দ্বিজবৰ্ণ (এবং বোধ হয় উচ্চ জাতের শূদ্রবর্ণের মধ্যেও) সপিণ্ড, সগোত্র এবং সমানপ্রবারের বিবাহই সাধারণত প্রচলিত ছিল; ভবদেব ভট্টের সম্বন্ধ-বিবেক গ্রন্থে তাহার উপর বেশ জোরই দেওয়া হইয়াছে। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য এবং প্রজাপত্য বিবাহে কন্যা বরের মায়ের দিক হইতে পঞ্চম পুরুষের মধ্যে কিংবা পিতার দিক হইতে সপ্তম পুরুষের মধ্যে হইলে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বার এবং কন্যা সগোত্র কিংবা সপ্রবারের হইলেও বিবাহ হইতে পারিত না। আসুর, গান্ধৰ্ব, রাক্ষস এবং পৈশাচ বিবাহে কন্যা বরের মায়ের দিক হইতে তিন পুরুষ, কিংবা পিতার দিক হইতে পঞ্চম পুরুষের বাহিরে হইলে বিবাহ হইতে পারিত, কিন্তু তাঁহারা সমাজে শূদ্র পর্যায়ে পতিত বলিয়া গণ্য হইতেন।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ হইতে বুঝা যায়, এইসব বর্ণগত বিধি-নিষেধ সাধারণত ব্ৰাহ্মণের সম্বন্ধেই সবিশেষ প্রযোজ্য ছিল এবং তাহাও ব্রাহ্মণের সঙ্গে নিম্নতর এবং বিশেষ ভাবে নিম্নতম বর্ণের আহার-বিহার-বিবাহ ব্যাপারে যোগাযোগ সম্বন্ধে। কালক্রমে এইসব বিধি-নিষেধই সামাজিক আভিজাত্যের মাপকাঠি হইয়া দাঁড়ায় এবং বৃহত্তর সমাজে বিস্তৃত হইয়া অন্যান্য বর্ণ ও জাতের মধ্যেও স্বীকৃতি লাভ করে। শেষ পর্বে আসিয়া যে-অবস্থায় দাড়াইয়াছে তাহা তো সাম্প্রতিককালে বাঙালী হিন্দুসমাজে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। যাহা হউক, সমসাময়িক স্মৃতিগ্রন্থে সেনা-বর্মণ-দেবী আমলের বর্ণগত বিধি-নিষেধের যে-চিত্র দৃষ্টিগোচর হইতেছে তাহাতে স্পষ্টই দেখা যায়, এই সময়ই ব্ৰাহ্মণেরা বৃহত্তর সমাজের অন্যান্য বর্ণ ও জাত হইতে প্রায় পৃথক ও বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিলেন। এক প্রান্তে মুষ্টিমেয় ব্ৰাহ্মণ সম্প্রদায়, অন্য প্রান্তে স্বাঙ্গীকৃত ও স্বাঙ্গাক্রিয়মান, স্পর্শচ্যুত, অধিকারলেশহীন। অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়, আর মধ্যস্থলে বৃহৎ শূদ্ৰ সম্প্রদায়। প্রত্যেকের মধ্যে দৃঢ় ও দুরতিক্রম্য প্রাচীর। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ও নানা ভৌগোলিক এবং অন্যান্য বিভেদ-প্রাচীরে বিভক্ত, আহার-বিহার-বিবাহ ব্যাপারে নানা বিধি-নিষেধের সূত্রে দৃঢ় করিয়া বাধা; যোগাযোগের বাধাও বিচিত্র। বৃহৎ শূদ্র সম্প্রদায়ও নানা জাতে নানা স্তরে বিভক্ত, এবং প্রত্যেক স্তর দৃঢ় ও দুর্লঙ্ঘ্য সীমায় সীমিত। অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ পর্যায় তো একান্তই রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টির বাহিরে।
ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণের উল্লেখ ভবদেব ভট্ট, জীমূতবাহন ও অন্যান্য স্মৃতিকারেরা বারবার করিয়াছেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহা একান্তই ঐতিহ্য-সংস্কারগত উল্লেখ বলিয়া মনে হয়—উত্তর-ভারতীয় প্রাচীনতর স্মৃতিকথিত বর্ণ-বিন্যাসের প্রথাগত অনুকরণ। পূর্বতন কালে অথবা বাঙলার আদি স্মৃতিগ্রন্থগুলির সমসাময়িক কালে এই অঞ্চলে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের উপস্থিতির কোনও নিঃসংশয় সাক্ষ্য আজও আমরা জানি না।
প্রাচীন বাঙলায় বর্ণ-বিন্যাসের পরিণতির কথা বলিতে গিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের History of Bengali Vol. I-গ্রন্থে একটি উক্তি করা হইয়াছে; উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য।
“An important factor in the evolution of this final stage is the growing fiction that almost all non-Brahmanas were Sudras. The origin of this fiction is perhaps to be traced to the extended significance given to the term Sudra in the Puranas, where it denotes not only the members of the fourth caste, but also those members of the three higher castes who accepted any of the heretical religions or were influenced by Tantric rites. The predominance of Buddhism and Tantric Saktism in Bengal as compared with other parts of India, since the eighth century A. D. perhaps explains why all the notable castes in Bengal were degraded in the Brihad-dharma Puranas and other texts as Sudras and the story of Vena and Pritha might be mere echo of a large scale re-conversion of the Buddhists and Tantric elements of the population into the orthodox Brahmanical fold.” (p. 578).
২৯. বর্ণ ও রাষ্ট্র
বিভিন্ন পর্বে বর্ণ-বিন্যাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণের সম্বন্ধের কথা না বলিয়া বর্ণ-বিন্যাস প্রসঙ্গ শেষ করা উচিত হইবে না।
বাঙলাদেশে গুপ্তাধিপত্যের আগে এই সম্বন্ধের কোনও কথাই বলিবার উপায় নাই; তথ্যই অনুপস্থিত। গুপ্তাধিকারের কালে ভুক্তির রাষ্ট্রযন্ত্রে অথবা বিষয়াধিকরণে কিংবা স্থানীয় অন্য রাষ্ট্রাধিকরণের কর্তৃপক্ষদের মধ্যে যাঁহাদের নামের তালিকা পাইতেছি তাঁহাদের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ প্রায় নাই বলিলেই চলে। ভুক্তিপতি বা উপরিকদের মধ্যে যাঁহাদের দেখা মিলিতেছে তাঁহারা কেহ চিরাতদত্ত, কেহ ব্রহ্মদত্ত, কেহ জয়দত্ত, কেহ রুদ্রদত্ত, কেহ কুলবৃদ্ধি ইত্যাদি; ইঁহাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলিয়া মনে হয় না। বিষয়াপতিরা বা তৎস্থানীয়রা কেহ বেত্ৰিবৰ্মণ, কেহ স্বয়ম্ভুদেব, কেহ শণ্ডক; ইহাদের মধ্যে বেত্ৰিবৰ্মণ ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি করিতে পারেন; স্বয়ম্ভুদেব সম্বন্ধে কিছু বলা কঠিন, ব্ৰাহ্মণ হইলে হইতেও বা পারেন; শশুক যে অব্রাহ্মণ এ-অনুমান সহজেই করা চলে। তারপরেই নিঃসন্দেহে যাঁহারা রাজকর্মচারী তাঁহারা হইতেছেন পুস্তপাল এবং জ্যেষ্ঠ বা প্রথম কায়স্থ। ইঁহাদের কাহারও নাম শাম্বপাল, কাহারও কাহারও নাম দিবাকরানন্দী, পত্ৰদাস, দুর্গাদত্ত, অর্কদাস, করণ-কায়স্থ নরদত্ত, স্কন্দপাল ইত্যাদি। এই সব নামও ব্ৰাহ্মণেতর বর্ণের, সন্দেহ করিবার কারণ নাই। অন্তত একজন করণ-কায়স্থ নরদত্ত যে সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন, সে-পরিচয় পাইতেছি। কুমারামাত্যদের মধ্যে একটি নাম পাইতেছি। বেরজাস্বামী; তিনি ব্ৰাহ্মণ ছিলেন বলিয়া কতকটা নিঃসংশয়ে বলা চলে। পুস্তপাল ও জ্যেষ্ঠ বা প্রথম কায়স্থদের সঙ্গে যাঁহারা স্থানীয় অধিকরণের রাষ্ট্ৰকার্য পরিচালনায় সহায়তা করিতেন তাঁহারা হইতেছেন নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম সার্থবাহ এবং প্রথম কুলিক; ইঁহাদের নামের তালিকায় পাওয়া যায় ধূতিপাল, বন্ধুমিত্র, রিভুপাল, স্থাণুদত্ত, মতিদত্ত ইত্যাদি ব্যক্তিকে; ইঁহাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলা যায় না। বস্তুত, এইসব নামাংশ বা পদবী পরবর্তী কালের ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়েতর অন্য ‘ভদ্র’বর্ণের।