ত্রিপুরা-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেববংশের লিপিগুলিতেও অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। এই রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী এবং বিষ্ণুভক্ত। এই বংশের অন্যতম রাজা দামোদর একবার জনৈক যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ পৃথ্বীধরশর্মণকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। বোধ হয়, এই বংশেরই আর একজন রাজা, অরিরাজ দনুজমাধব শ্ৰীদশরথদেবের (= কুলজী গ্রন্থের দনুজমাধব = মুসলমান ঐতিহাসিকদের সোনারগাঁর রাজা, দনুজ রায়) আদাবাড়ী লিপি দ্বারা যে সমস্ত ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করা হইয়াছে তাহাদের গাঞী পরিচয় আছে; যথা, সন্ধ্যাকর, শ্রীমাক্রি (দিণ্ডী গাঞী), শ্রীশক্র, শ্রীসুগন্ধ (পালি গাঞী), শ্ৰীসোম (সিউ গাঞী), শ্ৰীবাদ্য (পালি গাঞী) শ্ৰীপণ্ডিত (মাসচটক গাঞী), শ্ৰীমাণ্ডী (মূল গাঞী), শ্রীরাম (দিণ্ডী গাঞী), শ্ৰীলেঘু (সেহন্দায়ী গাঞী), শ্ৰীদক্ষ (পুতি গাঞী), শ্ৰীভট্ট (সেউ-গাঞী,), শ্রীবালি (মহান্তিযাড়া গাঞী), শ্ৰীবাসুদেব (করঞ্জ গ্রামী), এবং শ্রীমিকো (মাসচড়ক গাঞী), ইত্যাদি। গাঞীপ্রথার প্রচলন ভবদেবভট্টের কালেই আমরা দেখিয়াছি; বোধ হয় তাহারও বহু পূর্বে গুপ্ত আমলেই এই প্রথা প্রবর্তিত হইয়া থাকিবে (গুপ্ত আমলের লিপিগুলিতে ভট্ট, বন্দ, চট্ট, প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য পদবী-পরিচয গাঞী-পরিচয় হওয়াই সম্ভব)। ত্রয়োদশ শতকে এই প্রথা একেবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। আদাবাড়ী লিপির গাঞী তালিকায় রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র উভয গাঞী পরিচয়ই মিলিতেছে।
১৯. বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি ব্রাহ্মণ-তন্ত্রের ব্যবহার
এই সুবিস্তৃত লিপি-সংবাদ হইতে কযেকটি তথ্য সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিতেছে। প্রথমত, বিভিন্ন বাষ্ট্রের ও রাজবংশের সুদীর্ঘ দানতালিকায় বৌদ্ধধৰ্ম্ম ও সংঘে একটি দানের উল্লেখও নাই। অথচ বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব তখনও ছিল, লক্ষ্মণসেনের তর্পণদীঘি লিপিতেই তাহার প্রমাণ আমরা দেখিয়াছি। তাহা ছাড়া রণবঙ্কমল্ল হরিকাল দেবের (১২২০) পট্টিকেরা লিপিও তাহার অন্যতম সাক্ষ্য; এই লিপিতে হরিকাল কর্তৃক পট্টিকেরা নগরের এক বৌদ্ধবিহারে একখণ্ড ভূমিদানের উল্লেখ আছে। এই লিপিতেই দুর্গোত্তারা নামক বৌদ্ধ দেবীমূর্তির এবং সহজধর্মেরও উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। (১) আরও প্রমাণ আছে। পঞ্চরক্ষা নামক মহাযানগ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপির পুষ্পিকা অংশে(২) “পরমেশ্বর পরমসৌগত-পরমমহারাজাধিরাজ শ্ৰীমন্ গৌড়েশ্বর-মধুসেন-দেবপাদানাং বিজয়রাজ্যে” উল্লেখ হইতে জানা যায় ১২১১ শকে (= ১২৮৯) মধুসেন নামক একজন বৌদ্ধ রাজা গৌড়ে রাজত্ব করিতেছিলেন। বর্মণরাষ্ট্রেও বৌদ্ধ মহাযান মতের অস্তিত্ব ছিল। “লঘু কালচক্র” নামক মহাযান গ্রন্থের “বিমলপ্রভা” নামীয় টীকার একটি পুঁথি লেখা হইয়াছিল হরিবর্মদেবের ৩৯ রাজ্যাঙ্কে, এবং ৪৬ রাজ্যাঙ্কে অর্থাৎ সাত বৎসর পর, “পূর্বোত্তর দিশাভাগে বেংগদ্যাস্তথা কূলে” গৌরী নামে একটি (বৌদ্ধ?) মহিলা স্বপ্নে আদিষ্ট হইয়াছিলেন গ্রন্থটি নিয়মিত বাচনের জন্য।(৩) এই বেংগ নদী, মনে হয়, যশোর কি ফরিদপুর জেলার কোনও নদী। এই অঞ্চলেই পঞ্চদশ শতকেও বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায় ১৪৯২ সংবতের (= ১৪৩৬) মহাযান মতের বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিচযাঁবতারের একটি অতুলিপি হইতে।(৪) পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের আমলে বৌদ্ধ রাজবংশের যে ঔদার্য ছিল সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের সে ঔদার্যের এতটুকু চিহ্ন কোথাও দেখা যাইতেছে না। কান্তিদেবের পিতা বৌদ্ধ ধনদত্ত একজন পরম শিবভক্ত রাজকুমারীকে বিবাহ করিয়াছিলেন এবং নিজের সুভাষিত-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে ব্যুৎপত্তির কথা বলিতে গিয়া গবর্ণনুভব করিয়াছিলেন। তাহার পুত্ৰ কান্তিদেব নিজে বৌদ্ধ হইয়াও তাঁহার রাজকীয় শীলমোহরে বৌদ্ধ পিতা ও শৈব মাতা উভয়ের ধর্মের সমন্বিত রূপ উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। এই ধরণের বহু দৃষ্টান্ত আগেও উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শের সেই উদারতার যুগ আর ছিল না। সেন-বর্মণদের আমলে এই ঔদার্যের এতটুকু দৃষ্টান্ত কোথাও নাই। দ্বিতীয়তঃ, সেন-বর্মণ-দেব রাষ্ট্র ও রাজবংশ বাংলার অতীত সামাজিক বিবর্তনের ধারা, বিশেষভাবে, গৌরবময় পাল-চন্দ্র যুগের ধারা, গতি প্রকৃতি ও আদর্শ একেবারে অস্বীকার করিয়া বৈদিক ও পৌরাণিক যুগ বাংলাদেশে পুনঃপ্রবর্তন করিতে চাহিয়া ছিলেন। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-কালিদাস-ভবভূতি যে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য আদর্শের কথা বলিয়াছেন সেই ব্রাহ্মণ্য আদর্শ সমাজ-জীবনে সঞ্চার করিবার প্রয়াস লিপিগুলিতে এবং সমসাময়িক সাহিত্যে সুস্পষ্ট।(৫) কনক-তুলাপুরুষ মহাদান, ঐন্দ্ৰীমহাশাস্তি, হেমাশ্বমহাদান, হেমাশ্বরথদান প্রভৃতি যাগযজ্ঞ; সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থান দ্বাদশীতিথি, উত্তরায়ণ সংক্রান্তি প্রভৃতি উপলক্ষে স্নান, তৰ্পণ, পূজানুষ্ঠান; শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফলাকাঙ্ক্ষা; বিভিন্ন বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণের পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ; গোত্র, প্রবর, গাঞী প্রভৃতির বিশদ বিস্তৃত পরিচয়োল্লেখ; দুর্বাতৃণ জলসিক্ত করিয়া দানকার্য সমাপন; নীতিপাঠক শান্ত্যাগারিক, প্রভৃতি ব্রাহ্মণদের উপর রাষ্ট্রের কৃপাবৰ্ষণ ইত্যাদির সামাজিক ইঙ্গিত অত্যন্ত সুস্পষ্ট—সে ইঙ্গিত পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য আদশের প্রচলন এবং পাল-চন্দ্র যুগের সমন্বয় ও সমীকরণাদশের বিলোপ। বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন ধর্মণদশের সহজ স্বাভাবিক বিবর্তিত সমন্বয় নয়, ঔদার্যময় বিন্যাস নয়, এক বর্ণ, এক ধর্ম ও সমাজাদশের একাধিপত্যই সেন-বৰ্মণ যুগের একতম কামনা ও আদর্শ। সে বর্ণ ব্রাহ্মণ বর্ণ। সে ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। এবং সে সমাজাদর্শ পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের আদর্শ। এই কালের স্মৃতি-ব্যবহার-মীমাংসা গ্রন্থে আগেই দেখিয়াছি ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য আদর্শের জয়জয়কার; লিপিমালায়ও তাহাই দেখিলাম। সেই আদর্শই হইল সমাজ-ব্যবস্থার মাপকাঠি। রাষ্ট্রের শীর্ষে যাহারা আসীন সেই রাজার, এবং রাষ্ট্রের যাহারা প্রধানতম সমর্থক সেই ব্রাহ্মণের দুইয়ে মিলিয়া এই আদর্শ ও মাপকাঠি গড়িয়া তুলিলেন—পরস্পরের সহযোগীতায়, পোষকতায় ও সমর্থনে, এবং মূর্তিতে, মন্দিরে, রাজকীয় লিপিমালায়, স্মৃতি, ব্যবহার ও ধর্মশাস্ত্রে, সর্বথা সর্ব উপায়ে এই আদর্শ ও মাপকাঠি সবলে সোৎসাহে প্রচার করিলেন। পশ্চাতে যেখানে রাষ্ট্রের সমর্থন সেখানে এই প্রচার কার্য ও ঈপ্সিত সমাজ-ব্যবস্থার দ্রুত প্রচলন সার্থক হইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়।