লক্ষণীয় যে, এই পুরাণ বৈদ্য ও অম্বষ্ঠদের পৃথক উপবর্ণ বলিয়া উল্লেখ করিতেছে, এবং উভয় উপবর্ণের যে উৎপত্তি-কাহিনী দিতেছে, তাহাও পৃথক।
সৎশুদ্র
১. করণ
২. অম্বষ্ঠ (দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান)
৩. বৈদ্য (জনৈক ব্রাহ্মণীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারের ঔরসে জাত সন্তান; বৃত্তি চিকিৎসা)(৩)
৪. গোপ
৫. নাপিত
৬. ভিল্ল (ইঁহারা আদিবাসী কোম; কি করিয়া সৎশদ্র পর্যায়ে পরিগণিত হইলেন, বলা কঠিন)
৭. মোদক
৮. কুবর (?)
৯. তাম্বুলী (তাম্লী)
১০. স্বর্ণকার ও অন্যান্য বনিক (ইঁহারা পরে ব্রাহ্মণের অভিশাপে, ‘পতিত’ হইয়া ‘অসৎশূদ্র’ পর্যায়ে নামিয়া গিয়াছিলেন; স্বর্ণকারদের অপরাধ ছিল সোনাচুরি)
১১. মালাকার
১২. কর্মকার
১৩. শঙ্খকার
১৪. কুবিন্দক (তন্তুবায়)
১৫. কুম্ভকার
১৬. কাংসকার
১৭. সূত্রধার
১৮. চিত্রকার (পটুয়া)
১৯. স্বর্ণকার
সূত্রধর ও চিত্রকর কর্তব্যপালনে অবহেলা করায় অপরাধে ব্রাহ্মণের অভিশাপে ‘পতিত’ হইয়া অসৎশুদ্র পর্যায়ে গণ্য হইয়াছিলেন। স্বর্ণকারও ‘পতিত’ হইয়াছিলেন, এ কথা আগেই বলা হইয়াছে।
পতিত বা অসৎশূদ্র পর্যায়ে যাঁহাদের গণনা করা হইত তাঁহাদের তালিকাগত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়:
অসৎশূদ্র
স্বর্ণকার। [সুবর্ণ] বনিক। সূত্রধার (বৃহদ্বর্মপুরাণের তক্ষণ)। চিত্রকার।
২০. অট্টালিকাকার
২১. কোটক (ঘরবাড়ি তৈরীর মিস্ত্রী)
২২. তীবর
২৩. তৈলকার
২৪. লেট
২৫. মল্ল
২৬. চর্মকার
২৭. শুঁড়ি
২৮. পৌণ্ড্রক (পোদ?)
২৯. মাংসচ্ছেদ (কসাই)
৩০. রাজপুত্র (পরবর্তী কালের রাউত?)
৩১. কৈবর্ত (কলিযুগের ধীবর)
৩২. রজক
৩৩. কৌয়ালী
৩৪. গঙ্গাপুত্র (লেট-তীবরের বর্ণ-সংকর সন্তান)
৩৫. যুঙ্গি (যুগী?)
৩৬. আগরী (বৃহদ্বর্ম্পুরাণের উগ্র ? বর্তমানে আগুরী)
অসৎশদ্রেরও নিম্ন পর্যায়ে, অর্থাৎ অন্তজ-অস্পৃশ্য পর্যায়ে যাঁহাদের গণনা করা হয় তাঁহাদের তালিকাগত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়:
ব্যাধ, ভড় (?), কাপালী, কোল (আদিবাসী কোম), কোঞ্চ (কোচ, আদিবাসী কোম), হড্ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী), শরাক, ব্যালগ্রাহী (ব্রহ্মদ্বর্ম্পুরাণের মলেগ্রাহী?), চণ্ডাল ইত্যাদি।
এই দুইটি বর্ণবিভাগের তালিকা তুলনা করিলে দেখা যায় প্রথমোল্লিখিত গ্রন্থের সংকর পর্যায় এবং দ্বিতীয় গ্রন্থের সৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু মগধ, গন্ধবণিক, তৌলিক বা তৈলিক, দাস, বারজীবি, এবং সূত দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হইতে বাদ পড়িয়াছে; পরিবর্তে পাইতেছি ভিল্ল ও কুবর এই দুইটি উপবর্ণের উল্লেখ, এবং বৈদ্যদের উল্লেখ। তাহা ছাড়া, প্রথম গ্রন্থের উত্তম সংকর বর্ণের রাজপুত্র দ্বিতীয় গ্রন্থের অসৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু ব্রহ্মদ্বর্মপুরাণের আভীর, নট, শাবাক (শ্রাবক?), শেখর ও জানিল দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হইতে বাদ পড়িয়াছে; পরিবর্তে পাইতেছি অট্টালিকাকার, কোটক, লেট মল্ল, চর্মকার, পৌণ্ড্রক, মাংশচ্ছেদ, কৈবর্ত, গঙ্গাপুত্র, যুঙ্গি, আগরী এবং কৌয়ালী। ইঁহাদের মধ্যে মল্ল ও চর্মকার বৃহদ্বর্মপুরাণের অধর সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ের। বৃহদ্বর্মপুরাণে ধীবর ও জালিক, মৎস্য-ব্যবসাগত এই দুইটি উপবর্ণের খবর পাইতেছি; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাইতেছি কেবল কৈবর্তদের। কৈবর্তদের উদ্ভব সম্বন্ধে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে: কৈবর্ত ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান; কিন্তু কলিযুগে তীবরদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ইঁহারা ধীবর নামে পরিচিত হন এবং ধীবর বৃত্তি গ্রহণ করেন। ভবদেব ভট্টের মতে কৈবর্তরা অন্ত্যজ পর্যায়ের। ভবদেবের অন্ত্যজ পর্যায়ের তালিকা উপরোক্ত দুই পুরাণের তালিকার সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে: রজক, চর্মকার,নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ এবং ভিল্ল। ভবদেবের মতে চণ্ডাল ও অন্ত্যজ সমার্থক। চণ্ডাল, পুক্কশ, কাপালিক, নট, নর্তক, তক্ষণ (বৃহদ্বর্মপুরাণোক্ত মধ্যম সংকর পর্যায়ের তক্ষ?), চর্মকার, সুবর্ণকার, শৌণ্ডিক, রজক এবং কৈবর্ত প্রভৃতি নিম্নতম উপবর্ণের এবং পতিত ব্রাহ্মণদের স্পৃষ্ট খাদ্য ব্রাহ্মণদের অভক্ষ্য বলিয়া ভবদেব ভট্ট বিধান দিয়াছেন, এবং খাইলে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, তাহাও বলিয়াছেন।
দেখা যাইতেছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উল্লিখিত তিনটি সাক্ষ্যে অল্পবিস্তর বিভিন্নতা থাকিলেও বর্ণ-উপবর্ণের স্তর-উপস্তর বিভাগ সম্বন্ধে ইঁহাদের তিনজনেরই সাক্ষ্য মোটামুটি একই প্রকার। এই চিত্রই সেন-বর্মণদের আমলের বাঙলাদেশের বর্ণ-বিন্যাসের মোটামুটি চিত্র।
করণ-কায়স্থ
প্রথমেই দেখিতেছি করণ ও অম্বষ্ঠদের স্থান। করণরা কিন্তু কায়স্থ বলিয়া অভিহিত হইতেছেন না; এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বৈদ্যদের স্পষ্টতই অম্বষ্ঠ হইতে পৃথক বলিয়া গণ্য করা হইয়াছে। করণদের সম্বন্ধে পাল-পর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে, এবং করণ ও কায়স্থরা যে বর্ণহিসাবে এক এবং অভিন্ন তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে। এই অভিন্নতা পাল পর্বেই স্বীকৃত হইয়া গিয়াছিল; বৃহদর্মপুরাণে বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কেন যে সে ইঙ্গিত নাই তাহা বলা কঠিন। হইতে পারে, ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের তখনও তাহা সম্পূর্ণ স্বীকৃত হইয়া উঠে নাই।
অম্বষ্ঠ বৈদ্য
বৃহদ্বর্মপুরাণে বর্ণহিসাবে বৈদ্যদেরও উল্লেখ নাই, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আছে; কিন্তু সেখানেও বৈদ্য ও অম্বষ্ঠ দুই পৃথক উপবর্ণ এবং উভয়ের উদ্ভব-ব্যাখ্যাও বিভিন্ন। এই গ্রন্থের মতে দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সঙ্গমে অম্বষ্ঠদের উদ্ভব; কিন্তু বৈদ্যদের উদ্ভব সূর্যতনয় অশ্বিনীকুমার এবং জনৈকা ব্রাহ্মণীর আকস্মিক সঙ্গমে। বৈদ্য ও অম্বষ্ঠরা যে এক এবং অভিন্ন এই দাবি সপ্তদশ শতকে ভরতমল্লিকের আগে কেহ কহিতেছেন না; ইনিই সর্বপ্রথম নিজে বৈদ্য এবং অম্বষ্ঠ বলিয়া আত্মপরিচয় দিতেছেন। তবে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের উল্লেখ হইতে বুঝা যায়, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈদ্যরা উপবর্ণ হিসাবে বিদ্যমান, এবং বৃহদ্বর্মপুরাণ ও সদ্যোক্ত পুরাণটির সাক্ষ্য একত্র করিলে ইহাও বুঝা যায় যে, অম্বষ্ঠ ও বৈদ্য উভয়েই সাধারণত একই বৃত্তি অনুসারী ছিলেন। বোধ হয়, এক এবং অভিন্ন এই চিকিৎসাবৃত্তিই পরবর্তীকালে এই দুই উপবর্ণকে এক এবং অভিন্ন উপবর্ণে বিবর্তিত করিয়াছিল, যেমন করিয়াছিল করণ ও কায়স্থদের।