একটি ক্ষত্ৰিয়বর্ণ প্রধান রাজপুরুষের নাম বোধ হয় পাওয়া যাইতেছে। ধর্মপালের খালিমপুরলিপিতে; ইনি মহাসামন্তাধিপতি নারায়ণবর্মা। এই সামন্ত নরপতিটি যেন অবাঙালী বলিয়াই মনে হইতেছে। কিছু কিছু বণিকের নাম পাইতেছি, যেমন বণিক লোকদত্ত, বণিক বুদ্ধমিত্র; নামাংশ বা পদবী দেখিয়া মনে হয়, ইহারা পরবর্তীকালের ‘ভদ্র’, সংকরবর্ণীয়, বৃত্তি অবশ্যই বৈশ্যের; কিন্তু রাষ্ট্রে বর্ণ হিসাবে বা শ্রেণী হিসাবে ইহাদের কোনও প্রাধান্য নাই। কারণ কায়স্থদের প্রভাব ব্রাহ্মণদের প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয় না হইলেও খুব কম ছিল না। রামচরিত-রচিয়তা সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন করণদের মধ্যে অগ্রণী এবং রামপালের কালে পালরাষ্ট্রের সান্ধিবিগ্রহিক। আর এক করণ-শ্রেষ্ঠ শব্দপ্রদীপ গ্রন্থের রচয়িতা; তিনি স্বয়ং, তাহার পিতা ও পিতামহ সকলেই ছিলেন রাজবৈদ্য; দুইজন পাল-রাজসভার, একজন চন্দ্র-রাজসভার। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে ধর্মাধিকার-পদাভিষিক্ত জনৈক শ্ৰীগোনন্দন এবং মদনপালের মনহলি-লিপিতে সান্ধিবিগ্রহিক দূতক জনৈক ভীমদেবের সংবাদ পাইতেছি; ইঁহারাও করণ-কায়স্থকুলসম্ভূত বলিয়া মনে হইতেছে। কৈবর্ত দিব্য বিদ্রোহী হইবার আগে পাল রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান রাজপুরুষ বা সামন্ত ছিলেন, সে কথা তো আগেই একাধিকবার বলা হইয়াছে। সামন্ত নরপতিদের মধ্যেও করণ-কায়স্থদের দর্শন মিলিতেছে। ত্রিপুরা পট্টেলীর মহারাজা লোকনাথ নিজেই ছিলেন করণ। কিন্তু করণদের প্রভাব পাল রাষ্ট্রের যতই থাকুক, ঠিক আগেকার পর্বের মতন আর নাই। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতকের রাষ্ট্রে সর্বত্রই যেন ছিল করণ-কায়স্থদের প্রভাব, অন্তত নামাংশ বা পদবী হইতে তাহাই মনে হয়। পাল-চন্দ্ৰ পর্বে ঠিক ততটা প্রভাব নাই; পরিবর্তে ব্ৰাহ্মণ প্রভাব বর্ধমান।
কম্বোজ-সেনা-বর্মণ পর্বের রাষ্ট্রে এই ব্ৰাহ্মণ প্রভাব ক্রমশ বাড়িয়াই গিয়াছে। ভবদেব ভট্ট ও হলায়ূধের বংশের কথা পূর্বেই একাধিকবার উল্লেখ করিয়াছি; এখানে পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। একাধিক পুরুষ ব্যাপিয়া সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রে এ দুই পরিবারের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। তাহা ছাড়া, অনিরুদ্ধ ভট্টের মতো ব্ৰাহ্মণ রাজগুরুদের প্রভাবও কিছু কম ছিল না। অধিকন্তু, প্রভৃতিরও প্রভাব এই পর্বের রাষ্ট্রগুলিতে সুপ্রচুর, এবং ইহারা সকলেই ব্ৰাহ্মণ। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য প্রভাবের পরিচয় বিশেষভাবে কিছু পাওয়া যাইতেছে না; বরং বল্লাল-চরিত, বৃহদ্ধর্ম ও ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণের বর্ণতালিকা হইতে মনে হয়, শিল্পী ও ব্যবসায়ী শ্রেণীভুক্ত অনেক বর্ণ রাষ্ট্রের অকৃপাদৃষ্টি লাভ করিয়া সমাজে নামিয়া গিয়াছিল। বণিক-ব্যবসায়ীদের প্রতি সেন-রাষ্ট্র বোধ হয় খুব প্রসন্ন ছিল না। একমাত্র বিজয়সেনের দেবপাড়া-লিপিতে পাইতেছি বারেন্দ্র-শিল্পগোষ্ঠীচূড়ামণি শূলপাণিকে পাইতেছি বণিক সামন্তরূপে। বৈদ্যদের প্রভাব-পরিচয়ের অন্তত একটি দৃষ্টান্ত আমাদের জানা আছে; বৈদ্যবংশ-প্ৰদীপ বনমালীকর রাজা ঈশান দেবের পট্টনিক বা মন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু সংবাদটি বঙ্গের পূর্বতম অঞ্চল শ্ৰীহট্ট হইতে পাওয়া যাইতেছে যেখানে আজও বৈদ্য-কায়ন্থে বৰ্ণ-পার্থক্য খুব সুস্পষ্ট নয়। একই অঞ্চলে দেখিতেছি, দাস-কৃষিজীবীরা রাজকর্মচারী এবং সভাকবিও হইতেন। কিন্তু ব্ৰাহ্মণদের পরেই রাষ্ট্রে যাঁহাদের প্রভাব সক্রিয় ছিল তাহারা কারণ-কায়স্থ; ইহাদের প্রভাব হিন্দু আমলে কখনও একেবারে ক্ষুন্ন হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; কারণ-কায়স্থদের বর্ণগত বৃত্তিই বোধ হয় তাহার কারণ। সেন-রাজসভার কবিদের মধ্যে অন্তত একজন করণ-কায়স্থ উপবর্ণের লোক ছিলেন বলিয়া মনে হয়; তিনি উমাপতিধর। মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধচিন্তামণি-গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক হইলে স্বীকার করিতে হয়, উমাপতি লক্ষ্মণসেনের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন। সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের সংকলয়িতা কবি শ্ৰীধরদাসও বোধ হয় কারণ-কায়স্থ ছিলেন; শ্ৰীধর নিজে ছিলেন মহামাণ্ডলিক, তাঁহার পিতা বটুদাস ছিলেন মহাসামন্তচূড়ামণি। বিজয়সেনের বারাকপুর-লিপির দূত শালাড্ডনাগ, বল্লালসেনের সান্ধিবিগ্রহিক হরিঘোষ, লক্ষ্মণসেনের মহাসান্ধিবিগ্রহিক নারায়ণদত্ত, এই রাজারই অন্যতম প্রধান রাজকর্মচারী শঙ্করধর, বিশ্বরূপসেনের সান্ধিবিগ্রহিক নাঞী সিংহ এবং কোপিবিষ্ণু, ইত্যাদি সকলকেই করণ-কায়স্থ বলিয়াই মনে হইতেছে। লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি ধোয়ী কিন্তু ছিলেন তন্তুবায়; তন্তুবায়-কুবিন্দকেরা উত্তম-সংকর বা সৎশুদ্র পর্যায়ের লোক, একথা স্মরণীয়।
রাষ্ট্রে বিভিন্ন বর্ণের প্রভাবের মোটামুটি যে-পরিচয় পাওয়া গেল তাহা হইতে অনুমান হয়, ব্ৰাহ্মণ ও করণ-কায়স্থদের প্রভাব-প্রতিপত্তিই সকলের চেয়ে বেশি ছিল। কারণ-কায়স্থদের প্রভাবের কারণ সহজেই অনুমেয়; ভূমির মাপ-প্রমাপ, হিসাবপত্র রক্ষণাবেক্ষণ, পুস্তপালের কাজকর্ম, দপ্তর ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ, লেখকের কাজ প্রভৃতি ছিল ইহাদের বৃত্তি। স্বভাবতই, তাঁহারা রাষ্ট্রে এই বৃত্তিপালনের যতটা সুযোগ পাইতেন অন্যত্র তাহা সম্ভব হইত না। কাজেই এক্ষেত্রে বর্ণ ও শ্রেণী প্রায় সমার্থক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ব্ৰাহ্মণদের ক্ষেত্রে তাহা বলা চলে না; ইহারা বৃত্তিসীমা অতিক্ৰম করিয়াই মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ, ধর্মধ্যক্ষ, সান্ধিবিগ্রহিক ইত্যাদি পদ অধিকার করিতেন। রাজগুরু, রাজপণ্ডিত, পুরোহিত, শান্ত্যাগারিক ইত্যাদিরা অবশ্যই নিজেদের বৃত্তিসীমা রক্ষা করিয়া চলিতেন, বলা যাইতে পারে। কোন সামাজিক রীতিক্রমানুযায়ী ব্ৰাহ্মণের রাষ্ট্রে প্রভুত্ব বিস্তার করিতে পারিয়াছিলেন তাহা তো আগেই বলিয়াছি। বৈশ্যাবৃত্তিধারী বর্ণ-উপবর্ণ সম্বন্ধে বলা যায়, যতদিন শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের অবস্থা উন্নত ছিল, ধনোৎপাদনের প্রধান উপায় ছিল শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য, ততদিন রাষ্ট্রেও তঁহাদের প্রভাব অনস্বীকার্য ছিল, কিন্তু একাধিক প্রসঙ্গে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, সপ্তম শতকের পরে ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার কমিয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রেও বৈশ্যবৃত্তিধারী লোকেদের প্রভাব কমিয়া যাইতে থাকে। পাল-রাষ্ট্রেই তাহার চিহ্ন সুস্পষ্ট। বল্লাল-চরিতের ইঙ্গিত সত্য হইলে সেন-রাষ্ট্র র্তাহাদের প্রতি সক্রিয়ভাবে অপ্রসন্নই ছিল। তাহা ছাড়া, বৃহদ্ধর্ম-ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণও সে-ইঙ্গিত সমর্থন করে। রাষ্ট্রে ইহাদের প্রভাব থাকিলে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে ইঁহারা এতটা অবজ্ঞাত, অবহেলিত হইতে পারিতেন না।