কম্বোজ-রাজবংশকে অবলম্বন করিয়াই এই বিবর্তনের সূচনা অনুসরণ করা যাইতে পারে। এই পার্বত্য কোমটি বোধ হয় বাংলা দেশে আসার পর আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি আশ্রয় করেন। প্রথম রাজা রাজ্যপাল ছিলেন ‘পরমসুগত’ অর্থাৎ বৌদ্ধ; কিন্তু তাঁহার পুত্র নারায়ণপাল হইলেন বাসুদেবের ভক্ত। নারায়ণপালের ছোট ভাই সম্রাট নয়পাল একবার নবমী দিবসে পূজাস্নান করিয়া শঙ্কর ভট্টারকের (শিবের) নামে জনৈক ব্রাহ্মণকে বর্ধমানভুক্তিতে কিছু ভূমি দান করেন। বৌদ্ধ রাজার বংশধরদের ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছত্রছায়ায় আশ্রয় লইতে দেখিয়া স্পষ্টই বুঝা যায় সমাজচক্র কোন দিকে ঘুরিতেছে। পালবংশের শেষের দিকেও একই চিহ্ন সুস্পষ্ট। শেষ অধ্যায়ে পালরাষ্ট্রও এই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সমাজশাসনের স্পর্শে আসিয়াছিল। পালবংশ ও পালরাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করিয়া, সেনবংশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইল; চন্দ্রবংশকে বিলুপ্ত করিয়া হইল বর্মনবংশের প্রতিষ্ঠা। যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র বিলুপ্ত হইল তাহারা উভয়ইে বাঙালী ও বৌদ্ধ, এবং যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র নূতন প্রতিষ্ঠিত হইল তাহারা উভয়েই ভিন প্রদেশাগত। উভয়েই অত্যন্ত নৈতিক ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি আশ্রয়ী। বাঙালীর সামাজিক ইতিহাসের দিক হইতে এই দু’টি তথ্যই অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক অর্থবহ।
সেন-রাজবংশ কর্ণাটাগত; তাঁহারা আগে ছিলেন ব্রাহ্মণ, পরে যোদ্ধবৃত্তি গ্রহণ করিয়া হইলেন ক্ষত্রিয়, এবং পরিচয় হইল ব্রহ্মক্ষত্র রূপে। বর্মণ-বংশ কলিঙ্গাগত বলিয়া অনুমিত, অন্ততঃ ভিন্ন প্রদেশী এবং দক্ষিণাগত, সন্দেহ নাই; এবং বর্ণহিসাবে ক্ষত্রিয়। দক্ষিণদেশ সাতবাহন এবং তৎপরবর্তী সালঙ্কায়ন, বৃহৎফলায়ন, আনন্দ, পল্লব, কদম্ব প্রভৃতি রাজবংশের সময় হইতেই নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের কেন্দ্র, যাগযজ্ঞহোম প্রভৃতি নানাপ্রকার ব্রাহ্মণ্য পূজানুষ্ঠানে গভীর বিশ্বাসী, এবং প্রচলিত বর্ণাশ্রমের উৎসাহী প্রতিপালক। দক্ষিণদেশের এই নিষ্ঠাপূৰ্ণ ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার লইয়া সেন ও বর্মণ রাজবংশ বাংলা দেশে আসিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত হইল। দেখিতে দেখিতে বাংলা দেশ যাগযজ্ঞহোমক্রিয়ার ধূমে ছাইয়া গেল, নদ-নদীর ঘাটগুলি বিচিত্র পুণ্যস্নানার্থীর মন্ত্রগুঞ্জরণে মুখরিত হইয়া উঠিল, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা, বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠান দ্রুত প্রসারিত হইল। সহজ স্বাভাবিক বিবর্তনের ধারায় এই দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয় নাই; পশ্চাতে ছিল রাষ্ট্রের ও রাজবংশের সক্রিয় উৎসাহ, অমোঘ ও সচেতন নির্দেশ। এই যুগের লিপিমালা, অসংখ্য পুরাণ, স্মৃতি, ব্যবহার ও জ্যোতিষগ্রন্থ ইত্যাদিই তাহার প্রমাণ।
১৬. ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের সূচনা
লিপি প্রমাণগুলিই আগে উল্লেখ করা যাইতে পারে। বমন-বংশ পরম বিষ্ণুভক্ত। এই রাজবংশের যে বংশাবলী ভোজবর্মণের বেলার লিপিতে পাওয়া যাইতেছে তাহার গোড়াতেই ঋষি অত্রি হইতে আরম্ভ করিয়া পৌরাণিক নামের ছড়াছড়ি, ইহাদেরই বংশে নাকি বৰ্মণ পরিবারের অভ্যুদয়। রাজা জাতবর্মণ অনেক দেশ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দিব্যকেও পর্যুদস্ত করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করিয়াছেন। এই দিব্য যে বরেন্দ্রীর কৈবর্ত নায়ক দিব্য ইহা বহুদিন স্বীকৃত হইয়াছে। দিব্যর সৈন্য আক্রমণকালে জাতবর্মণকে নিশ্চয়ই উত্তরবঙ্গে অভিযান করিতে হইয়াছিল। এই অভিযানের একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি বোধ হয় নালন্দার একটি লিপিতে পাওয়া যায়। সোমপুরের বৌদ্ধ মহাবিহার জাতবর্মণের সৈন্যরা পুড়াইয়া দিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। “সোমপুরের একটি বৌদ্ধ ভিক্ষুর গৃহ যখন বঙ্গাল-সৈন্যরা পুড়াইয়া দিতেছিল, ভিক্ষুটি তখন বুদ্ধের চরণকমল আশ্রয় করিয়া পড়িয়াছিলেন; সেইখানে সেই অবস্থাতেই তিনি স্বৰ্গত হইলেন।” বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি বর্মণ-রাষ্ট্রের মনোভাব কিরূপ ছিল এই ঘটনা হইতে তাহার কিছু পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। শুধু মাত্র এই ঘটনাটি হইতেই এতটা অনুমান নিশ্চয়ই করা চলিত না; কিন্তু যুগ-মনোভাবটাই ছিল এইরূপ। পরবর্তী সাক্ষ্য হইতে ক্রমশঃ তাহা আরও সুস্পষ্ট হইবে। এই বৰ্মণ রাষ্ট্রেরই অন্যতম মন্ত্রী স্মার্ত ভট্ট ভবদেব অগস্ত্যের মত বৌদ্ধ-সমুদ্রকে গ্রাস করিয়াছিলেন, এবং পাষণ্ডবৈতণ্ডিকদের (বৌদ্ধদের নিশ্চয়ই, নাথপন্থীরাও বটে) যুক্তিতর্ক খণ্ডনে অতিশয় দক্ষ ছিলেন বলিয়া গর্ব অনুভব করিয়াছেন। সেই রাষ্ট্রের সৈন্যরা যুদ্ধব্যপদেশে বৌদ্ধবিহারও ধ্বংস করিবে ইহা কিছু বিচিত্র নয়! জাতবর্মণের পরবর্তী রাজা সামলবর্মণের কুলজীগ্রন্থের রাজা শ্যামলবর্মণ; স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই শ্যামলবর্মণের নামের সঙ্গেই এবং অন্যমতে তাঁহারই পূর্ববর্তী রাজা হরিবর্মণের সঙ্গে কান্যকুব্জাগত বৈদিক ব্রাহ্মণদের শকুনসত্র যজ্ঞের কিংবদন্তী জড়িত। সামলবর্মণের পুত্র ভোজবর্মণ সাবর্ণ গোত্রীয়, ভৃগু-চ্যবন-আপ্লুবান-ঔব-জমদগ্নি প্রবর, বাজসনেয় চরণ এবং যজুৰ্বেদীয় কাণ্বশাখ, শান্ত্যাগারাধ্যক্ষ ব্রাহ্মণ রামদেবশর্মাকে পৌণ্ড্র ভুক্তিতে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। রামদেব শর্মার পূর্বপুরুষ মধ্যদেশ হইতে আসিয়া উত্তর-রাঢ়ার সিদ্ধলগ্রামে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। সিদ্ধলগ্রামে সাবর্ণ গোত্রীয় ব্রাহ্মণদের বসতির কথা বর্মণ-রাজ হরিবর্মণ-দেবের মন্ত্রী ভট্ট ভবদেবের লিপিতেও দেখা যাইতেছে। এই লিপিতে সমসাময়িক কালের ভাবাদশ, সমাজ ও শিক্ষাদর্শ, বর্ণ-ব্যবস্থা ইত্যাদি সংক্রাস্ত অনেক খবর পাওয়া যায়। ভবদেবের মাতা সাঙ্গোক ছিলেন জনৈক বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণের কন্যা। এই সময়ে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের “গাঞী”-পরিচয় বিভাগ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্টরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিযাছে, এ সম্বন্ধে আর তাহা হইলে কোনও সন্দেহই রহিল না। ভবদেব সমসাময়িক কালের বাঙালী চিন্তানায়কদের অন্ততম; তিনি ব্রহ্মবিদ্যাবিদ্, সিদ্ধান্ত-তন্ত্র-গণিত-ফলসংহিতায় সুপণ্ডিত, হোরা শাস্ত্রের একটি গ্রন্থের লেখক, কুমারিলভট্টের মীমাংসা গ্রন্থের টীকাকার, স্মৃতিগ্রন্থের প্রখ্যাত লেখক, অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, আগমশাস্ত্র এবং অস্ত্রবেদেও তনি সুপণ্ডিত। রাঢ়দেশে তিনি একটি নারায়ণ মন্দির স্থাপন করিয়া তাহাতে নারায়ণ, অনন্ত এবং নৃসিংহের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কুমারিলভট্টের তন্ত্রবাতিক নামক মীমাংসা গ্রন্থের ভবদেবকৃত তৌতাতিতমত-তিলক নামক টীকাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ আজও বর্তমান। তাঁহার কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি বা দশকর্মপদ্ধতি ও প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ নামক দুইখানি স্মৃতিগ্রন্থ আজ ও প্রচলিত। পরবর্তী বাঙালী স্মৃতি ও মীমাংসা লেখকের ভবদেবের উক্তি ও বিচার বারবার আলোচনা করিয়াছেন। বাঙালীর দৈনন্দিন ক্রিয়াকম, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু, শ্ৰাদ্ধ বিভিন্ন বর্ণের বিচিত্র স্তর উপস্তর বিভাগের সীমা উপসীমা, প্রত্যেকের পারস্পরিক আহার বিহার, বিবাহ ব্যাপারে নানা বিধি নিষেধ, এক কথায় সর্বপ্রকার সমাজকর্মের রীতিপদ্ধতি নিয়মবিধি সুনিদিষ্ট সূত্রে গ্রথিত হইয়া সমাজশাসনের একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক, পুরোহিত-তান্ত্রিক নির্দেশ এই সর্বপ্রথম দেখা দিল। ভবদেবভট্ট পালযুগের শেষ আমলের লোক; এই সময় হইতেই এই একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সমাজশাসনের সূচনা এবং ভবদেব ভট্টই তাহার আদি গুরু। বর্মণরাষ্ট্রকে অবলম্বন করিয়াই এই ব্রাহ্মণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রসারিত হইতে আরম্ভ করিল। ভূমি প্রস্তুত হইয়াই ছিল; রাষ্ট্রের সহায়তা এবং সক্রিয় সমর্থন পাইয়া সেই ভূমিতে এই শাসন প্রতিষ্ঠালাভ করিতে বিলম্ব হইল না। এই শাসনের প্রথম কেন্দ্রস্থল হইল একদিকে রাঢ়দেশ, আর একদিকে বিক্রমপুর।