————————
(১) “কায়স্থঃস্যার্ল্লিপিকয়ঃ করণোক্ষর জীবনঃ লেখকোক্ষর চূঞ্চুশ্চ”।
(২) অমরকোষ।
(৩) Ep. Ind IV, p. 14o, VIII, p. I53
(৪) Ep. Ind. I, p. 330
(৫) Kane, History of Dharmasasta.
(৬) Bhandan kar, List of Inscriptions….no. 34.
(৭) পরে দ্রষ্টব্য।
০৬. ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য
উপরে আলোচিত ও বিশ্লেষিত নামগুলির মধ্যে আর কোন কোন বর্ণ বা উপবর্ণ আত্মগোপন করিয়া আছে তাহা বলিবার উপায় নাই; অন্তত বিশেষ ভাবে কোন ও বর্ণ বা উপবর্ণ উল্লিখিত হইতেছে না। বর্মণ অন্ত্যনাম কোন ও কোন ও ক্ষেত্রে পাওয়া যাইতেছে, যেমন বেত্রবর্মণ সিংহবৰ্মণ, চন্দ্রবর্মণ ইত্যাদি। এই যুগে বর্মণান্ত নাম উত্তর-ভারতের অন্যত্র ক্ষত্রিয়ত্ব জ্ঞাপক; কিন্তু বেত্রবর্মণ, চন্দ্রবর্মণ ক্ষত্রিয় কিনা বলা কঠিন, অন্তত তেমন দাবি কেহ করিতেছেন না। রাজ-রাজন্যরা ত সাধারণত ক্ষত্রিয়ত্বের দাবি করিয়া থাকেন, কিন্তু সমসাময়িক বাংলার রাজরাজন্যদের পক্ষ হইতে ও তেমন দাবি কেহই জানায় নাই। পরবর্তী পাল রাজাদের ক্ষত্রিয়ত্বের দাবিও নিঃসংশয় নয়, কেবল বিদেশাগত কোনও কোন ও বাজবংশ এই দাবি করিয়াছেন। বস্তুত বাংলার স্মৃতি-পুরাণে ঐতিহ্যে ক্ষত্রিয় বর্ণের সবিশেষ দাবি কাহারও যেন নাই! নগরশ্রেষ্ঠ, সার্থবাহ, ব্যাপারী-ব্যবসায়ীর উল্লেখ এযুগে প্রচুর; কিন্তু তাহাদের পক্ষ হইতেও বৈশ্যত্বের দাবি কেহ করিতেছেন—সমসাময়িক কালে তো নয়ই, পরবর্তী কালেও নয়। বাংলার স্মৃতি-পুরাণ-ঐতিহ্যে বিশিষ্ট পৃথক বর্ণ হিসাবে বৈশ্যবর্ণের স্বীকৃতি নাই। বল্লালচরিতে বণিক-সুবর্ণবণিকদের বৈশ্যত্বের দাবি করা হইয়াছে; কিন্তু এ সাক্ষ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। অন্যত্র কোথাও কাহারও সে দাবি নাই, স্মৃতি গ্রন্থাদিতে নাই, বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পর্যন্ত নাই। বস্তুত বাংলাদেশে কোনও কালেই ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সুনির্দিষ্ট বর্ণহিসাবে গঠিত ও স্বীকৃত হইয়াছিল বলিয়াই মনে হয় না; অন্তত তাহার সপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোনও প্রমাণ নাই। ইহার কারণ কি বলা কঠিন। বহুদিন আগে রামপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বলিয়ছিলেন, (১) বাংলার আর্যীকরণ ঋগ্বেদীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী হয় নাই, সেই জন্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য-শূদ্র লইয়া যে চাতুবৰ্ণ-সমাজ, বাংলাদেশে তাহার প্রচলন নাই। বাংলার বর্ণসমাজ অ্যাল্পীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী গঠিত, এবং অ্যালপীয় আর্য ভাষীরা ঋগ্বেদীয় আর্যভাষী হইতে পৃথক। চন্দ মহাশয়ের এই মত যদি সত্য হয় তাহা হইলে ইহার মধ্যে বাংলার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের প্রায়ানুপস্থিতির কারণ নিহিত থাকা অসম্ভব নয়। বাংলার বর্ণবিন্যাস ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রবর্ণ ও অন্তজ-ম্লেচ্ছদের লইয়া গঠিত; করণ-কায়স্থ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য এবং অন্যান্য সংকর বর্ণ সমস্তই শূদ্র-পর্যায়ে; সর্বনিম্নে অন্ত্যজ বর্ণের লোকেরা। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকের এই বর্ণবিন্যাস পঞ্চম-অষ্টম শতকে খুব সুস্পষ্টভাবে দেখা না দিলেও তাহার মোটামুটি কাঠামো এই যুগেই গড়িয়া উঠিয়াছিল, এই অনুমান করা চলে। কারণ, এই যুগের লিপিগুলিতে তিনটি দ্বিজবর্ণের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণদেরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ধরা পড়িতেছে; আর যাঁহারা, তাঁহারা এবং অন্যান্যে বিচিত্র জীবন-বৃত্তি অবলম্বন করিয়া শূদ্রান্তর্গত বিভিন্ন উপবর্ণ গড়িয়া উঠিতেছে মাত্র; ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণের কোন ইঙ্গিত-আভাস কিছুই নাই।
—————–
(১) Chanda, Indo-Aryan Races
০৭. পাল যুগ
বর্ণ হিসাবে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের ইঙ্গিত আভাস পরবর্তী পাল আমলেও(১) দেখা যাইতেছে না। একমাত্র “বামচরিত” গ্রন্থের টীকাকার পাল-বংশকে ক্ষত্রিয়-বংশ বলিয়া দাবি করিয়াছেন।(২) কিন্তু এই ক্ষত্রিয় কি বর্ণ অর্থে ক্ষত্রিয়? রাজা-রাজন্য মাত্রই তো ক্ষত্ৰিয়; সমসাময়িক কালে সব রাজবংশই তো ক্ষত্ৰিয় বলিয়া নিজেদের দাবি করিয়াছে, এবং একে অন্যের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়াছে। রাজা-রাজন্যের বিবাহ-ব্যাপারে কোন ও বর্ণগত বাধা-নিষেধ কোন ও কালেই ছিল না। তারানাথ তো বলিতেছেন গোপাল ক্ষত্রিয়াণীর গর্ভে জনৈক বৃক্ষদেবতার পুত্র(৩); এ-গল্প নিঃসন্দেহে টটেম-স্মৃতিবহ ! আবুল ফজল বলেন পাল রাজারা কায়স্থ(৪); মঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থ তাঁহাদের সোজাসুজি বলিয়াছে দাসজীবী(৫)। পালেরা বৌদ্ধ ছিলেন, এবং মনে রাখা দরকার তারানাথ এবং মঞ্জশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার দুইজনই বৌদ্ধ। পালের যে বর্ণহিসাবে দ্বিজশ্রেণীর কেহ ছিলেন না, তারানাথ, আবুল ফজল এবং শেষোক্ত গ্রন্থের লেখক সকলেব ইঙ্গিতই যেন সেই দিকে। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বর্ণের নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উল্লেখ আর কোথাও দেখিতেছি না। তবে রাজা, রাণক, রাজন্যক প্রভৃতিরা ক্ষত্ৰিয় বলিয়া নিজেদের পরিচয় দিতেন, এমন অনুমান অসম্ভব নয়, কিন্তু বর্ণ হিসাবে তাঁহারা যথার্থই ক্ষত্রিয় ছিলেন কিনা সন্দেহ। ক্ষত্রিয়-পরিবারে বিবাহ অনেক রাজাই করিয়াছেন, কিন্তু শুধু তাহাই ক্ষত্ৰিয়ত্ব জ্ঞাপক হইতে পারে না।
করণ-কায়স্থদের অস্তিত্বের প্রমাণ অনেক পাওয়া যাইতেছে। রামচরতের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা ছিলেন “করণানামাগ্ৰণী”,অর্থাৎ করণ কুলের শ্রেষ্ঠ(৬); তিনি ছিলেন পালরাষ্ট্রের সন্ধিবিগ্রহিক। শব্দপ্রদীপ নামে একখানি চিকিৎসা গ্রন্থের লেখক আত্মপরিচয় দিতেছেন “করণান্বয়”, অর্থাৎ করণ-বংশজাত বলিয়া; তিনি নিজে রাজবৈদ্য ছিলেন, তাঁহার পিতা ও প্রপিতামহ যথাক্রমে পালরাজ রামপাল ও বঙ্গালরাজ গোবিন্দ চন্দ্রের রাজবৈদ্য ছিলেন।(৭) ন্যায়কন্দলী- গ্রন্থের লেখক শ্ৰীধরের (৯৯১খ্রী) পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাণ্ডুদাস, তাঁহার পরিচয় দেওয়া হইয়াছে ‘কায়স্থ কুলতিলক’ বলিয়া(৮)। পাণ্ডুদাসের বাড়ী বাংলাদেশে বলিয়াই তো মনে হইতেছে, যদিও এসম্বন্ধে নিঃসংশয় প্রমাণ নাই। তিব্বতী গ্রন্থ পাগ্-সাম-জোন্-জা (Pag-Sam-Jon-Zang) পাল-সম্রাট ধর্মপালের এক কায়স্থ রাজকর্মচারীর উল্লেখ করিতেছেন, তাহার নাম দঙ্গদাস(৯)। জড্ঢ নামে গৌড়দেশবাসী এক করণিক খাজুরাহোর একটি লিপির (৯৫৪) লেখক(৫)। যুক্ত প্রদেশের পিলিভিট্ জেলায় প্রাপ্ত দেবল প্রশস্তির (৯৯২) লেখক তক্ষাদিত্যও ছিলেন একজন গৌড়দেশবাসী করণিক(১১)। চাহমান রাজ রায়পালের নাডোল লিপির লেখক ছিলেন (১১৪১) ঠকুর পেথড নামে জনৈক গৌড়ান্বয় কায়স্থ(১২), বীসলদেবের দিল্লী-শিবালিক স্তম্ভলিপির (১১৬৩) লেখক শ্রীপতিও ছিলেন একজন গৌড়ান্বয় কায়স্থ(১৩)। সমসাময়িক উত্তর ও পশ্চিম ভারতে করণ-কায়স্থেরা পৃথক স্বতন্ত্র বর্ণ বা বংশ বলিয়া গণ্য হইত, এসম্বন্ধে অনেক লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। রাষ্ট্রকূট অমোঘবর্ষের একটি লিপিতে (নবম শতক) বলভ-কায়স্থ বংশের উল্লেখ, ১১৮৩ বা ১১৯৩ খৃষ্টাব্দের একটি লিপিতে কায়স্থ বংশের উল্লেখ(১৪), প্রভূতি হইতে মনে হয় নবম-দশম-একাদশ শতকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সর্বত্রই কায়স্থরা বর্ণহিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল। বাস্তু হইতে উদ্ভূত এই অর্থে বাস্তব্য কায়স্থের উল্লেখ ও একাধিক লিপিতে পাওয়া যাইতেছে; একাদশ শতকের আগে এই বাস্তব্য কায়স্থেরা কালঞ্জর নামক স্থানে বাস করিত, এই তথ্যও এই লিপিগুলি হইতে জানা যাইতেছে। বুদ্ধ গয়ায় প্রাপ্ত এই আমলের একটি লিপিতে(১৫) পরিষ্কার বলা হইয়াছে যে বাস্তব্য কায়স্থেরা করণবৃত্তি অনুসরণ করিত; এবং তাহদের বর্ণ বা উপবর্ণকে যেমন বলা হইয়াছে কায়স্থ তেমনই বলা হইয়াছে করণ, অর্থাং করণ এবং কায়স্থ যে বর্ণহিসাবে সমর্থিক ও অভিন্ন তাহাই ইঙ্গিত করা হইয়াছে। নবম-দশম শতক নাগাদ বাংলাদেশেও করণ-কায়স্থেরা বর্ণহিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল, এই সঙ্গন্ধে অন্তত একটি লিপিপ্ৰমাণ বিদ্যমান। শাকম্ভরীর চাহমানাধিপ দুলৰ্ভরাজের কিনসরিযা লিপির (৯৯৯) লেখক ছিলেন গৌড়দেশবাসী মহাদেব, মহাদেবের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে “গৌড়কায়স্থবংশ” বলিয়া (১৬)।