাভারতেই দেখিতেছি, প্রাচীন বাংলার কোনও কোনও স্থান তীর্থ বলিয়া স্বীকৃত ও পরিগণিত হইতেছে, যেমন পুণ্ড্র ভূমিতে করতোয়াতীর, সূহ্মদেশের ভাগীরথী সাগর-সঙ্গম।(২৭) অর্জুন অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের তীর্থস্থানসমূহ পরিভ্রমণকালে ব্রাহ্মণদিগকে নানা প্রকারে উপহৃত করিয়াছিলেন; বাৎস্যায়ন তাঁহার কামসূত্রে (৩য়-৪র্থ শতক) গৌড়-বঙ্গের ব্রাহ্মণদের উল্লেখ করিয়াছেন। অর্থাৎ বাংলা এবং বাঙালীর আর্যীকরণ ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছে, ইহাই এইসব পুরাণকথার ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতের সমর্থন পাওয়া যায় মভাভারত ও পুরাণগুলিতে। বায়ু ও মংস্যপুরাণে, মহাভারতে বঙ্গ, সূহ্ম, পুণ্ড্রদের তো ক্ষত্ৰিয়ই বলা হইয়াছে, এমন কি শবর, পুলিন্দ এবং কিরাতদেরও। (২৮) কোনও কোনও বংশ যে ব্রাহ্মণ পর্যায়েও স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হইয়াছিল, ঋষি দীর্ঘতমসের গল্পটি তাহার কতকট প্রমাণ বহন করে। অধিকাংশ বিজিত লোকই স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হইয়াছিল শূদ্রবর্ণ পর্যায়ে, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই। মনু বলিতেছেন, পৌণ্ড্রক ও কিরাতেরা ক্ষত্রিয় ছিল, কিন্তু বহুদিন তাহার ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংস্পর্শে না আসায় তাহারা ব্রাহ্মণ্য পুজাচার প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়াছিল, এবং সেই হেতু তাহাদের শূদ্র পর্যায়ে নামাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। (২৯) অন্যান্য কোমদের ক্ষেত্রেও বোধ হয় এইরূপ হইয়া থাকিবে। মনু কৈবর্তদদের বলিয়াছেন সংকর বর্ণ, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ তাহাদের বলিতেছে “অব্রহ্মণ্য,” অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজ বহির্ভূত। কিন্তু একদিকে স্বীকৃতি অন্তর্ভূক্তি এবং আর একদিকে উন্নীত অবনীতকরণ যাহাই চলিতে থাকুক না কেন, এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আর্য বর্ণবিন্যাসও বাংলা দেশে ক্রমশঃ তাহার মূল প্রতিষ্ঠিত করিতেছিল। শুধু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরাই যে আর্য সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা বাংলাদেশে বহন করিয়া আনিয়াছিলেন তাহাই নয়, জৈন ও বৌদ্ধধমাবলম্বীরাও এ-সম্বন্ধে সমান কৃতিত্বের দাবি করিতে পারেন। তাঁহারা বেদবিরোধী ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু আর্য সমাজ-ব্যবস্থা বিরোধী ছিলেন না, এবং বর্ণব্যবস্থাও একেবারে অস্বীকার করেন নাই।(৩০)
মৌর্য ও শুঙ্গাধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে এবং তাহাকে আশ্রয় করিয়া আর্য সংস্কৃতি সমাজব্যবস্থা ক্রমশঃ বাংলাদেশে অধিকতর প্রসার লাভ করিয়াছিল সন্দেহ নাই, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ্যধররমাবলম্বী রাষ্ট্রের আদিপত্যকালে। কিন্তু, মহাস্থান লিপির গলদন পুরাদস্তুর বাংলা নাম বলিয়াই মনে হইতেছে; প্রাকৃত গলদনকে সংস্কৃত গলদন বলিলেও তাহার দেশজ রূপ অপরিবর্তিতই থাকিয়া যায়। লিপিটির ভাষা প্রাকৃত; মৌর্য আমলের সবলিপির ভাষাই ত তাহাই; কিন্তু বঙ্গে যে আর্য সামাজিক আদর্শ গৃহীত ও স্বীকৃত হইতেছিল তাই সুস্পষ্ট। বোধ হয় এই সময় হইতেই ব্যবসা-বাণিজ্য, ধৰ্ম প্রচার, রাষ্ট্রধর্ম প্রভৃতিকে আশ্রয় করিয়া অধিকতর সংখ্যায় উত্তর ভারতীয় আর্যভাষীরা বাংলাদেশে আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিতে থাকে। কিন্তু আর্য, বৌদ্ধ, জৈন এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা গুপ্তকালের আগে হইয়া ছিল বলিয়া মনে হয় না, এবং আর্য বৰ্ণব্যবস্থা ও বাংলাদেশে বোধ হয় তাহার আগে দানা বাঁধিয়া গড়িয়া উঠে নাই।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জনপদ গুপ্তসাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী সমাজ উত্তরভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থান অন্তর্ভূক্ত হইতে আরম্ভ করে। এই যুগের লিপিমালাই(৩১) তাহার নিঃসংশয় সাক্ষ্য বহন করিতেছে। লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিলে অনেকগুলি তথ্য জানা যায়।
———————
(১৪) দৃষ্টান্তস্বরূপ দ্রষ্টব্য, Census Report of India, 1931., vol. I, part I, Section on Caste.
(১৫) ঐতরেয় আরণ্যক ২.১.১; Aita. Ara., ed. Keith, 101, 200.
(১৬) ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৭৷১৩-১৮
(১৭) মহাভারত, সভাপর্ব, ৫২৷১৭; বায়ু পুরাণ, ৯৯৷১১৷৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮৷৭৭…
(১৮) মহাভারত, ২।৩০; ভাগবতপুরাণ, ২৪।৪।১৮
(১৯) বোধায়ন, ১।১।২৫-৩১
(২০) আচারঙ্গ সূত্র ১।৮।৩ , S. B. E. XXII. 84, 264
(২১) Ed. Ganapati Sastri, ২২ পটল, পৃ. ২৩২-৩৩
(২২) রামায়ণ, ২।১০।৩৬-৩৭
(২৩) মহাভারত, সভাপর্ব ৫২৷১৭; বায়ুপুরাণ ৯৯৷১১।৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।৭৭…
(২8) মানবধর্মশাস্ত্র,
(২৫) ৫২।১৭
(২৬) lnd. Ant. p. 375
(২৭) বনপর্ব ৮৫।২-৪, ১।২১৬, কামসূত্র, ৬।৩৮, ৪১
(২৮) মহাভারত, ১।১০৪, ২।৫১, ১৪।২৯, বিষ্ণুপুরাণ, ৪।৮।১; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।১।৪, মনুস্মৃতি, ১০।৪৪।
(২৯) মনুস্মৃতি, ১০।৪৪
(৩০) Rhys Davids, Buddhist India.
(৩১) এই পর্বে যে-সমস্ত লিপি হইতে তথ্য সংগৃহীত হইয়াছে তাহার তালিকা ও সূচীর জন্য পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
০৪.০ গুপ্ত পর্বের বর্ণ বিন্যাস
প্রথমেই সংবাদ পাওয়া যাইতেছে অগণিত ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানের। ১ নং দামোদরপুর লিপিতে (খ্ৰীষ্টাব্দ ৪৪৩-৪৪) জনৈক কর্পটিকনামীয় ব্রাহ্মণ অগ্নিহোত্র যজ্ঞকাৰ্য সম্পাদনের জন্য ভূমিক্রয় প্রার্থন করিতেছেন; ২ নং পট্টোলি দ্বা্রা (৪৪৮-৪৯) পঞ্চ মহাযজ্ঞেব জন্য আর এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দেওয়া হইতেছে; ধনাইদহ পট্টোলির (৪৩২-৩৩) বলে কটকনিবাসী এক ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ কিছু ভূমি লাভ করিতেছেন; ৩ নং দামোদরপুর পট্টোলিতে (৪৮২-৮৩) পাইতেছি নাভক নামে এক ব্যক্তি কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বসাইবার জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৪ নং দামোদরপুর লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, নগরশ্রেষ্ঠ রিভূপাল হিমালয়ের পাদদেশে ডোঙ্গাগ্রামে কোকামুখস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী এবং নামলিঙ্গের পূজা ও সেবার জন্য ভূমিক্রয় করিতেছেন; বৈগ্রাম পট্টোলির (৪৪৭-৪৮) সংবাদ, ভোয়িল এবং ভাস্কর নামে দুই ভাই গোবিন্দস্বামীর নিত্য পূজার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৫ নং দামোদর পট্টোলিতে (৫৪৩-৪৪) দেখিতেছি শ্বেতবরাহস্বামীর মন্দির সংস্কারের জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন অযোধ্যাবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব। এ সমস্ত লিপিই পুণ্ড্র বর্ধনভূক্তির অন্তর্গত ভূমি সম্বন্ধীয়। এই অনুমান নিঃসংশয় যে পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্ম স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে, এই ধর্মের দেবদেবীরা পূজিত হইতেছেন, ব্রাহ্মণদের বসবাস বিস্তত হইতেছে, অব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করিতেছেন, আনিয়া বসবাস করাইতেছেন, এবং অযোধ্যাবাসী ভিন-প্রদেশী আসিয়াও এইদেশে মন্দির সংস্কার করাইবার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন। যে সব ব্রাহ্মণেরা অসিতেছেন তাহাদের মধ্যে বেদবিদ ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণও আছেন। উত্তরবঙ্গের সংবাদ বোধ হয় আরও পাওয়া যায় কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের নিধনপুর লিপিতে। লিপিটি সপ্তম শতকের, পট্টোলি কর্ণসুবর্ণ জয়স্কান্ধাবার হইতে নির্গত; দত্তভূমি চন্দ্রপুরি বিষয়ের ময়ূরশান্মলাগ্রহার ক্ষেত্র, এবং এই ভূমিদানকার্য ভাস্করের চারি পুরুষ পূর্বে বুদ্ধপ্রপিতামহ ভূতিবর্মণদ্বারা (আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের প্রথম পাদ) প্রথম সম্পাদিত হইয়াছিল। চন্দ্রপুরি বিষয় বা ময়ূরশাল্মল অগ্রহার কোথায় তাহা আজও নিঃসংশয়ে নির্ণীত হয় নাই; তবে উত্তরবঙ্গের পূর্বতন সীমায় (রংপুর জেলায়) কিংবা একেবারে শ্রীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড (লিপির আবিষ্কার স্থান) অঞ্চল, এ দুয়ের এক জায়গায় হওয়াই সম্ভব, যদিও রংপুর অঞ্চল হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয়। যাহাই হউক, এই লিপিতে দেখা যাইতেছে ময়ূরশাল্মল অগ্রহারে ভূতিবর্মণ ভিন্ন ভিন্ন বেদের ৫৬টি বিভিন্ন গোত্রীয় অন্তত ২০৫ জন ‘বৈদিক’ বা ‘সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণের বসতি করাইয়াছিলেন। ব্রাহ্মণের সকলেই বাজসনেয়ী, ছান্দোগ্য, বাহ্বৃচ্য, চারক্য এবং তৈত্তিরীয়, এই পাঁচটি বেদ-পরিচয়ের অন্তর্গত, তবে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী-পরিচয়ের সংখ্যাই অধিক। চারক্য এবং তৈত্তিরীয়েরাও যজুর্বেদীয়; বাহ্বৃচ্য ঋগ্বেদীয়; ছান্দোগ্য সামবেদীয়। ইঁহাদের অধিকাংশের পদবী স্বামী। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই উত্তরপূর্ব-বাংলায় (ভিন্ন মতে, শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে) পুরাদস্তুর ব্রাহ্মণ-সমাজ গড়িয়া উঠিয়াছে। পূর্বোক্ত অন্যান্য লিপির সাক্ষ্যও তাহাই। ভূমি দান-বিক্রয় যে সব গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নিম্পন্ন হইতেছে তাহদের মধ্যে অনেক ব্রাহ্মণের দর্শন মিলিতেছে; ইঁহাদের নামপদবী শর্মণ এবং স্বামী দুইই পাওয়া যাইতেছে।