ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থের “বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা’ এই পদে কেহ কেহ বঙ্গ, মগধ, চের এবং পাণ্ড্য কোমের উল্লেখ আছে বলিয়া মনে করেন; এই সব কোমকে বলা হইয়াছে ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষী-বিশেষাঃ’, এবং ইহারা যে আর্য-সংস্কৃতির বহির্ভূত তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে।(১৫) এই পদটির পাঠ ও ব্যাখ্যা এইভাবে হইতে পারে কিনা এ সম্বন্ধে মতভেদের অবসর বিদ্যমান। কিন্তু ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পুণ্ড্র, প্রভৃতি জনপদের লোকদিগের যে ‘দস্যু’ বলা হইয়াছে এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোন কারণ নাই। এই দুইটি ছাড়া আর কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থেই প্রাচীন বাংলার কোনও কোমের উল্লেখ নাই। বুঝা যাইতেছে, সেই সুপ্রাচীন কালে আর্যভাষীরা তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচিতই হন নাই; পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থাদি রচনার সময় তাহারা পুণ্ড্র, বঙ্গ, ইত্যাদি কোমের নাম শুনিতেছেন মাত্র। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের একটি গল্প এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ঋষি বিশ্বামিত্র একটি ব্রাহ্মণ বালককে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করেন—দেবতার প্রীত্যর্থে যজ্ঞে বালকটিকে আহুতি দিবাব আয়োজন হইয়াছিল, সেইখান হইতে বিশ্বামিত্র তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিয়াছিলেন। যাহা হউক, পিতার এই পোষ্যপুত্র গ্রহণ বিশ্বামিত্রের পঞ্চাশটি পুত্রের সমর্থন লাভ করেন নাই। ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র পুত্রদের অভিসম্পাত দেন যে তাঁহাদের সন্তানেরা যে উত্তরাধিকার লাভ করিবে তাহা একেবারে পৃথিবীর প্রান্ততম সীমায় (বিকল্পে : তাঁহাদের বংশধরেরা একেবারে সব নিম্ন বর্ণ প্রাপ্ত হইবেন)। ইহারাই ‘দস্যু’ আখ্যাত অন্ধ্র, পুণ্ড্র, শবর, পুলিন্দ, এবং মুতিব কোমের জন্মদাত।(১৬) এই গল্পের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মহাভারতের এবং কতিপয় পুরাণের একটা গল্পেও শুনিতে পাওয়া যায়।(১৭) অন্যত্র ভীমের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বাংলার সমুদ্রতীরবাসী কোমগুলিকে বলা হইয়াছে ‘ম্লেচ্ছ’; ভাগবত পুরাণে কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুক্কস, আভীর, যবন, থস এবং সূহ্ম কোমের লোকদের বলা হইয়াছে ‘পাপ’।(১৮) বৌধায়নেব ধৰ্মসূত্রে আবট্ট (পাঞ্জাব), পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ) সৌবীর (দক্ষিণ পঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ), বঙ্গ (পূর্ব বাংলা), কলিঙ্গ (উড়িষ্যা) প্রভৃতি কোমের লোকদের অবস্থিতি নির্দেশ করা হইয়াছে আর্যবহির্ভূত দেশের প্রত্যন্ততম সীমায়; ইহাদের বলা হইয়াছে “সংকীর্ণ যৌনয়ঃ” এবং এই সব দেশ একেবারে আর্য-সংস্কৃতির বাহিরে, এই সব জনপদে কেহ স্বল্প কালের প্রবাসে গেলেও ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত।(১৯) স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, বৌধায়নের কালে বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় যদি বা হইয়াছে, যাতায়াতও হয়ত কিছু কিছু আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু তখনও আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কারের দৃষ্টিতে এই সব অঞ্চলের লোকেরা ঘৃণিত এবং অবজ্ঞাত। এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রাচীন আর্য জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতেও কিছু কিছু দেখা যায়। আচাবঙ্গ = আয়ারঙ্গ সূত্রের একটি গল্পে পথহীন রাঢ়দেশে মহাবীর এবং তাহার শিষ্যদের লাঞ্ছনা ও উৎপীড়নের যে-বর্ণনা আছে, বজ্রভূমিতে যে অখাদ্য কুখাদ্য ভক্ষণের ইঙ্গিত আছে তাহাতে এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা সুম্পষ্ট।(২০) বৌদ্ধ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-গন্থে গৌড়, পুণ্ড্র, সমতট ও হরিকেলের লোকদের ভাষাকে বলা হইয়াছে ‘অসুর’ ভাষা এই সব বিচিত্র উল্লেখ হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, ইহা্রা এমন একটি সুদীর্ঘকালের স্মৃতি-ঐতিহ্য বহন করে যে-কালে আর্য ভাষাভাষী এবং আর্যসংস্কৃতির ধারক ও বাহক উত্তর ও মধ্যভারতের লোকে বা পূর্বতম ভারতের বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সূহ্ম প্রভৃতি কোমদের সঙ্গে পরিচিত ছিল না, যে-কালে এইসব কোমদের ভাষা ছিল ভিন্নতর, আচার-ব্যবহার অন্যতর। এই অন্যতর জাতি, অন্যতর আচার-ব্যবহার, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং অন্যতর ভাষাভাষী লোকদের সেইজন্যই বিজেতা, উন্নত ও পরাক্রান্ততর জাতিসুলভ দর্পিত উন্নাসিকতায় বলা হইয়াছে, ‘দস্যু’, ‘ম্রেচ্ছ’, ‘পাপ’, ‘অসুর’ ইত্যাদি।
কিন্তু এই দর্পিত উন্নাসিকতা বহুকাল স্থায়ী হয় নাই। নানা বিরোধ সংঘর্ষের ভিতর দিয়া এই সব দস্যু, ম্লেচ্ছ, অসুর, পাপ কোমের লোকদেব সসে আর্যভাষাভাষী লোকদের মেলামেশা হইতে ছিল। এই সব বিরোধ সংঘর্ষের কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত নানা পৌরাণিক গল্পে—রামায়ণে রঘুর দিগ্বিজয়, মহাভারতে কর্ণ, কৃষ্ণ ও ভীমের দিগ্বিজয়, আচারঙ্গসূত্রে মহাবীরের রাঢ়দেশে জৈনধৰ্ম প্রচার, ইতাদি প্রসঙ্গে। ইহাদের মধ্য দিয়াই আর্য ও আর্যপূর্ব সংস্কৃতির মিলনপথ প্রশস্ত হইতেছিল এবং আর্যপূর্ব সংস্কৃতির ‘ম্রেচ্ছ’ ও ‘দস্যু’রা আর্যসমাজে স্বীকৃতি লাভ করিতেছিল। এই স্বীকৃতি লাভ ও আর্যসমাজে অন্তর্ভূক্তির দুইটি দৃষ্টান্ত আহরণ করা যাইতে পারে। রামায়ণে দেখা যাইতেছে,(২২) মৎস্য-কাশী-কোশল কোমেব সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ-অঙ্গ-মগধ কোমের রাজবংশগুলি অযোধ্যা রাজবংশের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইতেছেন। ইহাপেক্ষা ও আর একটি অর্থবহ গল্প আছে বায়ু ও মৎস্যপুরাণে, মহাভারতে। এই গল্পে অসুররাজ বলির স্ত্রীর গর্ভে বৃদ্ধ অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমসের পাঁচটি পুত্র উৎপাদনের কথা বর্ণিত আছে; এই পাঁচপুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সূহ্ম; ইহাদের নাম হইতেই পাঁচ পাঁচটি কৌম জনপদের নামের উদ্ভব।(২৩)