পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি প্রসার আগেই লক্ষ্য করা হইয়াছে। সমাজে ব্রাহ্মণ্য বর্ণব্যবস্থাও সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ প্রসারিত হইতেছিল। যুয়ান্-চোয়াঙ, ও মঞ্জুশ্ৰীমূল-কল্পের গ্রন্থকার শশাঙ্ককে বলিয়াছেন বৌদ্ধবিদ্বেষী। সত্যই শশাঙ্ক তাহা ছিলেন কিনা সে-বিচার এখানে অবান্তর। এই দুই সাক্ষ্যের একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি নদীয়া বঙ্গসমাজের কুলজী গ্রন্থেও আছে, এবং সেই সঙ্গে আছে শশাঙ্ক কর্তৃক সরযূনদীর তীর হইতে বারো জন ব্রাহ্মণ আনয়নের গল্প। শশাঙ্ক এক উৎকট ব্যাধিদ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিলেন; ব্যাধিমুক্তির উদ্দেশ্যে গৃহযজ্ঞ করিবার জন্যই এই ব্রাহ্মণদের আগমন। রাজানুরোধে এই ব্রাহ্মণেরা গৌড়ে বসবাস আরম্ভ করেন এবং গৃহবিপ্র নামে পরিচিত হন; পরে তাহাদের বংশধরেরা রাঢ়েবঙ্গে ও বিস্তৃত হইয়া পড়েন এবং নিজ নিজ গাঞী নামে পরিচিত হন। বাংলার বাহির হইতে ব্রাহ্মণ্যগমনের যে ঐতিহ্য কুলজী গ্রন্থে বিধৃত তাহার সূচনা দেখিতেছি শশাঙ্কের সঙ্গে জড়িত। কুলজীগ্রন্থের অন্য অনেক গল্পের মত এই গল্পও হয়তো বিশ্বাস্য নয়, কিন্তু এই ঐতিহ্য-ইঙ্গিত সৰ্বথা মিথ্যা না-ও হইতে পারে। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার বলিতেছেন, শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণের পক্ষে ব্রাহ্মণ্যপ্রীতি কিছু অস্বাভাবিক নয়, এবং বহুযুগস্মৃত শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষ কাহিনীর মূলে এতটুকু সত্যও নাই, এ-কথাই বা কি করিয়া বলা যায়। সমসাময়িক কাল যে প্রাগ্রসরমান ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও সংস্কৃতিরই কাল তাহা ত নানাদিক হইতে সুস্পষ্ট। আগেই তাহা উল্লেখ করিয়াছি। যুয়ান্ চোয়াঙ্, ইৎসিঙ্, সেংচি প্রভৃতি চীন ধৰ্ম পরিব্রাজকেরা যে সব বিবরণী রাখিয়া গিয়াছেন তাহা হইতে অনুমান করা চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থাও বেশ সমুদ্ধই ছিল, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থা তাহার চেয়েও অনেক বেশী সমুদ্ধতর ছিল। বাংলার সর্বত্র ব্রাহ্মণ দেবপূজকের সংখ্যা সৌগতদের সংখ্যাপেক্ষ অনেক বেশি ছিল, এতথ্য যুয়ান্-চোয়াঙই রাখিয়া গিয়াছেন। পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের তথা বৰ্ণব্যবস্থার প্রসার বাড়িয়াই চলিয়াছিল, এ সম্বন্ধে দেবদেবীর মূর্তি-প্রমাণই যথেষ্ট। জৈন ধর্ম ও সংস্কার তো ধীরে ধীরে বিলীন হইয়াই যাইতেছিল। আর, বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কারও ব্রাহ্মণ্য সমাজাদর্শকে ধীরে ধীরে স্বীকার করিয়া লইতে ছিল, পাল-চন্দ্র-কঙ্গোজ রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শের দিকে তাকাইলেই তাহা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। যুয়ান্-চোয়াঙ কামরূপ প্রসঙ্গে বলিতেছেন, কামরূপের অধিবাসিরা দেবপূজক ছিল, বৌদ্ধধর্মে তাঁহারা বিশ্বাস করিত না; দেবমন্দিব ছিল শত শত, এবং বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের লোকসংখ্যা ছিল অগণিত। মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি বৌদ্ধ ছিল তাঁহারা ধর্মানুষ্ঠান করিত গোপনে। এই ত সপ্তমশতক কামরূপের অবস্থা; বাংলা দেশেও তাহার স্পর্শ লাগে নাই, কে বলিবে? মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার স্পষ্টই বলিতেছেন, মাৎস্যন্যায়ের পর গোপালের অভ্যুদয় কালে সমুদ্রতীর পর্যন্ত স্থান তীৰ্থিক (ব্রাহ্মণ?) দের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল; বৌদ্ধমঠগুলি জীর্ণ হইয়া পড়িতেছিল, লোকে ইহাদেরই ইটকাঠ কুড়াইয়া লইয়া ঘরবাড়ী তৈয়ার করিতেছিল। ছোটবড় ভূস্বামীরাও তখন অনেকে ব্রাহ্মণ। গোপাল নিজেও ব্রাহ্মণানুরক্ত, এবং বৌদ্ধ গ্রন্থকার সেজন্য গোপালের উপর একটু কটাক্ষপাতও করিয়াছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের ক্রমবর্দ্ধমান প্রসার ও প্রভাব সম্বন্ধে কোন ও সন্দেহই আর করা চলে না।
১১. পালরাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ
পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগের সমসাময়িক অবস্থাটা দেখা যাইতে পারে। এ-তথ্য সুবিদিত যে পাল রাজার বৌদ্ধ ছিলেন—পরম সুগত। বৌদ্ধধর্মের তাহার পরম পৃষ্ঠপোষক, ওদন্তপুরী, সোমপুর এবং বিক্রমশীল মহাবিহারের তাঁহারা প্রতিষ্ঠাতা, নালন্দা মহাবিহারের তাঁহারা ধারক ও পোষক; বজ্রাসনের বিপুল করুণা পরিচালিত দলবল পাল রাষ্ট্রের রক্ষক। বাংলাদেশে যত বৌদ্ধ মূর্তি ও মন্দির আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা প্রায় সমস্তই এই যুগের; যত অসংখ্য বিহারের উল্লেখ পাইতেছি নানা জায়গায় জগদ্দল বিক্রমপু্রী-ফুল্লহরি-পট্টিকেরক-দেবীকোটপণ্ডিত-ত্ৰৈকূটক-পণ্ডিতসন্নগর—এই সমস্ত বিহারও এই যুগের; দেশ-বিদেশ-প্রখ্যাত যে বৌদ্ধ পণ্ডিতাচার্যদের উল্লেখ পাইতেছি তাঁহারাও এই যুগের। চন্দ্রবংশও বৌদ্ধ; জিন (বুদ্ধ), ধর্ম ও সংঘের স্বস্তি উচ্চারণ করিয়া চন্দ্রবংশীয় লিপিগুলির সূচনা; ইহাদের রাজ্য হরিকেল তো বৌদ্ধতান্ত্রিক পীঠগুলির অন্যতম পীঠ। ভিন্ন-প্রদেশাগত কম্বোজ রাজবংশ ও বৌদ্ধ, পরমসুগত।
অথচ ইঁহাদের প্রত্যেকেরই সমাজাদর্শ একান্তই ব্রাহ্মণ্য সংস্কারানুসারী, ব্রাহ্মণ্যাদর্শানুযায়ী। এই যুগের লিপিগুলি ত প্রায় সবই ভূমিদান সম্পর্কিত; এবং প্রায় সর্বত্রই ভূমিদান লাভ করিতেছেন ব্রাহ্মণেরা, এবং সর্বাগ্রে ব্রাহ্মণদের সম্মাননা না করিয়া কোন দানকার্যই সম্পন্ন হইতেছে না। তাঁহাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি রাষ্ট্রের ও সমাজের সর্বত্র। “হরিচরিত” নামক গ্রন্থের লেখক চতুর্ভূজ বলিতেছেন, তাঁহার পূর্বপুরুষের বরেন্দ্রভূমির করঞ্জগ্রাম ধৰ্মপালের নিকট হইতে দানস্বরূপ লাভ করিয়া ছিলেন। এই গ্রামের ব্রাহ্মণেরা বেদবিদ্যাবিদ এবং স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ ছিলে।(১) এই ধর্মপাল প্রসিদ্ধ পাল-নরপতি হওয়াই সম্ভব, যদিও কেহ কেহ মনে করেন ইনি রাজেন্দ্রচোল-পরাজিত ধৰ্মপাল। বৌদ্ধ নরপতি শূরপাল (প্রথম বিগ্রহপাল) মন্ত্রী কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া অনেকবার শ্রদ্ধাসলিলাপ্লুতহৃদয়ে নতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাদল প্রস্তরলিপিতে শাণ্ডিল্যগোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ মন্ত্ৰীর শৈব প্রশস্তি উৎকীর্ণ আছে; এই বংশের তিনপুরুষ বংশপরম্পরায় পালবাষ্ট্রের মন্ত্রীত্ব করিয়াছিলেন। দর্ভপাণিপুত্র মন্ত্রী কেদারমিশ্র সঙ্গন্ধে এই লিপিতে আরও বলা তইয়াছে, “তাহার [হোমকুণ্ডোত্থিত] অবক্ৰভাবে বিরাজিত সুপুষ্ট হোমাগ্নিশিখাকে চুম্বন করিয়া দিকচক্রবাল যেন সন্নিহিত হইয়া পড়িত।” তাহা ছাড়া তিনি চতুৰ্বিদ্যা-পয়োনিপি পান করিয়াছিলেন (অর্থাৎ চারি বেদবিদ ছিলেন)। কেদারমিশ্রের পুত্র মন্ত্রী গুরবমিশ্রের “বাগ্বৈভবের কথা, আগমে ব্যুৎপত্তির কথা, নীতিতে পরম নিষ্ঠার কথা… জ্যোতিষে অধিকারের কথা এবং বেদার্থচিন্তাপরায়ণ অসীম তেজসম্পন্ন তদীয় বংশের কথা ধর্মাবতার ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন।” পরমসুগত প্রথম মহীপাল বিষুবসংক্রান্তির শুভতিথিতে গঙ্গাস্নান করিয়া এক ভট্ট ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। তৃতীয় বিগ্ৰহপালও আমগাছি লিপিদ্বারা এক ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন।