কুলজী গ্রন্থগুলিতে নানা প্রকার গালগল্প ও বিচিত্র অসংগতি ত আছেই। সাম্প্রতিক পণ্ডিতেরা তাহা সমস্তই অঙ্গুলি নির্দেশে দেখাইয়া দিয়াছেন। আমি শুধু কয়েকটি ঐতিহাসিক যুক্তি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করিলাম। এইসব কারণে কুলশাস্ত্রের সাক্ষ্য ঐতিহাসিক আলোচনায় নির্ভরযোগ্য বলিয়া মনে হয় না। তবে ইহাদের ভিতর দিয়া লোকস্মৃতির একটি ঐতিহাসিক ইঙ্গিত প্রত্যক্ষ করা যায়, এবং সে-ইঙ্গিত অস্বীকার করা কঠিন। পঞ্চদশ-ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে যে বর্ণ, উপবর্ণ সমাজ-ব্যবস্থা, যে-স্মৃতিশাসন বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল তাহার একটা প্রাচীনতর ইতিহাস ছিল, এবং লোকস্মৃতি সেই ইতিহাসকে যুক্ত করিয়াছিল শূর, সেন ও বর্মণ রাজবংশগুলির সঙ্গে—পাল, চন্দ্র বা অন্য কোনও রাজবংশের সঙ্গে নয়, ইহা লক্ষণীয়। আমরা নি:সংশয়ে জানি সেন ও বর্মণ বংশদ্বয় অবাঙালী; শূরবংশও সম্ভবত অবাঙালী; ইহাও আমরা জানি সেন এবং বর্মণ রাষ্ট্র ও রাজবংশ দুটির ছত্রছায়ায়ই এবং তাঁহাদের আমলেই বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহাব-শাসন, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুশাসন সমস্ত পরিবেশ ও বাতাবরণ, সমস্ত খুঁটিনাটি সংস্কার লইয়া সর্বব্যাপী প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুলজীগ্রন্থগুলির ইঙ্গিতও তাহাই। এই হিসাবে লোকস্মৃতি মিথ্যাচরণ করিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে না। দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও বংশের প্রাচীনতর ইতিহাস পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বিদ্যমান ছিল বলিয়া মনে হয়, এবং কুলজী গ্রন্থাদিতে তাহা ব্যবহৃতও হইয়াছে। এই রকম কয়েকটি বংশের সাক্ষ্য স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বারা সমর্থনও করা যায়।(১১) কুলজীগ্রন্থে রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক ও গ্রহবিপ্র, ব্রাহ্মণদের এই চারি পর্যায়ের বিভাগ ও স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বার সমর্থিত। কুলশাস্ত্রগ্রন্থমালায় ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন শাখার বিচিত্র গাঞীর বিভাগের অন্তত কযেকটি গাঞীর নাম লিপিমালায় এবং সমসাময়িক স্মৃতিসাহিত্য গ্রন্থে পাওয়া যায়।(১২) এইসব কারণে মনে হয়, কুলজীগ্রন্থমালার পশ্চাতে একটা অস্পষ্ট লোকস্থতি বিদ্যমান ছিল, এবং এই লোকস্মৃতি একেবারে পুরোপুরি মিথ্যাচার নয়। তবে, কুলশাস্ত্রগুলির ঐতিহাসিক ইঙ্গিতটুকু মাত্রষ্ঠ গ্রাহ, তাহাদের বিচিত্র খুঁটিনাটি তথ্য ও বিবরণগুলি নয়।
চর্যাগীতি
এই সব ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থাদি ছাড়া আর একটি উপাদানের উল্লেখ করিতে হয়; এই উপাদান সহজিয়াতন্ত্রের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি গ্রন্থ, চযাঁচর্যবিনিশ্চয় বা চযাঁগীতি। এই গ্রন্থ বিভিন্ন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কর্তৃক গুহা তান্ত্রিক সাধনা সম্বন্ধীয় সন্ধাভাষায় রচিত কয়েকটি (৫০টি) পদের সমষ্টি। পদ গুলি প্রাচীনতম বাংলা ভাষার নিদর্শন; ইহাদের তিব্বতী ভাষারূপও কিছুদিন হইল পাওয়া গিয়াছে। যাহাই হউক, ইহাদের রচনার কাল দশম হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বলিয়া বহুদিন পণ্ডিতসমাজে স্বীকৃত হইয়াছে। এই পদ গুলির যত গুহ্য অর্থই থাকুক, কিছু কিছু সমাজসংবাদও ইহাদের মধ্যে ধরা পড়িয়াছে, এবং বিশেষভাবে ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি তথাকথিত অন্ত্যজ পর্যায়ের বর্ণসংবাদ। সমসাময়িক সাক্ষ্য হিসাবে ইহাদের মূল্য অস্বীকার করা যায় না।(১৩)
—————————-
(১) বৃহদ্ধর্মপুরাণ, Bib. Ind. edn; বঙ্গবাসী মুদ্রাযন্ত্র প্রকাশিত একটি সংস্করণও বিদ্যমান। উত্তরখণ্ডের ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়ে এবং অন্ত খণ্ডের ইতস্তত বর্ণসংবাদ বিক্ষিপ্ত। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, জীবানন্দ বিন্যাসাগর সং। প্রথমভাগে ব্রহ্মখণ্ডের দশম অধ্যায়ের ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৭ শ্লোকে বর্ণবিন্যাস-সংবাদ নিবদ্ধ।
(২) ভারতবর্ষ মাসিকপত্র, ১৩৩৬-৩৭, ২য় খণ্ড, ৬৭৩ পৃ., ১৩৩৭ ৩৮, ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃ.। History of Bengal, I., D. U. : pp. 5’7-574, Paul, P. C., Early History of Bengal Vol. II, 59-61.
(৩) ২নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য।(৪) Vallala-Charita, ed. Haraprasad Sastri, Asiatic Society of Bengal. 1904.
(৫) Vallala-Charita, ed. by Harischandra Kaviratna, 1889.
(৬) Intro. to the English trans. of the Vallalacharita by Haraprasad Sastri, pp. v.-vi.; Ep. Ind. XV, p. 281; যতীন্দ্রমোহন রায়, ঢাকা।
(৭) H B (D.V.), I, pp. 239-4 I
(৮) Chanda, R. P., Indo-Aryan Races, Chap. V.
(৯) ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৬, কাতিক—ফাল্গুন, “বঙ্গীয় কুলশাস্ত্রের 3\fa <ifa 35 5[a] “; HB (D U.), pp. 623-34
(১০) Majumdar, R. C., “An Indigenous History of Bongal,” ln Proc, of the Ind, Hist. Records Commission, XVI, 59 ff.
(১১) History of Bengal, (D. U.), pp. 630 31, footnotes.
(১২) lbid., pp. 635-37 and footnotes
১৩ বৌদ্ধ গান ও দোহা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সং, বঙ্গীয় সাহিত পরিষৎ, Md. Sahidullah Buddhist Mystic Songs; Bagchi, P. C., Materials for a Critical Edition of the Caryapadas; চযাঁপদ, মণীন্দ্রমোহন বসু সং, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
০৩. আর্যীকরণের সূচনা : বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্ব
বাঙালীর ইতিহাসের যে অস্পষ্ট ঊষাকালের কথা আমরা জানি তাহা হইতে বুঝা যায়, আর্যীকরণের সূচনার আগে এই দেশ অষ্ট্রিক ও দ্রাবিডভাষাভাষী—অষ্ট্রিক ভাষাভাষীই অধিকসংখ্যক,— খুব স্বল্পসংখ্যক অন্যান্য ভাষাভাষী, কৃষি ও শিকারিজীবি, গৃহ ও অরণ্যচারী, অসংখ্য কোমে বিভক্ত লোকদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। সাম্প্রতিক নৃতাত্বিক গবেষণায় এই তথ্য উদঘাটিত হইয়াছে যে এইসব অসংখ্য বিচিত্র কোমদের ভিতর বিবাহ ও আহার-বিহারগত সম ও আচারগত নানাপ্রকার বিধিনিষেধ বিদ্যমান ছিল; এবং এই সব বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করিয়া বিচিত্র কোমগুলির পরস্পবের ভিতর যৌন ও আহারবিহার সম্বন্ধগত বিভেদ-প্রাচীরেরও অন্ত ছিল না।(১৪) পরবর্তী আর্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসেব মূল অনেকাংশে এইসব যৌন ও আহার-বিহার সঙ্গন্ধগত বিধিনিষেধকে আশ্রয় করিয়াছে, তাহা প্রায় অনস্বীকার্য; তবে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি গুণ ও কর্মকে ভিত্তি করিয়া তাহাদের চিন্তা ও আদর্শানুযায়ী এইসব বিধিনিষেধকে ক্রমে ক্রমে কালানুযায়ী প্রয়োজনে যুক্তি ও পদ্ধতিতে প্রথাশাসনগত করিয়া গডিয়াছে, তাড়াও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সমাজ ও নৃতাত্বিক গবেষণাব নির্ধারণানুযায়ী বিচার করিলে ভারতীয় বর্ণবিন্যাস আর্যপূর্ব ও আর্য্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির সম্মিলিত প্রকাশ। অবশ্যই এই মিলন একদিনে হয় নাই; বহু শতাব্দীর নানা বিরোধ, নানা সংগ্রাম, বিচিত্র মিলন ও আদানপ্রদানের মধ্য দিয়া এই সমন্বয় সম্ভব হইয়াছে। এই সমন্বয়-কাহিনীই এক হিসাবে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির এবং কতকাংশে ভারতীয় মুসলমান সংস্কৃতিরও ইতিহাস। যাহাই হউক, বাংলা দেশে এই বিরোধ-মিলনসমন্বয়েব সূচনা কি ভাবে হইয়াছিল তাহার কিছু কিছু আভাস প্রাচীন আর্য ব্রাহ্মণ্য ও আর্য-বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এই সব গ্রন্থের সাক্ষ্য এক পক্ষীয়, এবং তা হাতে পক্ষপাত দোষ নাই এমনও বলা চলে না; আর্যপূর্ব জাতি ও কোমদের পক্ষ হইতে সাক্ষ্য দিবার মতন কোনও অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত নাই। তাহা ছাড়া, বাংলা দেশ উত্তর-ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ; আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির স্পর্শ ও প্রভাব এদেশকে আক্রমণ করিয়াছে সকলের পরে, তখন তাহা উত্তর-ভারতের আর প্রায় সবত্রই বিজয়ী, সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিমান। অন্যদিকে, তখন সমগ্র বাংলা দেশে আর্য পূর্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিসম্পন্ন বিচিত্র কোমদের বাস; তাহারাও কম শক্তিমান নয়। তাহাদের নিজস্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিবোধ গভীর ও ব্যাপক। কাজেই এইদেশে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিজয়াভিযান বিনা বিরোধ ও বিনা সংঘর্ষে সম্পন্ন হয় নাই। বহু শতাব্দী ধরিয়া এই বিরোধ-সংঘর্ষ চলিয়াছিল, ইহা যেমন স্বভাবতই অনুমান করা চলে, তেমনিই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারাও তাহা সমর্থিত। লিপি প্রমাণ হইতে মনে হয়, গুপ্ত আমলে আর্য-ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাস, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এদেশে সম্যক স্বীকৃতই হয় নাই। তাহার পরেও ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের নিম্নস্তরে ও তাই বি বাহিরে সংস্কার ও সংস্কৃতির সংঘর্ষ বহুদিন চলিয়াছিল; সেন-বর্মণ আমলে (একাদশ-দ্বাদশ শতকে) বর্ণসমাজের উচ্চস্তরে আর্যপূর্ব লোক সংস্কৃতিব পরাভব প্রায় সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু তাহা সত্বেও বাঙালী সমাজের অন্তঃপুরে এবং একান্ত নিম্নস্তরে এই সংস্কার ও সংস্কৃতির প্রভাব আজও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই—ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের আদেশ সেখানে শিথিল দৈনন্দিন জীবনে, ধর্মে, লোকাচারে, ব্যবহারিক আদর্শে, ভাবনা-কল্পনায় আজও সেখানে আর্যপূর্ব সমাজের বিচিত্র স্মৃতি ও অভ্যাস সুস্পষ্ট। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে শিল্পে, ধর্মে বতর্মান বাঙালীর ধ্যানে মননে আচারে ব্যবহারে এখনও সেই স্মৃতি বহমান, একথা কখনও ভুলিলে চলিবে না।