—————–
(১) Ep. Ind, xviI, 356 P.
(২) পিতৃদয়িত, ৮ পৃ।
(৩) Ep. Ind. II, 330 p.
২৫. ব্রাহ্মণেতর বর্ণবিভাগ
বৃহদ্ধর্মপুরাণে(১) দেখা যাইতেছে, ব্রাহ্মণ ছাড়া বাংলাদেশে আর যত বর্ণ আছে, সমস্তই সঙ্কর; চতুবর্ণের যথেচ্ছ পারস্পরিক যৌনমিলনে উৎপন্ন মিশ্রবর্ণ, এবং তাহার, সকলই শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণদ্বয়ের উল্লেখই এই গ্রন্থে নাই। ব্রাহ্মণেরা এই সমস্ত শূদ্র সঙ্কর উপবর্ণগুলিকে তিনশ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেকটি উপরর্ণের স্থান ও বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। এই বর্ণ ও বৃত্তিসমূহের বিবরণ দিতে দিয়া বৃহদ্বর্মপুরাণ বেণ রাজা সম্বন্ধে যে-গল্পের অবতারণা করিয়াছেন কিংবা উত্তম, মধ্যম ও সংকর এই তিন পর্যায়-বিভাগের যে-ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহার উল্লেখ বা আলোচনা অবান্তর। কারণ, স্মৃতিগ্রন্থের বর্ণ-উপবর্ণ ব্যাখ্যার সঙ্গে বাস্তব ইতিহাসের যোগ আবিষ্কার কথা বড় কঠিন। যাহা হউক, এই গ্রন্থ তিন পর্যায়ে ৩৬ টি উপবর্ণ বা জাতের কথা বলিতেছে, যদিও তালিকাভুক্ত করিতেছে ৪১টি জাত। বাঙলাদেশের জাত সংখ্যা বলতে আজও আমরা বলি ছত্রিশ জাত। ৩৬টিই বোধ হয় ছিল আদি সংখ্যা, পরে আরও ৫টি উপবর্ণ এই তালিকায় ঢুকিয়া পড়িয়া থাকিবে। উত্তম-সংকর পর্যায়ে ২০টি উপবর্ণ :
উত্তম-সংকর
১. করণ – ইঁহারা লেখক ও পুস্তককর্মদক্ষ এবং সৎশুদ্র বলিয়া পরিগণিত।
২. অম্বষ্ঠ – ইঁহাদের বৃত্তি চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদচর্চা, সেইজন্যে ইঁহারা বৈদ্য বলিয়া পরিচিত। ঔষধ প্রস্তুত করিতে হয় বলিয়া ইঁহাদের বৃত্তি বৈশ্যের, কিন্তু ধর্মকর্মানুষ্ঠানের ব্যাপারে ইহারা শুদ্র বলিয়াই গণিত।
৩. উগ্র – ইঁহাদের বৃত্তি ক্ষত্রিয়ের, যুদ্ধবিদ্যাই ধর্ম।
৪. মাগধ – হিংসামূলক যুদ্ধব্যবসায়ে অনিচ্ছুক হওয়ায় ইহাদের বৃত্তি নির্দিষ্ট হইয়াছিল সূত বা চারণের এবং সংবাদবাহীর।
৫. তন্ত্রবায় (তাঁতী)।
৬. গান্ধিক বনিক (গন্ধদ্রব্য বিক্রয় যে-বণিকের বৃত্তি; বর্তমানে গন্ধবনিক)।
৭. নাপিত।
৮. গোপ (লেখক)।
৯. কর্মকার (কামার)।
১০. তৈলিক বা তৌলিক – (গুবাক-ব্যবসায়ী)।
১১. কুম্ভকার (কুমোর)।
১২. কাংসকার (কাঁসারী)।
১৩. শাঙ্খিক বা শঙ্খকার (শাঁখারী)।
১৪. দাস – কৃষিকার্য ইঁহাদের বৃত্তি, অর্থাৎ চাষী।
১৫. বারজীবী (বারুই) – পানের বরজ ও পান উৎপাদন করা উঁহাদের বৃত্তি।
১৬. মোদক (ময়রা)।
১৭. মালাকার।
১৮. সূত – (বৃত্তি উল্লিখিত নাই, কিন্তু অনুমান হয় এরা চারণ-গায়ক)।
১৯. রাজপুত্র – (বৃত্তি অনুল্লিখিত; রাজপুত?)
২০. তাম্বলী (তামলী) – পানবিক্রেতা।
মধ্যম-সংকর
মধ্যম-সংকর পর্যায়ে ১২টি উপবর্ণ :
২১. তক্ষণ – খোদাইকর।
২২. রজক – (ধোপা)।
২৩. স্বর্ণকার – (সোনার অলংকার ইত্যাদি প্রস্তুতকারক)।
২৪. সুবর্ণবনিক – সোনা ব্যবসায়ী।
২৫. আভীর (আহীর) – (গোয়ালা, গোরক্ষক)।
২৬. তৈলকার – (তেলী)।
২৭. ধীবর – (মৎস্যব্যবসায়ী)।
২৮. শৌণ্ডিক – (শুঁড়ি)।
২৯. নট – যাহারা নাচ, খেলা ও বাজি দেখায়।
৩০. শাবাক, শাবক, শারক, শাবার (?) – (ইঁহারা কি বৌদ্ধ শ্রাবকদের বংশধর?)।
৩১. শেখর (?)
৩২. জালিক (জেলে, জালিয়া)।
অধম-সংকর বা অন্ত্যজ
অধম সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ে ৯টি উপবর্ণ; ইঁহারা সকলেই বর্ণাশ্রম-বহির্ভূত। অর্থাৎ, ইঁহারা অস্পৃশ্য এবং ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থার মধ্যে ইঁহাদের কাহারও কোনও স্থান নাই।
৩৩. মলেগ্রহী (বঙ্গবাসী, সং: মলেগৃহি)।
৩৪. কুড়ব (?)।
৩৫. চণ্ডাল (চাঁড়াল)।
৩৬. বরুড় (বাউড়ী?)
৩৭. তক্ষ (তক্ষণকার?)।
৩৮. চর্মকার (চামার)।
৩৯. ঘট্টজীবী (পাঠান্তর ঘণ্টজীবী– খেয়াঘাটের রক্ষক, খেয়াপারাপারের মাঝি? বর্তমান, পাটনী?)।
৪০. ডোলাবাহী – ডুলি-বেহারা, বর্তমানে দুলিয়া বা দুলে (?)।
৪১. মল্ল (বর্তমানে মালো ?)।
ম্লেচ্ছ
এই ৪১টি জাত ছাড়া ম্লেচ্ছ পর্যায়ে আরও কয়েকটি দেশি ও ভিন্প্রদেশি আদিবাসি কোমের নাম পাওয়া যায়; স্থানীয় বর্ণ-ব্যবস্থার ইঁহাদেরও কোনও স্থান ছিল না, যথা, পুক্কশ, পুলিন্দ, খস, থর, কম্বোজ, যবন, সুহ্ম, শবর ইত্যাদি।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও অনুরূপ বর্ণ-বিন্যাসের খবর পাওয়া যাইতেছে।(২) ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ (উচ্চ ও নিম্ন) এই দুই পর্যায়ে শূদ্রবর্ণের বিভাগের আভাস বৃহদ্বর্মপুরাণেই পাওয়া গিয়াছে; করণদের বলা হইয়াছে ‘সৎশূদ্র’। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সমস্ত সংকর বা মিশ্র উপবর্ণগুলিকে সৎ ও অসৎ শূদ্র এই দুই পর্যায়ে ভাগ করা হইয়াছে। সৎশূদ্র পর্যায়ে যাঁহাদের গণ্য করা হইয়াছে তাঁহাদের নিম্নলিখিতভাবে তালিকাগত করা যাইতে পারে। এই ক্ষেত্রেও সর্বত্র পৃথক সূচীনির্দেশ দেওয়া হইতেছে না। এই অধ্যায়ে আহৃত অধিকাংশ সংবাদ এই গ্রন্থের প্রথম অর্থাৎ ব্রহ্মখণ্ডের দশম পরিচ্ছেদে পাওয়া যাইবে; ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৯ শ্লোক বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। ২/৪টি তথ্য অন্যত্র বিক্ষিপ্তও যে নাই তাহা নয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মিশ্রবর্ণেরও সম্পূর্ণ তালিকা এক্ষেত্রে উদ্ধার করা হয় নাই, করিয়া লাভো নাই; কারণ, এই পুরাণেই বলিতেছে, মিশ্রবর্ণ অসংখ্য, কে তাহার সমস্ত নাম উল্লেখ ও গণনা করিতে পারে (১।১০।১২২)? সৎশূদ্রদের তালিকাও যে সম্পূর্ণ নয়, তাহার আভাসও এই গ্রন্থেই আছে (১।১০।১৮)।