কায়স্থদের বর্ণগত উদ্ভব সম্বন্ধে লিপিমালায় এবং অর্বাচীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে নানা প্রকাল কাহিনী প্রচলিত দেখা যায়। বেদব্যাস স্মৃতিমতে কায়স্থরা শূদ্রপপর্যায়ভূক্ত(১৭)। উদয়সুন্দরী কথা-গ্রন্থের লেখক কবি সোঢ্ঢল (একাদশ শতক) কায়স্থবংশীয় ছিলেন(১৮), তাহার যে বংশপরিচয় পাওয়া যাইতেছে তাহাতে দেখা যায় কায়স্থরা ক্ষত্ৰিয় বর্ণান্তর্গত বলিয়া দাবি করিতেন। ১০৪৯ খ্রীস্টাব্দের কলচুরীরাজ কর্ণের জনৈক কায়স্থ মন্ত্রীর একটি লিপিতে কায়স্থদের বলা হইয়াছে ‘দ্বিজ’ (৩৪: শ্লোক), অন্য স্থানে ইঙ্গিত করা হইয়াছে যে তাঁহারা ছিলেন শূদ্র(১৯।) ব্ৰাহ্মণেরাও যে করণবৃত্তি গ্রহণ করিতেন তাহার একাধিক লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। ভাস্করবমর্ণের নিধনপুর লিপি-কথিত জনৈক ব্রাহ্মণ জনাৰ্দন স্বাধী ছিলেন ন্যায়-করণিক। এই লিপিতে জনৈক কায়স্থ দুন্ধুনাথেরও উল্লেখ আছে(২০)। উদয়পুরের ধোড়লিপিতে (১১৭১) এক করণিক ব্রাহ্মণের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় (২১)। করণিক শব্দ এইসব ক্ষেত্রে যে বৃত্তিবাচক সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই; তবে, সাম্প্রতিক কালে কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, বাংলার কায়স্থরা নাগর ব্রাহ্মণদের বংশধর, এবং এইসব নাগর ব্রাহ্মণ পঞ্জাবের নগরকোট, গুজরাট-কাথিয়াবাড়ের আনন্দপুর (অন্য নাম নগর) প্রভৃতি অঞ্চল হইতে আসিয়াছিলেন (২২)। এই মত সকলে স্বীকার করেন না; এসম্বন্ধে একাধিক বিরুদ্ধ-যুক্তি যে আছে, সত্যই ত ই অস্বীকার কর যায় নাই (২৩)। বিদেশ হইতে নানাশ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা বাংলাদেশে আসিয়া বসবাস করিয়াছেন, তাহার প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান; কিন্তু পৃথক পৃথক বর্ণস্তর গড়িয়া তুলিবার মতন এত অধিক সংখ্যায় তাহারা কখনও আসিয়াছিলেন, এমন প্রমাণ নাই।
পাল আমলের সুদীর্ঘ চারিশত বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষের অন্যত্র বৈদ্যবংশ ও পৃথক উপবর্ণ হিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে বর্ণহিসাবে বৈদ্যের উল্লেখ নাই, অর্বাচীন স্মৃতি-গ্রন্থে চিকিৎসাবৃত্তিধাবী লোকদের বলা হইয়াছে বৈদ্যক। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বৈদ্য ও অম্বষ্ঠ সমার্থক বলিয়া ধরা হইয়াছে, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অম্বষ্ঠ ও বৈদ্য দুই পৃথক উপবর্ণ বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে (২৪)। ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার সহবাসে উৎপন্ন অম্বষ্ঠ সংকব বর্ণের উল্লেখ একাধিক স্মৃতি ও ধর্মসূত্র গ্রন্থে পাওয়া যায়। বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত অম্বষ্ঠ-বৈদ্যের অভিন্নতা পরবর্তী কালে বাংলাদেশে স্বীকৃত হইয়াছিল; চন্দ্রপ্রভা-গ্রন্থ এবং ভট্টিটীকার বৈদ্য লেখক ভরত মল্লিক (সপ্তদশ শতক) অম্বষ্ঠ এবং বৈদ্য বলিয়া আত্মপরিচয় দিয়াছেন (২৫)। কিন্তু বাংলার বাহিরে সর্বত্র এই অভিন্নতা স্বীকৃত নয়; বর্তমান বিহার এবং যুক্তপ্রদেশের কোনও কোনও কায়স্থ সম্প্রদায় নিজেদের অম্বষ্ঠ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন; এবং অন্ততঃ একটি অর্বাচীন সংহিতায় (সূত-সংহিতা) অম্বষ্ট ও মাহিষ্যদের অভিন্ন বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে। যাহা হউক, দক্ষিণতম ভারতে অষ্টম শতকেই বৈদ্য উপরর্ণের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। জনৈক পাণ্ড্যরাজার তিনটি লিপিতে(২৬) কয়েকজন বৈদ্য সামন্তের উল্লেখ পাওয়া বাইতেছে, এবং ইঁহারা প্রত্যেকেই সমসাময়িক রাষ্ট্র ও সমাজে সম্ভ্রান্ত ও পরাক্রান্ত বলিয়া গণিত হইতেন, তাহা বুঝা যাইতেছে। ইহাদের একজনের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে বৈদ্য এবং “বৈদ্যকশিখামণি” বলিয়া; তিনি একজন প্রখ্যাত সেনানায়ক এবং রাজার অন্যতম উত্তরমন্ত্রী ছিলেন। আর একজনের জন্মের ফলে বঙ্গলণ্ডৈব (পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার?) বৈদ্যকুল উজ্জ্বল হইয়াছিল; তিনি ছিলেন গীতবাদ্যে সুনিপুণ। আরও এক জনের পরিচয় বৈদ্যক হিসাবে; তিনি ছিলেন একাধারে কবি, বক্তা এবং শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত। এই লিপিগুলির বৈদ্যকুল, ‘বৈদ্য’ ‘বৈদ্যক’ শব্দগুলি ভিষক্বৃত্তিবাচক বলিয়া মনে হইতেছে না, এবং বৈদ্যকুল বলিতে যেন কোনো উপবর্ণই বুঝাইতেছে। বাংলার সমসামধিক কোনো লিপি বা গ্রন্থে এই অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে বৈদ্যক, বা বৈদ্যকবংশ বা বৈদ্যক কুলের কোনো উল্লেখ নাই। বস্তুত, তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তী পাল ও সেন-বর্মণযুগে, একাদশ শতকের পাল লিপিতে দ্বাদশ শতকে শ্রীহট্টজেলায় রাজা ঈশানদেবের ভাটেরা লিপিতে। ঈশানদেবের অন্যতম পট্টনিক বা মন্ত্রী বনমালী কর ছিলেন “বৈদ্যবংশ প্রদীপ” (২৭)। পূর্ববতী পাল-চন্দ্রযুগে বরং দেখিয়াছি শব্দপ্রদীপ গ্রন্থের লেখক, তাহার পিতা এবং প্রপিতামহ যাহাবা সকলেই ছিলেন রাজবৈদ্য বা চিকিৎসক তাহাদের আত্মপবিচয় ‘করণ’ বলিয়া সেইজন্য মনে হয়, একাদশ-দ্বাদশ শতকের আগে, অন্ততঃ বাংলাদেশে, বৃত্তিবাচক বৈদ্য-বৈদ্যক শব্দ বর্ণ বা উপবর্ণ-বাচক বৈদ্য শব্দে বিবর্তিত হয় নাই অর্থাং বৈদ্যবৃত্তিধারীরা বৈদ্য-উপরর্ণে গঠিত ও সীমিত হইয় উঠেন নাই। কিন্তু, পূর্বোক্ত পাণ্ড্যরাজার একটি লিপিতে যে বঙ্গলণ্ডৈর বৈদ্যকুলের কথা বলা হইয়াছে, এই বঙ্গলণ্ডৈ কোথায়? এই বঙ্গলণ্ডৈর সঙ্গে কি বঙ্গ-বঙ্গালজনের বা বঙ্গাল-দেশের কোনও সম্বন্ধ আছে? আমার যেন মনে হয়, আছে। এই বৈদ্যকুল বঙ্গ বা বঙ্গালদেশ (দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গ) হইতে দক্ষিণ প্রবাসে যায় নাই তো? বাংলাদেশে বৈদ্যকুল এখনও বিদ্যমান; দক্ষিণতম ভারতে কিন্তু নাই, মধ্যযুগেও ছিল বলিয়া কোনো প্রমাণ নাই। তাহা ছাড়া পূর্বোক্ত তিনটি লিপিই একটি রাজার রাজত্বের, এবং যে-তিনটি বৈদ্য-প্রধানের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহারা যেন একই পরিবারভুক্ত। এইসব কারণে মনে হয়, বৈদ্যকুলের এই পরিবারটি বঙ্গ বা বঙ্গালদেশ হইতে দক্ষিণ ভারতে গিয়া হয়ত বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। বঙ্গলণ্ডৈ হয়ত পাণ্ড্যদেশে বঙ্গ-বঙ্গাল দেশবাসীর একটি উপনিবেশ, অথবা একেবারে মূল বঙ্গ-বঙ্গালভূমি। যদি এই অনুমান সত্য হয় তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, অষ্টম শতকেই বাংলাদেশে বৈদ্য উপবর্ণ গড়িয়া উঠিয়াছিল।