রাজক, কর্মকার, নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ, ভিল্লী, চণ্ডাল, পুক্কশ, কাপালিক, নর্তক, তক্ষণ, সুবৰ্ণকার, শৌণ্ডিক এবং পতিত ও নিষিদ্ধ বৃত্তিজীবী ব্ৰাহ্মণদের দ্বারা স্পষ্ট বা পক্ক খাদ্য ব্রাহ্মণদের পক্ষে ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল; এই নিষেধ অমান্য করিলে প্ৰায়শ্চিত্ত করিতে হইত। শূদ্ৰপক্ক অন্ন ভক্ষণও নিষিদ্ধ ছিল; নিষেধ অমান্য করিলে পূর্ণ কৃচ্ছ্র-প্ৰায়শ্চিত্তের বিধান ছিল; প্রাচীন স্মৃতিকারদের এই বিধান ভবদেবও মানিয়া লইয়াছেন, তবে টীকা ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়পক্ক অন্নগ্ৰহণ করিলে কৃচ্ছ্র-প্রায়শ্চিত্তের অর্ধেক পালন করিলেই চলিবে; আর বৈশ্যপক্ক অন্ন গ্রহণ করিলে তিন-চতুর্থাংশ। ক্ষত্রিয় যদি শূদ্ৰপক্ক অন্ন গ্রহণ করে তাহাকে পূর্ণ কৃচ্ছ্র-প্ৰায়শ্চিত্ত করিতে হইবে, কিন্তু বৈশ্যপক অন্নগ্রহণ করিলে অর্ধেক প্রায়শ্চিত্ত করিলেই চলিবে; বৈশ্য শূদ্ৰপক্ক অন্নগ্ৰহণ করিলেও অর্ধেক প্রায়শ্চিত্তেই চলিতে পারে। শূদ্রহস্তে তৈলপক্ক ভর্জিত (শস্য) দ্রব্য, পায়স কিংবা আপৎকালে শূদ্ৰপক্ক দ্রব্য ইত্যাদি ভোজন করিতে ব্ৰাহ্মণের কোনও বাধা নাই; শেষোক্ত অবস্থায় মনস্তাপপ্রকাশরূপ প্ৰায়শ্চিত্ত করিলেই দোষ কাটিয়া যায়। ভবদেবের সময়ে দ্বিজবর্ণের মধ্যে বাঙলাদেশে এইসব বিধি-নিষেধ কিছু স্বীকৃত ছিল, কিছু নূতন গড়িয়া উঠিতেছিল বলিয়া মনে হইতেছে। শূদ্রের পাত্রে রক্ষিত অথবা শূদ্রদত্ত জলপানও ব্রাহ্মণদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল, অবশ্য স্বল্প প্রায়শ্চিত্তেই সে দোষ কাটিয়া যাইত; তবে ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র কেহই চণ্ডাল ও অন্তজস্পৃষ্ট বা তাঁহাদের পাত্রে রক্ষিত জল পান করিতে পারিতেন না, করিলে পুরোপুরি প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত। নট ও নর্তকদের সম্বন্ধে ভবদেবের বিধি-নিষেধ দেখিয়া মনে হয়, উচ্চতর বর্ণসমাজে ইহারা সম্মানিত ছিলেন না। বৃহদ্ধৰ্মপুরাণে নটেরা অধম সংকর পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু সমসাময়িক অন্য প্রমাণ হইতে মনে হয়, যাঁহারা নট-নৰ্তকের বৃত্তি অনুসরণ করিতেন সমাজে তাঁহাদের প্রতিষ্ঠা কম ছিল না। নট গাঙ্গো বা গাঙ্গোক-রচিত কয়েকটি শ্লোক সুপ্রসিদ্ধ সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থে স্থান পাইয়াছে। “পদ্মাবতীচরণচারণ-চক্রবর্তী” জয়দেবের পত্নী প্রাকবিবাহ জীবনে দেবদাসী-নটী ছিলেন, এইরূপ জনশ্রুতি আছে। জয়দেব নিজেও সংগীতপারঙ্গম ছিলেন; সেকশুভোদয়া গ্রন্থে এই সম্বন্ধে একটি গল্পও আছে।
অন্ত্যজ জাতেরা বোধ হয় এখনকার মতো তখনও অস্পৃশ্য বলিয়া পরিণগতি হইতেন। ডোম্ব-ডোম্বীরা যে ব্রাহ্মণদের অস্পৃশ্য ছিলেন তাহার একটু পরোক্ষ প্রমাণ চযাঁগীতে পাওয়া যায় (১০ নং গীত)। ভবদেবের প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ-গ্রন্থের সংসর্গ প্রকরণাধ্যায়ে অস্পৃশ্য-স্পর্শদোষ সম্বন্ধে নাতিবিস্তর আলোচনা দেখিয়াও মনে হয় স্পর্শবিচার সম্বন্ধে নানাপ্রকার বিধি-নিষেধ সমাজে দানা বাঁধিয়া উঠিতেছিল।
বিবাহ-ব্যাপারেও অনুরূপ বিধি-নিষেধ যে গড়িয়া উঠিতেছিল। তাহার পরিচয়ও সুস্পষ্ট। পালপর্বে এই প্রসঙ্গে রাজা লোকনাথের পিতৃ ও মাতৃবংশের পরিচয়ে দেখা গিয়াছে, উচ্চবর্ণ পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণ নারীর বিবাহ, ব্রাহ্মণ বর ও শূদ্রকন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না। সবর্ণে বিবাহই সাধারণ নিয়ম ছিল, এই অনুমান সহজেই করা চলে। কিন্তু সেনা-বর্মণ-দেবী আমলেও চতুৰ্বর্ণের মধ্যে, উচ্চবর্ণ বর ও নিম্নবর্ণ কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ হয় নাই, এমন-কি শূদ্রকন্যার ব্যাপারেও নহে; ভবদেব ও জীমূতবাহন উভয়ের সাক্ষ্য হইতেই তাহা জানা যায়। ব্ৰাহ্মণের বিদগ্ধা শূদ্র স্ত্রীর কথা ভবদেব উল্লেখ করিয়াছেন; জীমূতবাহন ব্রাহ্মণের শূদ্র স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের উত্তরাধিকারগত রীতিনিয়মের কথা বলিয়াছেন; যজ্ঞ ও ধর্মানুষ্ঠান ব্যাপারে সমাবর্ণ স্ত্রী বিদ্যমান না থাকিলে অব্যবহিত নিম্নবর্তী বর্ণের স্ত্রী হইলেও চলিতে পারে, এইরূপ বিধানও দিয়াছেন। এইসব উল্লেখ হইতে মনে হয়, শূদ্ৰবৰ্ণ পর্যন্ত ব্ৰাহ্মণ পুরুষের যে কোনও নিম্নবর্ণে বিবাহ সমাজে আজিকার মতন একেবারে নিষিদ্ধ হইয়া যায় নাই। অবশ্য কোনও পুরুষই উচ্চবর্ণে বিবাহ করিতে পারিতেন না। তবে, দ্বিজবর্ণের পক্ষে শূদ্রবর্ণে বিবাহ সমাজে নিন্দনীয় হইয়া আসিতেছিল, ইহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কারণ, এই প্রথা যে নিন্দনীয় এ-সম্বন্ধে মনু ও বিষ্ণুস্মৃতির মত উল্লেখ করিয়া জীমূতবাহন বলিতেছেন, শঙ্খস্মৃতি দ্বিজবর্ণের ক্ষত্ৰিয়া ও বৈশ্য স্ত্রীর কথাই বলিয়াছেন, শূদ্র স্ত্রীর কথা উল্লেখই করেন নাই। যজ্ঞ ও ধর্মানুষ্ঠানে স্ত্রীর অধিকার সম্বন্ধে জীমূতবাহনের যে-মত একটু আগে উদ্ধার করা হইয়াছে, সেই প্রসঙ্গে জীমূতবাহন মনুর মত সমর্থনা করিয়া বলিতেছেন, সবর্ণ স্ত্রীই এই অধিকারের অধিকারী, তবে সবৰ্ণ স্ত্রী বিদ্যমান না থাকিলে ক্ষত্ৰিয়া স্ত্রী যজ্ঞভাগী হইতে পারেন, কিন্তু বৈশ্য বা শূদ্র নারী ব্ৰাহ্মণের বিবাহিত হইলেও তিনি তাহা হইতে পারেন না, অর্থাৎ যথার্থ স্ত্রীত্বের অধিকারী তিনি হইতে পারেন না। এই টিপ্পনী হইতে স্বভাবতই এই অনুমান করা চলে যে, ব্রাহ্মণ বৈশ্যানী এমন-কি শূদ্রাণীও বিবাহ করিতে পারিতেন, করিতেনও, কিন্তু তাহারা সর্বদা স্ত্রী অধিকার লাভ করিতেন না। এই অনুমানের প্রমাণ জীমূতবাহনই অন্যত্র দিতেছেন; বলিতেছেন, ব্ৰাহ্মণ শুদ্রাণীর গর্ভে সন্তানের জন্মদান করিলে তাহাতে নৈতিক কোনও অপরাধ হয় না; স্বল্প সংসৰ্গদোষ তাহাকে স্পর্শ করে মাত্র, এবং নামমাত্র প্রায়শ্চিত্ত করিলেই সে অপরাধ কাটিয়া যায়। শূদ্রাণীর সঙ্গে বিবাহ যে সমাজে ক্রমে নিন্দনীয় হইয়া আসিতেছিল। তাহা জীমূতবাহনের সাক্ষ্য হইতে বুঝা যাইতেছে; বিভিন্ন বর্ণের স্ত্রীদের মযাঁদা সম্বন্ধেও যে পার্থক্য করা হইতেছিল তাহাও পরিষ্কার, বিশেষত শূদ্র বিবাহিতা পত্নী সম্বন্ধে। বর্ণাশ্রম-বহির্ভূত যেসব জাত ছিল তাহাদের সঙ্গে বিবাহ-সম্বন্ধের কোনও প্রশ্ন বিবেচনার মধ্যেই আসে নাই, অর্থাৎ তাহা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল, এমন-কি শূদ্রের পক্ষেও।