কাহিনীটির ঐতিহাসিক যাথার্থ্য স্বীকাব করা কঠিন; কিন্তু ইহাকে একেবারে অলীক কল্পনাগত উপন্যাস বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া আরও কঠিন। গ্রন্থদুটিকেও ‘জাল’ বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান নাই। সেনবংশ ‘ব্রহ্মক্ষত্ৰ’ বংশ; বল্লাল সেন কলিঙ্গরাজ চোড়গঙ্গের বন্ধু ছিলেন (সমসাময়িক তাহারা ছিলেনই); বল্লালের সমযে কীকটমগধ পালবংশের করায়ত্ত ছিল এবং তাহার আমলেই পালবংশের অবসান হইয়াছিল; বল্লাল মিথিলায় সমরাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন— বল্লালচরিতের এই সব তথ্য অন্যান্য স্বতন্ত্র সুবিদিত নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। এই সব হেতু দেখাইয়া কোনও কোনও ঐতিহাসিক যথার্থই বলিয়াছেন, বল্লালচরিত ‘জাল’ গ্রন্থ নয়, এবং ইহার কাহিনী একেবারে ঔপন্যাসিকও নয়। তাহাদের মতে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে প্রচলিত লোক-কাহিনীর উপর নির্ভর করিয়া বল্লালচরিত এবং এই জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল; কেহ কেহ ইহাও মনে করেন যে “The Vallala charità contains the distorted echo of an internal disruption caused by the partisans of the Pāla dynasty which proved an important factor in the collapse of the Sena rule in Bengal.” এই মত সর্বথা নির্ভরযোগ্য।(৭) তবে, এই কাহিনীকে যতটা বিকৃত প্রতিধ্বনি বলিয়া মনে করা হয় আমি ততটা বিকৃত বলিয়া মনে করি না। আমরা জানি কৈবর্তরা পালরাষ্ট্রের প্রতি খুব প্রসন্ন ছিলেন না, একবার তাঁহারা বিদ্রোহী হইয়া এক পালরাজাকে হত্যা করিয়া বরেন্দ্রী বহুদিন তাঁহাদের করায়ত্তে রাখিয়াছিলেন। কাজেই সেই কৈবর্তদের প্রসন্ন করা এবং তাঁহাদের হাতে রাখিতে চেষ্টা করা বল্লালের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষত মগধের পালদের সঙ্গে শত্রুতা যখন তাঁহাদের ছিলই। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতে সেন-রাষ্ট্রেব সামাজিক আদশের, স্মৃতি ও পুরাণ গ্রন্থাদিতে সমসাময়িক সমাজ-বিন্যাসের যে পরিচয় আমরা পাই তাহাতে স্পষ্টই মনে হয় সমাজে বণিকদের স্থান খুব শ্লাঘ্য ছিল না। বৃহদ্ধর্মপুরাণে তাঁতী, গন্ধবণিক, কর্মকার, তৌলিক, (সুপারি ব্যবসায়ী), কুমার, শাঁখারী, কাঁসারী, বারজীবী (বারুই), মোদক, মালাকার সকলকে উত্তম সংকর পর্যায়ে গণ্য করা হইয়াছে, অথচ স্বর্ণকার-সুবর্ণবণিকেরা ধীবর-রজকের সঙ্গে জল-অচল মধ্যম সংকর পর্যায়ে। ইহার তো কোনও যুক্তিসংগত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বল্লালচরিতে এ সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা পাওয়া যাইতেছে তাহাতে একটা যুক্তি আছে; রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক কারণে এইরূপ হওয়া খুব বিচিত্র নয়। ইহাকে একেবারে উড়াইয়া দেওয়া যায় কি? সেন-বর্মণ আমলে এইরূপ পর্যায় নির্ণয় যে হইয়াছে স্মৃতিগ্রন্থগুলিই তাহার সাক্ষ্য। লোকস্মৃতি এক্ষেত্রে একেবারে মিথ্যাচরণ করিয়াছে, এমন মনে হইতেছে না। বল্লালচরিত-কাহিনী একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হইলেও ইহার মূলে যে একটি ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কারণ দেখিতেছি না।
কুলজীগ্রন্থমালা
বল্লালচরিতের ঐতিহাসিক ভিত্তি কিছুটা স্বীকার করা গেলেও কুলজী গ্রন্থের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করা অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশে কুলজী গ্রন্থমালা সুপরিচিত, সুআলোচিত। ব্রাহ্মণ-কুলজীগ্রন্থমালায় ধ্রুবানন্দ মিশ্রের মহাবংশাবলী বা মিশ্র গ্রন্থ, নুলো পঞ্চাননের গোষ্ঠকথা, বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম, ধনঞ্জয়ের কুলপ্রদীপ, মেলপনায় গণনা, বারেন্দ্র কুলপঞ্জিকা, কুলার্ণব, হরিমিশ্রের কারিক, এডু মিশ্রের কাবিকা, মহেশের নির্দোষ কুলপঞ্জিকা এবং সর্বানন্দ মিশ্রের কুলতত্বার্ণব প্রভৃতি গ্রন্থ সমধিক প্রসিদ্ধ। ধ্রুবানন্দের মহাবংশাবলী পঞ্চদশ শতকের রচনা বলিয়া অনুমিত; মুলে পঞ্চানন এবং বাচস্পতি মিশ্রের গ্রন্থের কাল ষোড়শ-সপ্তদশ শতক হইতে পারে। বাকি কুলজীগ্রন্থ সমস্তই অর্বাচীন। বস্তুত, কোন কুলজী গ্রন্থেরই রচনাকাল পঞ্চদশ শতকের আগে নয়; অধিকাংশ কুলজীগ্রন্থ এখনও পাণ্ডুলিপি আকারেই পড়িয়া আছে, এবং নানা উদ্দেশ্যে নানা জনে ইহাদের পাঠ অদলবদলও করিয়াছেন, এমন প্রমাণও পাওয়া গিযাছে। বৈদ্য-কুলজী গ্রন্থের মধ্যে রামকান্তের কবিকণ্ঠহার এবং ভরত মল্লিকের চন্দ্র প্রভা সমধিক খ্যাত; ইহাদের রচনাকাল যথাক্রমে ১৬৫৩ ও ১৬৭৩ খ্ৰীষ্টাব্দ। কাযস্থ এবং অন্যান্য বর্ণেরও কুলজী ইতিহাস পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি কিছুতেই সপ্তদশঅষ্টাদশ শতকের আগেকার রচনা বলিয়া মনে করা যায় না। উনবিংশ শতকের শেষপাদ হইতে আরম্ভ করিয়া একান্ত আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলা দেশের অনেক পণ্ডিত এই সব পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত কুলজীগ্রন্থ অবলম্বন করিয়া বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করিয়াছেন, এবং এখনও অনেক কৌলীন্য মযাঁদাগর্বিত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বংশ এই সব কুলজীগ্রন্থের সাক্ষ্যের উপরই নিজেদের বংশমযাঁদ প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন। বস্তুত, বাংলার কৌলীন্যপ্রথা একমাত্র এই কুলশাস্ত্র বা কুলজী গ্রন্থমালার সাক্ষ্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত।
একান্ত সাম্প্রতিক কালে উচ্চশ্রেণীর সামাজিক মযাঁদা যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাহাকে আঘাত করা অত্যন্ত কঠিন। নানা কারণেই ঐতিহাসিকের এই সব কুলজীগ্রন্থমালার সাক্ষ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতিতে আলোচনার বিষয়ীভূত করেন নাই, যদিও অনেকে তাঁহাদের সন্দেহ ব্যক্ত করিতে দ্বিধা করেন নাই। ইহাদের ঐতিহাসিক মূল্য প্রথম বিচার করেন স্বৰ্গত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়।(৮) খুব সাম্প্রতিক কালে শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় এই সব কুলজীগ্রন্থের বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিচার করিয়াছেন; তাহার সুদীর্ঘ বিচারালোচনার যুক্তিবত্তা অবশ্যস্বীকার্য।(৯) কাজেই এখানে একই আলোচনা পুনরুত্থাপন করিয়া লাভ নাই। আমি শুধু মোটামুটি নির্ধারণগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি মাত্র।