তবে, সেন-বর্মণ আমলে বাংলাদেশে প্রচুর স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। সেগুলি কখন কোন রাজার আমলে ও পোষকতায় কে রচনা করিযাছিলেন তাহা সুনির্ধারিত ও সুবিদিত। সমস্ত স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ কালের হাত এড়াইয়া আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছায় নাই; অনেক গ্রন্থ লুপ্ত হইয়া অথবা হারাইয়া গিয়াছে। কিছু কিছু যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে ভবদেব ভট্টের ও জীমূতবাহনের কয়েকটি গ্রন্থই প্রধান। এই সব স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করিতে কোনও বাধা নাই; এবং লিপিমালায় যে-সব তথ্য পাওয়া যায়, সে-সব তথ্য এই স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থের সাহায্যে ব্যাখ্যা করিলে অনৈতিহাসিক বা অযৌক্তিক কিছু করা হইবে না।
স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ ছাড়া অন্তত দুইটি অর্বাচীন পুরাণ-গ্রন্থ বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, গোপালভট্ট-আনন্দভট্টকৃত বল্লালচরিত, এবং বাংলার কুলজী গ্রন্থমালায় হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছু পা ওয়া যায়। কিন্তু ইহাদের একটিকেও সমসামযিক সাক্ষ্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। সেইজন্য ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ইহার কতখানি নির্ভরযোগ্য সে-বিচার আগেই একটু সংক্ষিপ্ত ভাবে করিয়া লওয়া প্রযোজন।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের (১) ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে কিছু কিছু বিচারালোচনা হইয়াছে।(২) প্রথমোক্ত পুরাণটিতে পদ্মা ও বাংলাদেশের যমুনা নদীর উল্লেখ, গঙ্গার তীর্থমহিমার সবিশেষ উল্লেখ, ব্রাহ্মণের মাছমাংস খাওয়ার বিধান (যাহা ভারতবর্ষের আর কোথাও বিশেষ নাই) ব্রাহ্মণেতব সমস্ত শূদ্রবর্ণের ছত্রিশটি উপ ও সংকর বর্ণে বিভাগ (বাংলার থাকথিত ‘ছত্রিশ জাত’ যাহা ভারতবর্ষে আর কোথাও দেখা যায় না) ইত্যাদি দেখিয়া মনে হয় এই পুরাণটির লেখক বাঙালী না হইলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাহার সবিশেষ পরিচয় ছিল। ক্ষত্রিম এবং বৈশ্য বর্ণের পৃথক অনুল্লেখ, ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ পর্যায়ে শূদ্রদের দুই ভাগ, ব্রাহ্মণদের পরেই অম্বষ্ঠ (বৈদ্য) এবং করণ (কায়স্থ)দের স্থান নির্ণয়, শংখকার (শাঁখারী), মোদক (ময়রা), তন্তুবায়, দাস (চাষী), কর্মকার, সুবর্ণবণিক ইত্যাদি উপ ও সংকর বর্ণের উল্লেখ প্রভৃতি ও এই অনুমানের সমর্থক। বাংলাদেশের বাহিরে অন্যত্র কোথাও এই ধরনের বর্ণব্যবস্থা এবং এই সব সংকর বর্ণ দেখা যায় না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধে ও প্রায় একই কথা বলা চলে; বস্তুত, বৃহদ্ধর্মপুবাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণব্যবস্থার চিত্র প্রায় এক এবং অভিন্ন, এবং তাহা যে বাংলাদেশ সম্বন্ধেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য ইহা ও অস্বীকার করা যায় না। এই দুই গ্রন্থের রচনাকাল নির্ণয় করা কঠিন; তবে এই কাল দ্বাদশ শতকের আগে নয় এবং চতুর্দশ শতকের পরে নয় বলিয়া অনুমিত হইয়াছে।(৩) এই অনুমান সত্য বলিয়াই মনে হয়। যদি তাহা হয় তাহা হইলে বলা যায়, এই দুই পুরাণে বাংলার হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবির একটা মোটামুটি কাঠামো পাওয়া যাইতেছে।
বল্লালচরিত
বল্লালচরিত নামে দুইখানি গ্রন্থ প্রচলিত। একখানির গ্রন্থকার আনন্দভট্ট; নবদ্বীপের রাজা বুদ্ধিমন্ত খাঁর আদেশে তাঁহার গ্রন্থপনি রচিত হয়। রচনাকাল ১৫১০ খ্ৰীষ্টাব্দ।(৪) আনন্দভট্টের পিতা দাক্ষিণাত্যগত ব্রাহ্মণ, নাম অনন্তভট্ট। আর একখানি গ্রন্থ পূর্বখণ্ড, উত্তরখণ্ড ও পবিশিষ্ট এই তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডের রচল্লিতার নাম গোপালভট্ট, গোপাভট্ট নাকি বল্লালসেনের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন, এবং বল্লালের আদেশানুসারে ১৩০০ শকে নাকি গ্রন্থখানি রচিত হয়। তৃতীয় খণ্ড রাজার ক্ৰোধোৎপাদনের ভয়ে গোপালভট্ট নিজে লিখিয়া যাইতে পারেন নাই; দুই শত বৎসর পর ১৫০০ শকে আনন্দভট্ট তাহা রচনা করেন।(৫) দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে নানা কুলজীবিবরণ, বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তিকথা ইত্যাদি আছেই, তাহা ছাড়া প্রথম গ্রন্থে বল্লাল কর্তৃক বণিকদের উপর অত্যাচার, সুবর্ণবণিকদের সমাজে ‘পতিত’ করা এবং কৈবর্ত প্রভৃতি বর্ণের লোকদের উন্নীত করা প্রভৃতি যে-সব কাহিনী বর্ণিত আছে তাহারও পুনঃবিবৃতি আছে। দ্বিতীয় গ্রন্থে বল্লালের যে তারিখ দেওয়া হইয়াছে তাত বল্লালের যথার্থ কাল নয়; কাজেই গোপালভট্ট বল্লালের সমসাময়িক ছিলেন একথাও সত্য নহে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই গ্রন্থটিকে বলিয়াছিলেন ‘জাল’; আর শাস্ত্রী মহাশয় সম্পাদিত প্রথম গ্রন্থটিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলিয়াছিলেন ‘জাল’।(৬)
বল্লালচরিতের কাহিনীটি সংক্ষিপ্তাকালে উল্লেখযোগ্য।
“সেনরাজ্যে বল্লভানন্দ নামে একজন মস্তবড় ধনী বণিক ছিলেন। উদন্তপুরীর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য বল্লালসেন বল্লভানন্দের নিকট হইতে একবার এক কোটি নিষ্ক ধার করেন। বারবার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর বল্লাল আর একবার শেষ চেষ্টা কবিবার জন্য প্রস্তুত হন, এবং বল্লভানন্দের নিকট হইতে আরও দেড় কোটি সুবর্ণ (মুদ্রা) ধার চাহিয়া পাঠান। বল্লভানন্দ সুবর্ণ পাঠাইতে রাজী হন, কিন্তু তৎপরিবর্তে হরিকেলির রাজস্ব দাবি করেন। বল্লাল ইহাতে ক্রদ্ধ হইয়া অনেক বণিকের ধনরত্ব কাড়িয়া লন এবং নানাভাবে তাহদের উপর অত্যাচার করেন। ইহার পর আবার সৎশূদ্রদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিযা আহার করিতে তাঁহাদের আপত্তি আছে বলিয়া বণিকেরা রাজপ্রাসাদে এক আহারের আমন্ত্রণ অস্বীকার করে। এই প্রসঙ্গেই বল্লাল শুনিতে পান যে বণিকদের নেতা বল্লভানন্দ পালরাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিতেছেন, এবং মগধের রাজা তাহার জামাতা। বল্লাল অতিমাত্রায় ক্রুদ্ধ হইয়া সুবর্ণবণিকদের শূদ্রের স্তরে নামাইয়া দিলেন, তাহাদের পূজা অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করিলে, তাহাদের কাছ হইতে দান গ্রহণ করিলে কিংবা তাহাদের শিক্ষাদান করিলে ব্রাহ্মণেরাও ‘পতিত’ হইবেন, সঙ্গে সঙ্গে এই বিধানও দিয়া দিলেন। বণিকের তখন প্রতিশোধ লইবার জন্য দ্বিগুণ ত্রিগুণ মূল্য দিয়া সমস্ত দাসভৃত্যদের হাত করিয়া ফেলিল। উচ্চবর্ণের লোকের বিপদে পড়িয়া গেলেন। বল্লাল তখন বাধ্য হইয়া কৈবর্তদিগকে জলচল সমাজে উন্নীত করিয়া দিলেন, তাহাদের নেতা মহেশকে মহামাগুলিক পদে উন্নীত করিলেন। মালাকার, কুম্ভকার এবং কর্মকার, ইহারাও সৎশূদ্র পর্যায়ে উন্নীত হইল। সূবর্ণবণিকদের পৈতা পরা নিষিদ্ধ হইয়া গেল; অনেক বণিক দেশ ছাডিয়া অন্যত্র পলাইয়া গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বল্লাল উচ্চতর বর্ণের মধ্যে সামাজিক বিশৃংখল দেখিয়া অনেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কে শুদ্ধিযজ্ঞের বিধান দিলেন। ব্যবসায়ী নিম্নশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব একেবারে ঘুচিয়া গেল, তাহারা ব্রাহ্মণ-সমাজ হইতে ‘পতিত’ হইলেন।“