কৈবর্ত-মাহিষ্য
পাল-পর্বে কৈবর্ত-মাহিষ্য প্রসঙ্গে বলিয়াছি, তখন পর্যন্ত কৈবর্তদের সঙ্গে মাহিষ্যদের যোগাযোগের কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নাই এবং মাহিষ্য বলিয়া কৈবর্তদের পরিচয়ের কোনও দাবিও নাই স্বীকৃতিও নাই। সেন-বর্মণ-দেব পর্বেও তেমন দাবী কেহ উপস্থিত করিতেছেন না; এই যুগের কোনও পুরাণ বা স্মৃতিগ্রন্থেও তেমন উল্লেখ নাই। বস্তুত, মাহিষ্য নামে কোন উপবর্ণের নামই নাই। কৈবর্তদের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সংকলয়িতা বলিতেছেন, ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্যমাতার সঙ্গমে কৈবর্তদের উদ্ভব। লক্ষণীয় এই যে, গৌতম ও যাজ্ঞবল্ক্য তাঁহাদের প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে মাহিষ্যদের উদ্ভব সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যাই দিতেছেন; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা কোথায় পাইলেন, বলা কঠিন; কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থ কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখায় নাই, সমসাময়িক বৃহদ্বর্মপুরাণ বা কোনও স্মৃতিগ্রন্থেও নাই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যা যদি বা পাইতেছি মাহিষ্য-ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কিন্তু কলিযুগে ইঁহাদের বৃত্তি নির্দেশ দেখিতেছি ধীবরের, মাহিষ্যের নয়। সুতরাং মনে হয়, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যার মধ্যেই কোনও গোলমাল রহিয়া গিয়াছে। দ্বাদশ শতকে ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে। বৃহদ্বর্মপুরাণ ধীবর ও মৎস্যব্যবসায়ী অন্য একটি জাতের অর্থাৎ জালিকদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন মধ্যম সংকর পর্যায়ে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ধীবর ও কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অসৎশূদ্র পর্যায়ে; এবং ইঁহাদের প্রত্যেকেরই ইঙ্গিত এই যে, ইঁহারা মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী নন। তবে, স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সংকলয়িতা ইঁহাদের উদ্ভব-ব্যাখ্যা দিতেছেন, এই জাতীয় ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিয়াই পরবর্তীকালে কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের এক ও অভিন্ন বলিয়া দাবী সমাজে প্রচলিত ও স্বীকৃত হয়। যাহাই হউক, বর্তমানকালে পূর্ববঙ্গের হালিক দাস এবং পরাশর দাস এবং হুগলী-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের চাষী কৈবর্তরা নিজেদের মাহিষ্য বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। আবার পূর্ববঙ্গে (ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, মৈমনসিংহ, ঢাকা অঞ্চলে) মৎস্যজীবী ধীবর ও জালিকরা কৈবর্ত বলিয়া পরিচিত। বুঝা যাইতেছে, কালক্রমে কৈবর্তদের মধ্যে দুইটি বিভাগ রচিত হয়, একটি প্রাচীন কালের ন্যায় মৎস্যজীবীই থাকিয়া যায় (যেমন পূর্ববঙ্গে আজও), আর একটি কৃষি (হালিক) বৃত্তি গ্রহণ করিয়া মাহিষ্যদের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন বলিয়া পরিগণিত হয়। বল্লালচরিতে যে বলা হইয়াছে, রাজা বল্লালসেন কৈবর্ত (এবং মালাকার, কুম্ভবকার ও কর্মকার)-দিগকে সমাজে উন্নীত করিয়াছিলেন, তাহার সঙ্গে কৈবর্তদের এক শ্রেণীর বৃত্তি পরিবর্তনের (চাষি-হালিক হওয়ার) এবং মাহিষ্যদের সঙ্গে অভিন্নতা দাবীর যোগ থাকা অসম্ভব নয়।
———————
(১) Bib, Ind, edn. এই গ্রন্থ দুইখণ্ডে বিভক্ত। এই অধ্যায়ে আহৃত সংবাদ গ্রন্থের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, সর্বত্র সূচী-নিৰ্দেশ করিয়া লাভ নাই, সেইজন্য পাদটীকা সর্বত্র দেওয়া হয় নাই। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের পক্ষে গ্রন্থখানির আনুপূর্বিক পাঠ প্রয়োজন। বর্ণবিন্যাস সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্য দ্বিতীয় অর্থাৎ উত্তরখণ্ডের ১৩শ ও ১৪শ অধ্যায়ে পাওয়া যাইবে। এই সঙ্গে শ্ৰীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের সুলিখিত আলোচনা দ্রষ্টব্য: ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৩৬-৩৭, ২য় খণ্ড, ৬৭৩পৃপৃ. ১৩৩৭-৩৮, ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃপৃ। বঙ্গবাসী প্রেস সম্পাদিত ও প্রকাশিত এই পুরাণের একটি সংস্করণ আছে, তবে Bib, Ind. সং অধিকতর প্রামাণিক।
(২) জীবানন্দ বিন্যাসাগর কৃত সংস্করণ। এই ক্ষেত্রেও সবত্র পৃথক সূচিনির্দেশ দেওয়া হইতেছেনা। এই অধ্যায়ে আহৃত অধিকাংশ সংবাদ এই গ্রন্থের প্রথম অর্থাৎ ব্ৰহ্মখণ্ডের দশম পরিচ্ছেদে পাওয়া যাইবে; ১৬-২১ এবং ৯০–১৩৭ শ্লোক বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। ২/৪টি তথ্য অন্যত্র বিক্ষিপ্তও যে নাই তাহা নয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মিশ্রবর্ণেরও সম্পূর্ণ তালিকা এক্ষেত্রে উদ্ধার করা হয় নাই, করিয়া লাভও নাই; কারণ, এই পুরাণই বলিতেছে, ‘মিশ্রবর্ণ অসংখ্য, কে তাহার সমস্ত নাম উল্লেখ ও গণনা করিতে পারে’ (১।১০।১২২)? সৎশূদ্রদের তালিকাও যে সম্পূর্ণ নয় তাহার আভাসও এই গ্রন্থেই আছে (১।১০১৮)।
(৩) লক্ষ্যণীয় যে এই পুরাণ বৈদ্য ও অম্বষ্ঠদের পৃথক উপবর্ণ বলিয়া উল্লেখ করিতেছে; এবং উভয় উপবর্ণের যে উৎপত্তি-কাহিনী দিতেছে, তাহাও পৃথক।
২৬. বর্ণ ও শ্রেণী
উপরোক্ত উভয়পুরাণের মতেই করণ-কায়স্থ এবং বৈদ্য-অম্বষ্ঠদের পরেই গোপ, নাপিত, মালাকার, কুম্ভকার, কম কাব, শংখকার, কংসকার, তন্তুবায়-কুবিন্দক, মোদক এবং তাম্বলীদের স্থান। গন্ধবণিক, তৈলিক, তৌলক (সুপারী-ব্যবসায়ী), দাস (চাষী), এবং বারজীবি (বারুই), ইঁহাদেরও সদ্যোক্ত জাতগুলির সমপর্যায়ে গণ্য করা হইত। ইহাদের মধ্যে কৃষিজীবি দাস ও বারজীবি, এবং শিল্প জীবি কুম্ভকার, কর্মকার, শংখকার, কংসকার ও তন্তুবায় ছাড়া আর কাহাকেকও ধনোৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করা যায় না। গোপ, নাপিত, মালাকার, ইঁহারা সমাজ-সেবক মাত্র। মোদক, তাম্বুলী (তাম্লী) তৈলিক-তৌলিক এবং গন্ধবণিকেরা ব্যবসায়ী শ্রেণী, এবং সেই হেতু অর্থোৎপাদক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করা যাইতে পারে; তবে ইঁহাদের মধ্যে মোদক বা ময়রার ব্যবসায় বিস্তৃত বা যথাযথভাবে ধনোৎপাদক ছিল, এমন বলা যায় না। গুবাক, পান এবং গন্ধদ্রব্যের ব্যবসায় যে সুবিস্তৃত ছিল তাহা অন্যত্র নানা প্রসঙ্গে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি। কারণ ও অম্বষ্ঠদের বৃত্তিও ধনোৎপাদক বৃত্তি নয়। করণরা সোজাসুজি কেরাণী, পুস্তপাল, হিসাবরক্ষক, দপ্তর-কর্মচারী; অম্বষ্ঠ-বৈদ্যরা চিকিৎসক। উভয়ই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের সাক্ষ্য হইতে স্পষ্টই মনে হয়, স্বর্ণকার ও অন্যান্য বণিকেরা—সুবর্ণবণিকেরা হয়ত ইহাদের অন্তর্গত ছিলেন –আগে উত্তম সংকর বা সংশূদ্র পর্যায়েই গণ্য হইতেন, কিন্তু বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রচনাকালে তাহারা ‘পতিত’ হইয়া গিয়াছেন। দ্বাদশ শতকে ভবদেব ভট্টও সুবর্ণকারদের নিম্নজাত পর্যায়ে ফেলিয়াছেন। বল্লালচরিতে যে বলা হইয়াছে বল্লালসেন কোনও কোনও বণিক, বিশেষ ভাবে সুবর্ণবণিকদের সমাজে ‘পতিত’ করিয়া দিয়াছিলেন, তাহার সঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের এই ইঙ্গিতের যোগ থাকা অসম্ভব নয়। অন্ততঃ এইটুকু স্থম্পষ্ট যে, কোনও না কোনও কারণে অর্থোৎপাদক শিল্পী ও বণিক সম্প্রদায়ের কোনও কোনও অংশ সমাজে ‘পতিত’ হইয়াছিল, তাহা রাষ্ট্রের নিদেশে বা অন্ত যে কোনও কারণেই হউক।