————————
(১) Insc. of Bengal, III, p. 37; Ëiŵ।RR®, Ed, Trivandrum, Sans. Ser. 4. Vols; also see JRAS., 1927, p. 472.
(২) Insc. of Bengal, III, p. 36 and 24 respectively.
(৩) JASB., 1912, 343 p.
(৪) গৌড়লেখমালা, ১৫৪ পৃ।
(৫) কালবিবেক গ্রন্থের পুম্পিকা; কালবিবেক, Bib, Ind. Intro. vii p.
(৬) ব্রাহ্মণসর্বস্ব; Ind. Culture, I, 505 p.
(৭) অদ্ভূতসাগর, Ind. Ant., 1922, 47 p.
(৮) সদুক্তিকর্ণামৃত, Ed. by Ramavatara Sarma & Haradatta Sarma, Intro 44, 47, 58, 71, 81
(৯) Ed. Ind. XV. 3o1 p, ন্যায়কন্দলী, Jour Andhra Hist. Sec 1V, 158-62; Ind. Off Cat. I, Part one, No. 450; D.U. Mss, no.
২৩. ভৌগোলিক বিভাগ
কিন্তু গাঞী বিভাগ অপেক্ষা ও সামাজিক দিক হইতে গভীর অর্থবহ বিভাগ ব্রাহ্মণদের ভৌগোলিক বিভাগ। এক্ষেত্রেও কুলজী গ্রন্থের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করিয়া লাভ নাই; কারণ রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক ও অন্যান্য শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের উদ্ভব সম্বন্ধে এইসব গ্রন্থে যে বিবরণ পাওয়া যাইতেছে তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু হলায়ূধের “ব্রাহ্মণসর্বস্ব” প্রামাণ্যগ্রন্থ, এবং তাহার রচনাকালও সুনির্দিষ্ট। এই গ্রন্থে হলায়ূধ দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন যে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের যথার্থ বেদবিদ ছিলেন না; ব্রাহ্মণদের বেদচর্চার সমধিক প্রসিদ্ধি ছিল, তাঁহার মতে, উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশ সমূহে।(১) যাহাই হউক, হলায়ুধের সাক্ষ্য হইতে দেখিতেছি, দ্বাদশ শতকেই জনপদ বিভাগানুযায়ী ব্রাহ্মণদের রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে; এবং লিপিসাক্ষ্য হইতে জানা যায়, এই সব ব্রাহ্মণের রাঢ় ও বরেন্দ্রীর বাহিরে পূর্ব বঙ্গেও বসতি স্থাপন করিতেছেন। বরেন্দ্রীর তটক গ্রামীয় একজন ব্রাহ্মণ বিক্রমপুরে গিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন, অন্ততঃ একটি দৃষ্টান্ত আমরা জানি কুলজী গ্রন্থমালায় দেখা যায় কায়স্থ, বৈদ্য, বারুই প্রভৃতি অব্রাহ্মণ উপবর্ণদের ভিতরও রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র এবং বঙ্গজ প্রভৃতি ভৌগোলিক বিভাগ প্রচলিত হইয়াছিল, কিন্তু এসম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু নাই।
——————-
(১) ব্রাহ্মণসরস্ব, বারাণসী সং, সংবৎ ১৯৩৫। তেজেশচন্দ্র বিদ্যানন সম্পাদিভ কলিকা • সং, বাং ১৩৩১ ৷
২৪. বৈদিক ব্রাহ্মণ
রাঢ়ীয় এবং বারেন্দ্র বিভাগ ছাড়া ব্রাহ্মণদের আর একটি শ্রেণী— বৈদিক—বোধ হয় এই যুগেই উদ্ভূত হইয়াছিল। কুলজী গ্রন্থমালায় এসম্বন্ধে দুইটি কাহিনী আছে; একটি কাহিনী মতে, বাংলাদেশে যথার্থ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ না থাকায় এবং যজ্ঞাগ্নি যথানিয়মে বক্ষিত না হওয়ায় রাজা শ্যামলবর্মণ (বোধ হয় বর্মণরাজ সামল বর্মণ) কান্যকুব্জ (কোনও কোনও গ্রন্থমতে, বারাণসী) হইতে ১০ ০১ শকাব্দে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন। অপর কাহিনী মতে সরস্বতী নদীতীরস্থ বৈদিক ব্রাহ্মণেরা যবনাক্রমণের ভয়ে ভীত হইয়া বাংলাদেশে পলাইয়া আসেন, এবং বর্মণরাজ হরিবর্মণের পোষকতায় ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায় বসবাস আরম্ভ করেন। উত্তর ভারত হইতে আগত এইসব বৈদিক ব্রাহ্মণেরাই পাশ্চাত্য বৈদিক নামে খ্যাত। বৈদিক ব্রাহ্মণদের আর এক শাখা আসেন উৎকল ও দ্রাবিড হইতে; ইঁহারা দাক্ষিণাত্য বৈদিক নামে খ্যাত। এই কুলজী কাহিনীর মূল বোধ হয় হলাপের ব্রাহ্মণসৰ্ব্বস্ব গ্রন্থে পাওয়া যাইতেছে। এই গ্রন্থ-রচনার কারণ বর্ণনা করিতে গিয়া হলায়ূধ বলিতেছেন, রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠ করিত না এবং সেই হেতু বৈদিক যাগযজ্ঞানুষ্ঠানের রীতিপদ্ধতিও জানিত না; যথার্থ বেদজ্ঞান তাঁহার সময়ে উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশেই প্রচলিত ছিল। বাংলার ব্রাহ্মণেরা নিজেদের বেদজ্ঞ বলিয়া দাবি করিলেও যথার্থত বেদচর্চার প্রচলন বোধ হয় সত্যই তাঁহাদের মধ্যে ছিল না। হলায়ূধের আগে বল্লালগুরু অনিরুদ্ধ ভট্ট ও তাহার “পিতৃদয়িতা” গ্রন্থে বাংলাদেশে বেদ চর্চার অবহেলা দেখিয়া দুঃখ করিয়াছেন।(২) যাহা হউক, পাশ্চাত্য বলিতে হলায়ূধ এক্ষেত্রে উত্তর ভারতকেই বুঝাইতেছেন, সন্দেহ নাই। বাংলাদেশে উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশাগত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের বসবাস তখন করিতেছিলেন কি না এ সম্বন্ধে হলায়ূধ কোনও কথা বলেন নাই; তবু, সামলবর্মণ ও হরিবর্মণের সঙ্গে কুলজী কাহিনীর সম্বন্ধ, তাহাদের মোটামুটি তারিখ, অনিরুদ্ধ ভট্ট এবং হলায়ূধ কথিত রাঢ়ে-বরেন্দ্রীতে বেদচর্চার অভাব এবং সঙ্গে সঙ্গে উৎকল ও পশ্চিম দেশসমূহে বেদজ্ঞানের প্রসার, পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য এই দুই শাখায় বৈদিক ব্রাহ্মণের শ্রেণীবিভাগ, এইসব দেখিয়া মনে হয় সেন-বর্মণ আমলেই বাংলায় বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের উদ্ভব দেখা দিয়াছিল।
এই সব শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ ছাড়াও আরও দুই তিন শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের সংবাদ এই যুগেই পাওয়া যাইতেছে। গয়াজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে প্রাপ্ত একটি লিপিতে (১০৫৯ শক = ১১৩৭) দেখিতেছি, শাকদ্বীপগত মগব্রাহ্মণপরিবার সম্ভূত জনৈক ব্রাহ্মণ গঙ্গাধর জয়পাণি নাম গৌড়রাষ্ট্রের একজন কর্মচারীর কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন।(৩) এই লিপি এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণ গ্রন্থের সাক্ষ্য হইতে দেবল বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের পরিচয় জানা যায়। শেষোক্ত গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হইতেছে, দেবল ব্রাহ্মণেরা শাকদ্বীপ হইতে আসিয়াছিলেন, এবং সেই হেতু তাঁহারা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। বল্লালসেনের “দানসাগর” গ্রন্থে সারস্বত নামে আর এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণের খবর পাওয়া যাইতেছে। কুলজী গ্রন্থের মতে ইঁহারা আসিয়াছিলেন সরস্বতীনদীর তীর হইতে অন্ধ্ররাজ শূদ্রকের আহবানে। শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের উদ্ভব সম্বন্ধে কুলজী গ্রন্থে কিন্তু অন্য কাহিনী দেখা যাইতেছে; এই কাহিনী মতে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের পূর্ব পুরুষরা গ্রহবিপ্র নামে পরিচিত ছিলেন, এবং ইহারা বাংলাদেশে প্রথম আসিয়াছিলেন গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে, শশাঙ্কেরই আহবানে —তাহার রোগমুক্তি উদ্দেশে গ্রহযজ্ঞ করিবার জন্য। বৃহদ্ধর্মপুরাণে দেখিতেছি দেবল অর্থাৎ শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ পিতা এবং বৈশ্যমাতার সন্তানরা গ্রহবিপ্র বা গণক নামে পরিচিত হইতেছেন। যাহাই হউক ব্রহ্মবৈবর্ত পুবাণ গ্রন্থে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে গণক বা গ্রহবিপ্রর (এবং সম্ভবতঃ, দেবল-শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণরাও) ব্রাহ্মণ সমাজে সম্মানিত ছিলেন না; গণক-গ্রহবিপ্ররা তো ‘পতিত’ বলিয়াই গণ্য হইতেন, এবং সেই পাতিত্যের কারণ বৈদিক ধর্মে তাঁহাদের অবজ্ঞা, জ্যোতিষ ও নক্ষত্রবিদ্যায় অতিরিক্ত আসক্তি এবং জ্যোতির্গণনা করিয়া দক্ষিণা গ্রহণ। এই গণক বা গ্রহবিপ্রদেরই একটি শাখা অগ্ৰদানী ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত ছিলেন, ইঁহারাও ‘পতিত’ বলিয়া গণ্য হইতেন, কারণ তাঁহারাই সর্ব প্রথম শূদ্রদের নিকট হইতে এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দান গ্রহণ করিয়াছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই ভট্ট ব্রাহ্মণ নামে আর এক নিম্ন বা পতিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণের খবর পাওয়া যাইতেছে; সূত পিতা এবং বৈশ্য মাতার সন্তানরাই ভট্ট ব্রাহ্মণ, এবং অন্যলোকের যশোগান করাই ইঁহাদের উপজীবিকা, এ-সংবাদও এই গ্রন্থে পাওয়া যাইতেছে। ইহারা নিঃসন্দেহে বর্তমান কালের ভাট ব্রাহ্মণ। এখানেও পতিত ব্রাহ্মণদের তালিকা শেষ হইতেছে না। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে দেখিতেছি শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের উত্তম সঙ্কর পর্যায়ের ২০ বিশটি উপবর্ণ ছাড়া (ইঁহারা সকলেই শূদ্র) আর কাহাদেরও পূজানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করিতে পারিতেন না; মধ্যম ও অধর্ম সঙ্কর বা অন্ত্যজ পর্যায়ের কাহারও পৌরোহিত্য করিলে তিনি ‘পতিত’ হইয়া যজমানের বর্ণ বা উপবর্ণ প্রাপ্ত হইতেন। মধ্যযুগের ও বর্তমান কালের ‘বর্ণ ব্রাহ্মণ’দের উৎপত্তি এইভাবেই হইয়াছে। স্মার্ত ভবদেব ভট্ট বলিতেছেন, এই সব ব্রাহ্মণদের স্পৃষ্ট খাদ্য যথার্থ ব্রাহ্মণদের খাওয়া নিষেধ, খাইলে যে অপরাধ হয় তাহার প্রায়াশ্চিত্ত স্বরূপ কৃচ্ছ্রসাধনের বিধানও তিনি দিয়াছেন। এই বিধিনিষেধ ক্রমশঃ কঠোরতর হইয়া মধ্যযুগেই দেখা গেল, পতিত বৰ্ণব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে বৈবাহিক আদান প্রদান দূরে থাক্ তাঁহাদের স্পৃষ্ট জলও যথার্থ ব্রাহ্মণের পান করিতেন না। তাহা ছাড়া কতকগুলি বৃত্তি ছিল ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ; ভবদেব ভট্ট তাহার এক সুদীর্ঘ তালিকা দিয়াছেন। ব্রাহ্মণদের তো প্রধান বৃত্তিই ছিল ধর্ম কর্মানুষ্ঠান এবং অন্যের ধর্মানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য, শাস্ত্রাধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা। অধিকাংশ ব্রাহ্মণই তাহা করিতেন, সন্দেহ নাই। তাঁহাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক রাজা ও রাষ্ট্র, ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের কৃপা লাভ করিয়া দান ও দক্ষিণাস্বরূপ প্রচুর অর্থ ও ভূমির অধিকারী হইতেন, এমন প্রমাণেরও অভাব নাই। আবার অনেক ব্রাহ্মণ ছোটবড় রাজকর্মও করিতেন; ব্রাহ্মণ রাজবংশের খবরও পাওয়া যায়। পাল আমলে দর্ভপাণি কেদারমিশ্রের বংশ, বৈদ্যদেবের বংশ, বর্মণরাষ্ট্রে ভবদেবভট্টের বংশ, সেনরাষ্ট্রে হলায়ূধের বংশ একদিকে যেমন উচ্চতম রাজপদ অধিকার করিতেন, তেমনই আর একদিকে শাস্ত্রজ্ঞানে, বৈদিক যাগযজ্ঞ আচারানুষ্ঠানে, পাণ্ডিত্যে ও বিদ্যাবত্তায় সমাজেও তাঁহাদের স্থান ছিল খুব সম্মানিত। ব্রাহ্মণেরা যুদ্ধে নায়কত্ব করিতেন, যোদ্ধৃ ব্যবসায়ে লিপ্ত হইতেন এমন প্রমাণও পাওয়া যাইতেছে। কিন্তু পূর্বোক্ত ভবদেবের তালিকায় দেখিতেছি, অনেক নিষিদ্ধবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণদের পক্ষে শূদ্রবর্ণের অধ্যাপনার, তাহদের পূজাতুষ্টানে পৌরোহিত্য, চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা, চিত্র ও অন্যান্য বিভিন্ন শিল্পবিদ্যার চর্চা প্রভৃতি বৃত্তিও নিষিদ্ধ ছিল; করিলে পতিত হইতে হইত। অথচ কৃষিবৃত্তি নিষিদ্ধ ছিল না; যুদ্ধবৃত্তিতে আপত্তি ছিল না; মন্ত্রী, সন্ধিবিগ্রহিক, ধর্মাধ্যক্ষ বা সেনাধ্যক্ষ হইলে কেহ পতিত হইত না! অথচ বর্ণবিশেষের অধ্যাপনা বা পৌরোহিত্য নিষিদ্ধ ছিল।