ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে (পূর্ব) বঙ্গেও এই একই অবস্থা দেখিতেছি। শুধু সুবর্ণবীথি অন্তর্গত বারকমণ্ডলের বিষয়াধিনিযুক্তক ব্যক্তিদের মধ্যে দুইবার দুইজনের নাম পাইতেছি, গোপালস্বামী ও বৎসপালস্বামী। এই দুইজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, সন্দেহ নাই। জ্যেষ্ঠ কায়স্থ পুস্তপাল ইত্যাদির নামের মধ্যে পাইতেছি বিনয়সেন, নয়ভূতি, বিজয়সেন, পুরদাস ইত্যাদিকে; ইহারা অব্রাহ্মণ, তাহাতেও সন্দেহ নাই।
অর্থাৎ, সপ্তম শতক পর্যন্তও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের কোনও প্রাধান্য দেখা যাইতেছে না; বরং পরবর্তীকালে যাঁহারা কারণ-কায়স্থ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য ইত্যাদি সংকর শূদ্ৰবৰ্ণ বলিয়া গণ্য হইয়াছেন তাহাদের প্রাধান্যই দেখিতেছি। বেশি, বিশেষভাবে করণ-কায়স্থদের। শ্রেণী হিসাবে শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর প্রাধান্যও যথেষ্ট দেখা যাইতেছে; বর্ণ হিসাবে ইহারা বৈশ্যবর্ণ বলিয়া গণিত হইতেন কিনা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। বৈশ্য বলিয়া কোথাও ইঁহাদের দাবি সমসাময়িক কালে বা পরবর্তীকালেও কোথাও দেখিতেছি না, এইটুকুই মাত্র বলা যায়। অনুমান হয়, পরবর্তীকালে যে-সব শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী শূদ্র উত্তম ও মধ্যম সংকর বর্ণ পর্যায়ভুক্ত বলিয়া পাইতেছি, তাঁহারাই এই যুগে শ্রেষ্ঠী, সার্থিবাহ, কুলিক ইত্যাদির বৃত্তি অনুসরণ করিতেন। বুঝা যাইতেছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ্য বৰ্ণব্যবস্থা বিস্তৃতি লাভ করিলেও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণেরা এখনও প্রাধান্য লাভ করিতে পারেন নাই; তাহারা সম্ভবত এখনও নিজেদের বর্ণনুযায়ী বৃত্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। অন্যান্য বর্ণের লোকেদের সম্পর্কে মোটামুটি বলা যায় যে, তাঁহারাও নিজেদের নির্দিষ্ট বৃত্তিসীমা অতিক্রম করেন নাই। রাষ্ট্রে করণ-কায়স্থদের প্রতিপত্তি বৃত্তিগত স্বাভাবিক কারণেই; শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তির কারণ অর্থনৈতিক। শেষোক্ত কারণের ব্যাখ্যা অন্যান্য প্রসঙ্গে একাধিকবার করিয়াছি।
কিন্তু, ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও বর্ণ-ব্যবস্থার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, রাষ্ট্রের সক্রিয় পোষকতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ক্রমশ ব্রাহ্মণের প্রতিপত্তিশীল হইয়া উঠিতে আরম্ভ করেন; ভূমিদান অর্থদান ইত্যাদি কৃপালাভের ফলে অনেক ব্ৰাহ্মণ ক্রমশ ব্যক্তিগতভাবে ধনসম্পদের অধিকারীও হইতে থাকেন। এই সামাজিক প্রতিপত্তি রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হইতে বিলম্ব হয় নাই। কারণ-কায়স্থেরাও রাজসরকারের চাকুরি করিয়া রাষ্ট্রের কৃপালাভে বঞ্চিত হয় নাই; গ্রামে, বিষয়াধিকরণে, ভুক্তির রাষ্ট্রকেন্দ্রে সর্বত্র যাঁহারা মহত্তর, কুটুম্ব ইত্যাদি বলিয়া গণ্য হইতেছেন, রাজকার্যে সহায়তার জন্য যাহারা আহুত হইতেছেন, তাহাদের মধ্যে করণ-কায়স্থ এবং অন্যান্য ‘ভদ্র’ বর্ণের লোকই সংখ্যায়। বেশি বলিয়া মনে হইতেছে। প্রচুর ভূমির অধিকারী রূপে, শিল্প-ব্যবসায়ে অর্জিত ধনবলে, সমাজের সংস্কার, সংস্কৃতি ও বর্ণ-ব্যবস্থার নায়করূপে যে সব বর্ণ সমাজে প্রতিপত্তিশীল হইয়া উঠিতেছেন তাহারা রাষ্ট্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হইবেন, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। রাষ্ট্রেরও স্বার্থে হইল সেই সব প্রতিপত্তিশীল বর্ণ বা বর্ণসমূহকে সমর্থকরূপে নিজের সঙ্গে যুক্ত রাখা।
সাধারণতঃ অধিকাংশ লোকই নিজেদের বর্ণবৃত্তি অনুশীলন করিতেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই সত্য, কিন্তু ব্যক্তিগত রুচি, প্রভাব-প্রতিপত্তি কামনা, অর্থনৈতিক প্রেরণা ইত্যাদির ফলে প্রত্যেক বর্ণেরই কিছু কিছু লোক বৃত্তি পরিবর্তন করিত, তাহাও সত্য। স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতে যে নির্দেশই থাকুক বাস্তবজীবনে দৃঢ়বদ্ধ রীতিনিয়ম সর্বদা অনুসৃত যে হইত না তাহার প্রমাণ অসংখ্য লিপি ও সমসাময়িক গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। পাল-চন্দ্র এবং সেনা-বর্মণ আমলে যথেষ্ট ব্ৰাহ্মণ রাজা, সামন্ত, মন্ত্রী, ধর্মাধ্যক্ষ, সৈন্য-সেনাপতি, রাজকর্মচারী, কৃষিজীবী ইত্যাদির বৃত্তি অবলম্বন করিতেছেন; অম্বষ্ঠ বৈদ্যেরা মন্ত্রী হইতেছেন; দাসজীবীরা রাজকর্মচারী, সভাকবি ইত্যাদি হইতেছেন, করণ-কায়স্থেরা সৈনিকবৃত্তি, চিকিৎসাবৃত্তি ইত্যাদি অনুসরণ করিতেছেন; কৈবৰ্তরা রাজকর্মচারী ও রাজ্যশাসক হইতেছেন; এ ধরনের দৃষ্টান্ত অষ্টম হইতে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত অনবরতই পাওয়া যাইতেছে।
পাল রাষ্ট্রযন্ত্র বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় রাষ্ট্র ও সমাজপদ্ধতির পূর্বোক্ত রীতিক্রম সুস্পষ্ট ও সক্রিয়। প্রথমেই দেখিতেছি, রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের প্রভাব ও আধিপত্য বাড়িয়াছে। দ্বিজশ্রেষ্ঠ শ্ৰীদর্ভপাণি, পৌত্র কেদারমিশ্র ও প্রপৌত্র গুরবমিশ্র রাজা ধৰ্মপালের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া পর পর চারিজন পালসম্রাটের অধীনে পালরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কত করিয়াছিলেন। ইহারা প্রত্যেকেই ছিলেন বেদবিদ পরমশাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিত এবং সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যবিশারদ ও রাজনীতিকুশল। আর একটি ব্রাহ্মণ বংশের— শাস্ত্রবিদশ্রেষ্ঠ যোগদেব, পুত্র তত্ত্ববোধভূ বোধিদেব এবং তৎপুত্র বৈদ্যদেব— এই তিনজন যথাক্রমে তৃতীয় বিগ্রহপাল, রামপাল এবং কুমারপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই পরিবারও পাণ্ডিত্যে, শাস্ত্ৰজ্ঞানে, এক কথায় ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতিতে যেমন কুশলী ছিলেন তেমনই ছিলেন রাজনীতি ও রণনীতিতে। নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপির দূতক ভট্ট গুরব ব্রাহ্মণ ছিলেন, সন্দেহ নাই। প্রথম মহীপালের বাণগড়-লিপির দূতক ছিলেন ভট্ট শ্ৰীবামন মন্ত্রী, ইনিও অন্যতম প্রধান রাজপুরুষ সন্দেহ নাই। এই রাজার রাজগুরু ছিলেন শ্ৰীবামরাশি; ইনি বোধ হয় একজন শৈব সন্ন্যাসী ছিলেন। বৌদ্ধরাজার লিপি “ওঁ নমো বুদ্ধায়” বলিয়া আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু প্রথম দুই শ্লোকেই বলা হইতেছে, “সরসীসদৃশ বারাণসী ধামে, চরণাবনত-নৃপতি-মস্তকাবস্থিত কেশপাশ সংস্পর্শে শৈবালাকীর্ণরূপে প্ৰতিভাত শ্ৰীবামরাশি নামক গুরুদেবের পাদপদ্মের আরাধনা করিয়া, গৌড়াধিপ মহীপাল [যাঁহাদিগের দ্বারা] ঈশান-চিত্ৰঘণ্টাদি শতকীর্তিরত্ন নির্মাণ করাইয়াছিলেন–”। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন “চিত্রাঘণ্টেশী” নবদুর্গার একতম রূপ; কাজেই, ঈশান চিত্ৰঘণ্টাদি অর্থে নবদুর্গার বিভিন্ন রূপ সূচিত হইয়া থাকা অসম্ভব নয়। শ্ৰীবামরাশি নামটিও যেন শৈব বা শাক্ত লক্ষণের সূচক।