বর্মণরাষ্ট্রে যাহার সুচনা সেনবাষ্ট্রে তাহার প্রতিষ্ঠা। ব্রাহ্মণ্য সমাজ এই সময় হইতেই আত্মসংরক্ষণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও দৃঢ়কম হইয়া উঠিল। এই সংরক্ষণী মনোবৃত্তির একটা কারণ অনুমান করা কঠিন নয়। আগে দেখিয়াছি, ভবদেব ভট্ট বৌদ্ধদের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না; ইহাদের ও পাষণ্ডবৈতণ্ডিকদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ-তন্ত্রের সংরক্ষণী মনোবৃত্তি ভবদেবভট্টের রচনাতেই সুস্পষ্ট। সেন আমলে এই মনোবৃত্তি তীব্রতর হইয়া দেখা দিল। পাল আমলে বৌদ্ধ দেবদেবীব কিছু কিছু ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের সঙ্গে মিশিয়া যাইতেছিলেন, এবং শেষোক্ত দেবদেবীরাও বৌদ্ধ ও শৈবতন্ত্রে স্থান পাইতেছিলেন। বৌদ্ধসাধনমালায় ব্রাহ্মণ্য মহাকাল ও গণপতির স্থান, বৌদ্ধতন্ত্রে ব্রাহ্মণ্য লিঙ্গ এবং শৈব দেবদেবীদের স্থানলাভ এই যুগেই ঘটিয়াছিল। তাহা ছাড়া, বৌদ্ধ-তান্ত্রিক বজ্রযান, মন্ত্রযান, কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদির আচারানুষ্ঠান, সাধনপদ্ধতি, সাধনাদশ প্রভৃতি ক্রমশঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাধনপদ্ধতি ও পূজানুষ্ঠান প্রভৃতিকে স্পর্শ করিতেছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিভূদের কাছে তাহা ভাল লাগিবার কথা নয়, বিশেষতঃ ভিন্নপ্রদেশাগত বর্মণ ও সেনারাষ্ট্রের প্রভূদের কাছে। বাংলাদেশের তন্ত্রধর্মের সমাজ-প্রকৃতি সম্বন্ধে তাহাদের জ্ঞানও খুব সুস্পষ্ট থাকিবার কথা নয়। যে-ভাবেই হউক, সেন আমলের ব্রাহ্মণ্য সমাজ এইখানেই হয়ত ভবিষ্যৎ বিপদের সম্ভাবনা, এবং সমসাময়িককালের ব্রাহ্মণ্যসমাজের সামাজিক নেতৃত্ব-হীনতার কারণ খুঁজিয়া পাইয়া থাকিবেন।
১৭. স্মৃতি ও ব্যবহার শাসনের বিস্তার
যাহাই হউক, ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র রচনাকে আশ্রয় করিয়াই ব্রাহ্মণ্যসমাজের এই সংরক্ষণী মনোবৃত্তি আত্মপ্রকাশ করিল। আদি ধর্মশাস্ত্র লেখক জিতেন্দ্রিয় ও বালকের কোনও রচনা আজ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই; কিন্তু শুভাশুভকাল, প্রায়শ্চিত্ত, ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে এই দুজনেরই মতামত আলোচনা করিয়াছেন জীমূতবাহন, শূলপাণি, রঘুনন্দন প্রভৃতি পরবর্তী বাঙালী স্মার্ত ও ধর্মশাস্ত্র লেখকেরা। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ পারিভদ্রীয় গাঞী মহামহোপাধ্যায় জীমূতবাহনও এই যুগেরই লোক, এবং তিনি সুবিখ্যাত ব্যবহার মাত্রিকা, দায়ভাগ এবং কালবিবেক গ্রন্থের রচয়িতা। কুলজীগ্রন্থের মতে পারিহাল শাণ্ডিল্য গোত্রীয় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অন্যতম গাঞী। জীমূতবাহনের পরেই নাম করিতে হয় বল্লালসেনের গুরু, হারলতা এবং পিতৃ-দয়িতা গ্রন্থদ্বয়ের রচয়িতা অনিরুদ্ধভট্টের। তিনি শুধু মহামহোপাধ্যায় রাজগুরু ছিলেন না, সেনরাষ্ট্রের ধর্মাধ্যক্ষও ছিলেন। অনিরুদ্ধের বসতি ছিল বরেন্দ্রীর অন্তর্গত চম্পাহিটি গ্রামে, এবং তিনি চম্পাহিটি মহামহোপাধ্যায় আখ্যায় পরিচিত ছিলেন। কুলজীগ্রন্থের মতে চম্পটি শাণ্ডিল্য গোত্রীয় বারেন্দ্র গাঞীদের অন্যতম গাঞী। অনিরুদ্ধশিষ্য রাজা বল্লালসেন স্বয়ং একাধিক স্মৃতিগ্রন্থের লেখক। তদ্রচিত আচারসাগর ও প্রতিষ্ঠাসাগর আজও অনাবিষ্কৃত; কিন্তু দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর বিদ্যমান। দানসাগর তিনি রচনা করিয়াছিলেন গুরু অনিরুদ্ধের আদেশে; অসম্পূর্ণ অদ্ভুতসাগর পিতার আদেশে সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন পুত্র লক্ষ্মণসেন। ছান্দোগ্য মন্ত্রভাষ্য রচয়িতা গুণবিষ্ণুও এই যুগের লোক। কিন্তু এই সব স্মৃতি-ব্যবহার-ধর্মশাস্ত্র রচয়িতাদের মধ্যে সব প্রধান হইতেছেন ধর্মাধ্যক্ষ ধনঞ্জয়ের পুত্র, লক্ষ্মণসেনের মহাধর্মাধ্যক্ষ হলায়ূধ। হলায়ূধের এক ভাই ঈশান আহ্নিকপদ্ধতি সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ এবং অপর ভ্রাতা পশুপতি দুইখানি গ্রন্থ রচনা করেন, একখানি শ্রাদ্ধপদ্ধতি এবং অন্য একখানি পাকযন্ত্র সম্বন্ধে। হলায়ূধ স্বয়ং সুবিখ্যাত ব্রাহ্মণ সর্বস্ব, মীমাংসা সর্বস্ব, বৈষ্ণব সর্বস্ব, শৈব সর্বস্ব এবং পণ্ডিত সর্বস্ব প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। কিন্তু আর নামোল্লেখের প্রয়োজন নাই। এক কথায় বলা যাইতে পারে, যে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহার শাসন পরবর্তীকালে শূলপাণি-রঘুনন্দন কর্তৃক আলোচিত ও বিধিবদ্ধ হইয়া আজও বাংলাদেশে প্রচলিত তাহার সূচনা এই যুগে— বর্মণ ও সেনরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়। এই যুগে রচিত স্মৃতি-ব্যবহার গ্রন্থগুলিতে ব্রাহ্মণসমাজের সংরক্ষণী মনোবৃত্তি সুস্পষ্ট। দন্তধাবন, আচমন, স্নান, সন্ধ্যা, তর্পণ, আহ্নিক, যাগযজ্ঞ, হোম, পূজানুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্মের শুভাশুভকালবিচার, অশৌচ, আচার, প্রায়শ্চিত্ত, বিচিত্র অপরাধ ও তাহার শাস্তি, কৃচ্ছ্র, তপস্যা, গর্ভধান-পুংসবন হইতে আরম্ভ করিয়া শ্রাদ্ধ পর্যন্ত সমস্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কার, উত্তরাধিকার, স্ত্রীধন, সম্পত্তি-বিভাগ, আহার বিহারের বিচিত্র বিধিনিষেধ, বিচিত্র দানের বিবৃতি, দান-কর্মের বিচিত্ৰতর বিধিনিষেধ, তিথিনক্ষত্রের ইঙ্গিত বিচার, দৈবিক, বায়ুবিক ও পার্থিব বিচিত্র উৎপাত, লক্ষ্মণাদির শুভাশুভ নির্ণয়, বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রপাঠের নিয়ম ও কাল—এক কথায় দ্বিজবর্ণের জীবনশাসনের কোনও নির্দেশই এইসব গ্রন্থ হইতে বাদ পড়ে নাই। সমাজের বিচিত্র স্তর ও উপস্তরের, বিচিত্ৰতর বর্ণ ও উপবর্ণের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয়, বিশেষভাবে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাহদের সম্বন্ধের অসংখ্য বিধি নিষেধও এইসব স্মৃতিকর্তাদের আলোচনার বিষয়। শুধু তাহাই নয়, ইহাদের নির্দেশ অমোঘ ও সুনির্দিষ্ট। এই যুগের স্মৃতি-শাসনই পরবর্তী বাংলার ব্রাহ্মণতন্ত্রের ভিত্তি।
১৮. ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সেনরাষ্ট্র
রাষ্ট্রে এই একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন সুস্পষ্ট। তাহা না হইবারও কারণ নাই, কারণ ভবদেবের বংশ, হলায়ূধের বংশ, অনিরুদ্ধ ইঁহারা তো সকলেই রাষ্ট্রেরই সৃষ্টি এবং সে রাষ্ট্রের নায়ক হরিবর্মণ, সামল (শ্যামল) বর্মণ, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন। শেষোক্ত দুইজন তো নিজেরাই ভাবাদর্শে সমাজাদর্শে অনিরুদ্ধ-হলায়ূধের সমগোত্রীয, নিজেরাই স্মৃতিশাসনের রচয়িতা। তাহা ছাড়া, শান্ত্যাগারিক, শান্ত্যাগারিধিকৃত, শান্তিবারিক, পুরোহিত, মহাপুরোহিত, ব্রাহ্মণ-রাজপণ্ডিত, ইঁহারা রাজপুরুষ হিসাবে স্বীকৃত হইতেছেন এই যুগেই—কম্বোজ-বর্মণ-সেন রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রে ইঁহাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িতেছে, ইঁহারা রাষ্ট্রের অজস্র কৃপালাভ করিতেছেন, নানা উপলক্ষ্যে অপরিমিত ভূমিদান ইঁহারাই লাভ করিতেছেন। কাজেই রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন দেখা যাইবে, ইহা তো বিচিত্র নয়।