—————
(১) IH Q. lX, 282 pp.
(২) Sastri H. P.-Cat of Mss. Nepal, I, 117 p, Mss. No, 4078.
(৩) Sastri, H. P.–Cat. of Mss. Nepal.
(৪) এই অনুলিপিটি প্রস্তুত করিয়াছিলেন সোহিথতরী গ্রামনিবাসী কুটুম্বিক উচ্চমহত্তম শ্ৰীমাধবমিত্রের পুত্ৰ মহত্তম স্ত্রীরামদেবের স্বার্থ-পরার্থের জন্য “সদ্বৌদ্ধ করণ কায়স্থ ঠকুর” শ্ৰীঅমিতাভ। কোন এক সময়ে পুঁথিখানা গুণকীর্তি “ভিক্ষুপাদানাং” অধিকারে ছিল। Sastri, H. P.–Cat. of Mss. Nepal.
(৫) এই যুগের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিনিধি হলায়ূধ সন্দেহ নাই। তাঁহার “ব্রাহ্মণ সর্বস্বের” গোড়াতেই আত্মপ্রশস্তিমূলক কয়েকটি শ্লোক আছে, তাহার একটি এই :–
পাত্ৰং দারুময়ং ক্কচিদ্ বিজয়তে ক্কচিৎ ভাজনং
কুত্রাপ্যস্তি দুকূলমিন্দুধবলং কুত্রাপি কৃষ্ণাজিনম্।
ধূপঃ ক্বাপি বষট্কৃতাহুতিকৃতো ধূমঃ পরঃ ক্বাপ্যভূদ্
অগ্নে কর্মফলং চ তস্য যুগপজ্জাগতি ষন্মন্দিরে।।
[ হলযুধের নিজের গৃহে ] কোথায়ও কাঠের [ যজ্ঞ ] পাত্র [ ছড়াইয়া আছে ], কোথাও বা স্বর্ণপাত্র [ ইতাদি)। কোথাও ইন্দূধবল দুকুলবস্ত্র; কোথাও কৃষ্ণমৃগচৰ্ম্ম। কোথাও ধূপের [গন্ধময় ধূম] কোথাও বষট্কার ধ্বনিময় আহুতির ধূম। [ এইভাবে তাঁহার গৃহে ] অগ্নির এবং [তাঁহার নিজের ] কর্মফল যুগপৎ জাগ্রত।
ইহাই ব্রাহ্মণ্য সেন-রাষ্ট্রের ভাবপরিমণ্ডল। হলায়ূধ-গৃহের ভাবকল্পনাই সমসামরিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ভাবকল্পনা।
» ২০. পরিণতি
ভিন্-প্রদেশী বর্মণ ও সেনাধিপত্য সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই (তখন পাল পর্বের শেষ অধ্যায়) বাংলার ইতিহাস-চক্র সম্পূর্ণ আবর্তিত হইয়া গেল। বৈদিক, আর্য ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি বাংলাদেশে গুপ্ত আমল হইতেই সবেগে প্রবাহিত হইতেছিল, সে-প্রমাণ আমরা আগেই পাইয়াছি। তিনশত সাড়েতিনশত বৎসর ধরিয়া এই প্রবাহ চলিয়াছে। বৌদ্ধ খড়গ-পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের কালেও তাহা ব্যাহত হয় নাই; বরং আমরা দেখিয়াছি সামাজিক আদর্শ ও অনুশাসনের ক্ষেত্রে এইসব রাষ্ট্র ও রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য আদর্শ ও অনুশাসনকেই মানিয়া চলিত, কারণ সেই আদর্শ ও অনুশাসনই ছিল বৃহত্তর জনসাধারণের, অন্ততঃ উচ্চতর স্তর সমূহের লোকদের আদর্শ ও অনুশাসন। কিন্তু, বৌদ্ধ বলিয়াই হউক বা অন্য সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণেই হউক, পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ ও অনুশাসনের একটা ওদার্য ছিল—তাহার দৃষ্টান্ত সত্য সত্যই অফুরন্ত– ব্রাহ্মণ্য সামাজিক আদর্শকেই একটা বৃহত্তর সমন্বিত ও সমীকৃত আদর্শের রূপ দিবার সজাগ চেষ্টা ছিল; অন্যতর সামাজিক যুক্তিপদ্ধতি ও আদর্শকে অস্বীকার করার কোনও চেষ্টা ছিল না, কোনও সংরক্ষণী মনোবৃত্তি সক্রিয় ছিল না। সেন-বর্মণ আমলে কিন্তু তাহাই হইল; সমাজ ব্যবস্থায় কোনও ঔদার্য, অন্যতর আদর্শ ও ব্যবস্থার কোনও স্বীকৃতিই আর রহিল না; ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এবং তদনুযায়ী সমাজ ও বর্ণ ব্যবস্থা একান্ত হইয়া উঠিল; তাহারই সবর্ণময় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হইল—রাষ্ট্রের ইচ্ছায় ও নির্দেশে।
ফল যাহা ফলিবার সঙ্গে সঙ্গেই ফলিল। বর্ণবিন্যাসের ক্ষেত্রে তাহার পরিপূর্ণ রূপ দেখিতেছি সমসাময়িক স্মৃতি গ্রন্থাদিতে, বৃহদ্ধর্ম পুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে, সমসাময়িক লিপিমালায় এবং কিছু কিছু পরবর্তী কুলজী গ্রন্থমালায়।
২১. ব্রাহ্মণ (ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বর্ণব্যবস্থা)
ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বর্ণব্যবস্থার চূড়ায় থাকিবেন স্বয়ং ব্রাহ্মণেরা ইহা ত খুবই স্বাভাবিক। নানা গোত্র, প্রবর ও বিভিন্ন বৈদিক শাখানুষ্ঠায়ী ব্রাহ্মণের যে পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই উত্তর ভারত হইতে বাংলাদেশে আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহা তো আমরা আগেই দেখিয়াছি। “মধ্যদেশ-বিনির্গত” ব্রাহ্মণদের সংখ্যা অষ্টম শতক হইতে ক্রমশঃ বাড়িয়াই যাইতে আরম্ভ করিল; ক্রোড়ঞ্চি-ক্রোড়ঞ্জ (= কোলাঞ্চ), তর্কারি (যুক্তপ্রদেশের শ্রাবস্তী অন্তর্গত), মৎস্যাবাস কুন্তীর, চন্দবার (এটোয়া জেলার বতর্মান চান্দোয়ার), হস্তিপদ, মুক্তাবাস্তু এমন কি সুদূর লাট (গুজরাত) দেশ হইতে ব্রাহ্মণ পরিবারদের বাংলাদেশে আসিয়া বসবাসের দৃষ্টান্ত এ যুগের লিপিগুলিতে সমানেই পাওয়া যাইতেছে।(১) ইহার এদেশে আসিয়া পূর্বাগত ব্রাহ্মণদের এবং তাহাদের অগণিত বংশধরদের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া গিয়াছিলেন, এইরূপ অনুমানই স্বাভাবিক।
————–
(১) Ep. Ind. XIII 292 p.; Insc of Bengal, 24, 67, 157, pp: গৌড়লেখমালা, ২৬-২৭, ৯৭ পৃ; Ep. Ind. XXII, 15P P; XV, 293 p, ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৪, ১ম খণ্ড, ২৬৪ পৃ।
২২. গাঞী বিভাগ
কুলজীগ্রন্থের আদিশূর-কাহিনীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া বর্ণকাহিনী রচনার প্রয়োজন নাই; লিপিমালা ও সমসাময়িক স্মৃতিগ্রন্থাদির সাক্ষ্যই যথেষ্ট। পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই দেখিতেছি ভট্ট, চট্ট, বন্দ্য ইত্যাদি গ্রামের নামে পরিচয় দিবার একটি রীতি ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেখা যাইতেছে; নিঃসংশয়ে বলিবার উপায় নাই, কিন্তু মনে হয় গাঞী পরিচয় রীতির তখন হইতেই প্রচলন আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু তখনও বিধিবদ্ধ, প্রথাবদ্ধ হয় নাই। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে কিন্তু এই রীতি একেবারে সুনির্দিষ্ট সীমায় প্রথাবদ্ধ নিয়মবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। ভবদেব ভট্টের মাতা বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ কন্যা; “টাকাসর্বস্ব” গ্রন্থের রচয়িতা আর্তিহরপুত্র সর্বানন্দ (১১৫৯-৬০) বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ(১) ভবদেব স্বয়ং এবং শান্ত্যাগরাধিকৃত ব্রাহ্মণ রামদেবশৰ্ম্মা উভয়েই সাবর্ণগোত্রীয় এবং সিদ্ধল গ্রামীয়;(২) বল্লালগুরু অনিরুদ্ধভট্ট চম্পাহিটী বা চম্পহট্টীয় মহামহোপাধ্যায়,(৩) মদনপালের মনহলি লিপির দানগ্রহীতা বটেশ্বরও চম্পহট্টীয়;(৪) জীমূতবাহন আত্মপরিচয় দিয়াছেন পারিভদ্রীয় বলিয়া।(৫) দশরথদেবের আদাবাড়ী লিপিতে দিণ্ডী, পালি বা পালী, সেউ, মাসচটক বা মাসচড়ক, মূল, সেহন্দায়ী, পুতি, মহান্তিয়াড়া এবং করঞ্জ প্রভৃতি গাঞী পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। হলায়ূধের মাতৃপরিচয় গোচ্ছাষণ্ডী গ্রামীয়রূপে,(৬) লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি শ্ৰীনিবাসের মহিন্তাপনীবংশ পরিচয়ও গাঞী পরিচয়।(৭) বরেন্দ্রীর তটক, মৎস্যাবাস; রাঢ়ার ভূরিশ্রেষ্ঠী, পূর্বগ্রাম, তালবাটী, কাঞ্জিবিল্লী এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক গ্রামের (যথা, ভট্টশালী, শকটী, রত্নামালী, তৈলপাটী, হিজ্ জলবন, চতুর্থ খণ্ড, বাপডলা) ব্রাহ্মণদের উল্লেখ সমসাময়িক লিপি ও গ্রন্থাদিতে পাওয়া যাইতেছে।(৮) সংকলয়িতা শ্রীধর দাসের “সদুক্তিকর্ণামৃত” (১২০৬) গ্রন্থেও দেখিতেছি বাঙালী ব্রাহ্মণদের নামের সঙ্গে—বর্তমান ক্ষেত্রে নামের পূর্বে—গ্রামের নাম অর্থাং গাঞী পরিচয় ব্যবহারের রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, যথা, ভট্টশালীয় পীতাম্বর, তৈলপাটীয় গাঙ্গোক, কেশরকোলীয় নাথোক, বন্দিঘটীয় সর্বানন্দ, ইত্যাদি।(৯) এইসব গাঞী পরিচয় অল্পবিস্তর পরিবর্তিতরূপে কুলজীগ্রন্থমালার রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পঞ্চগোত্রে বিভক্ত ১৫৬টা গাঞী পরিচয়ের মধ্যেই পাওয়া যায়। কালক্রমে এই গাঞী পরিচয়প্রথা বিস্তৃত হইয়াছে, বিধিবদ্ধ হইযাছে এবং সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত হইয়াছে; এই সীমিত, বিধিবদ্ধ প্রথারই অস্পষ্ট পরিচয় আমরা পাইতেছি কুলজীগ্রন্থমায়।