- বইয়ের নামঃ বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন রায়
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০১. বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ
বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ
নিবেদন
বর্তমান নিবন্ধে আমি বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদের গোড়ার কথা বলিতে চেষ্টা করিয়াছি। বলা বাহুল্য, আমার দৃষ্ট ঐতিহাসিকের এবং ঐতিহাসিক বিচার ও যুক্তি-পদ্ধতি অনুযায়ী যে-সব সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রাহ্য আমি যথাসম্ভব তাহাই ব্যবহার করিয়াছি। বিষয়টি জটিল, উচ্চতর বর্ণসমাজে আচরিত এবং প্রচলিত ধারণ ও বিশ্বাস ইহাকে জটিলতর করিয়াছে। তৎসত্ত্বেও আমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী ঐতিহাসিক সত্য অবিকৃতভাবে উপস্থিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি এই বিশ্বাসে যে, আমার দেশবাসী স্বচ্ছ ও নির্মোহ দৃষ্টি লইয়া এই জটিল সমস্যাটি বুঝিতে চেষ্টা করিবেন।
ইতি শ্রাবণ ১৩৫২
নীহাররঞ্জন রায়
.
বর্ণাশ্রম প্রথার জন্মের ইতিহাস আলোচনা না করিয়াও বলা যাইতে পারে, বর্ণবিন্যাস ভারতীয় সমাজ-বিন্যাসের ভিত্তি। খাওয়া-দাওয়া এবং বিবাহ ব্যাপারের বিধিনিষেধের উপর ভিত্তি করিয়া আর্যপূর্ব ভারতবর্ষের যে সমাজ-ব্যবস্থার পত্তন ছিল তাহাকে পিতৃপ্রধান আর্যসমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া ঢালিয়া সাজাইয়া নুতন করিয়া গড়িয়াছিল। এই নূতন করিয়া গড়ার পশ্চাতে একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুক্তি কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সে-সব আলোচনা বর্তমান ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। যে-যুগে বাংলা দেশের ইতিহাসের সূচনা সে-যুগে বর্ণাশ্রম আদর্শ গড়িয়া উঠিয়াছে, ভারতীয় সমাজের উচ্চতর এবং অধিকতর প্রভাবশালী শ্রেণীগুলিতে তাহা স্বীকৃত হইয়াছে, এবং ধীরে ধীরে তাহা পূর্ব ও দক্ষিণ ভাবতবর্ষে বিস্তৃত হইতেছে। বর্ণাশ্রমের এই সামাজিক আদর্শের বিস্তারের কথাই এক হিসাবে ভাবতবর্ষে আর্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিস্তা্রের ইতিহাস, কারণ ঐ আদর্শের ভিতরই ঐতিহাসিক যুগের ভারতবর্ষের সংস্কার ও সংস্কৃতির সকল অর্থ নিহিত। বর্ণাশ্রমই আর্যসমাজের ভিত্তি, শুধু ব্রাহ্মণ্য সমাজেরই নয়, জৈন এবং বৌদ্ধ সমাজেরও। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া আর্যপূর্ব ও অনার্য সংস্কার এবং সংস্কৃতি এই বর্ণাশ্রমের কাঠামো এবং আদর্শের মধ্যেই সমন্বিত ও সমীকৃত হঠযাছে। বস্তুত, বর্ণাশ্রমগত সমাজ-বিন্যাস এক হিসাবে যেমন ভারত-ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্টা, তেমনই অন্য দিকে এমন সর্বব্যাপী এমন সবগ্রাসী এবং গভীর অর্থবহ সমাজ-ব্যবস্থা ও পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। প্রাচীন বাংলার সমাজ-বিন্যাসের কথা বলিতে গিয়া সেই জন্য বর্ণবিন্যাসের কথা বলিতেই হয়।
বর্ণাশ্রম প্রথা ও অভ্যাস যুক্তিপদ্ধতিবদ্ধ করিয়াছিলেন প্রাচীন ধৰ্ম স্বত্র ও স্মৃতিগ্রন্থের লেখকেরা। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চাতুবর্ণ্যের কাঠামোর মধ্যে তাঁহারা সমস্ত ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থাকে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই চাতুর্বর্ণ প্রথা অলীক উপন্যাস, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। কারণ ভারতবর্ষে এই চতুৰ্বর্ণের বাহিরে অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোম ছিল, প্রত্যেক বর্ণ, জন ও কোমের ভিতর আবার ছিল অসংখ্য স্তর উপস্তর। ধর্মসূত্র ও স্মৃতিকারেরা নানা অভিনব অবাস্তব উপায়ে এই সব বিচিত্র বর্ণ, জন ও কোমের স্তর-উপস্তর ইত্যাদি ব্যাখ্যা করিতে এবং সবকিছুকেই আদি চাতুৰ্বর্ণের কাঠামোর যুক্তিপদ্ধতিতে বাঁধিতে চেষ্ট৷ করিয়াছেন। সেই মনু-যাজ্ঞবল্ক্যের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই চেষ্টার কখনও বিরাম হয় নাই। একথা অবশ্যস্বীকার্য যে স্মৃতিকারদের রচনার মধ্যে সমসামযিক বাস্তব সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন আছে, সেই অবস্থার ব্যাখ্যার একটা চেষ্টা আছে; কিন্তু যে-যুক্তিপদ্ধতির আশ্রয়ে তাহা করা হইয়াছে অর্থাং চাতুর্বর্ণ্যের বহির্ভূত অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোমের নরনারীর সঙ্গে চাতুর্বৰ্ণাকৃত নরনারীর যৌনমিলনের ফলে সমাজের যে বিচিত্র বর্ণ ও উপরর্ণের, বিচিত্ৰত্র সংকব বর্ণের সৃষ্টি করা হইয়াছে, তাহা একান্তই অনৈতিহাসিক এবং সেই হেতু অলীক। তৎসত্ত্বেও স্বীকার করিতেই হয় আর্যব্রাহ্মণ্য ভারতীয় সমাজ আজও এই যুক্তিপদ্ধতিতে বিশ্বাসী, এবং সুদূর প্রাচীন কাল হইতে আদি চাতুর্বর্ণ্যের যে কাঠামো ও যুক্তিপদ্ধতি অনুযায়ী বর্ণব্যাখ্যা হইয়া আসিয়াছে সেই ব্যাখ্যা প্রয়োগ করিয়া হিন্দুসমাজ আজও বিচিত্র বর্ণ, উপবর্ণ ও সংকর বর্ণের সামাজিক স্থান নির্ণয় করিম থাকেন। বাংলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই, আজও হইতেছে না।
এই সব বিচিত্র বর্ণ, উপবর্ণ, সংকর বর্ণ সকল কালে ও ভারতবর্ষের সকল স্থানে এক প্রকারের ছিল না, এখনও নয়; সকল স্মৃতিশাস্ত্রে সেইজন্য এক প্রকারের বিবরণ ও পাওয়া যায় না। প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থগুলির একটিও বাংলাদেশে রচিত নয়; কাজেই বাংলার বর্ণবিন্যাসগত সামাজিক অবস্থার পরিচয় ও তাহাতে পাওয়া যায় না, আশা করাও অযৌক্তিক এবং অনৈতিহাসিক। বস্তুত, একাদশ শতকের আগে বাংলাদেশে বাংলাদেশের সামাজিক প্রতিফলন লইয়া একটিও স্মৃতিগ্রন্থ বা এমন কোনও গ্রন্থ রচিত হয় নাই যাহার ভিতর সমসাময়িক কালের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছুমাত্র পওয়া যাইতে পারে। বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বীকার করিলে বলিতেই হয়, এই সময় হইতেই বাঙালী স্মৃতি ও পুরাণকারের সজ্ঞানে ও সচেতন ভাবে বাংলার সমাজ-ব্যবস্থাকে প্রাচীনতর ব্রাহ্মণ্য স্মৃতির আদর্শ ও যুক্তিপদ্ধতি অনুযায়ী ভারতীয় বর্ণবিন্যাসের কাঠামোর মধ্যে বাঁধিবার চেষ্টা আরম্ভ করেন। কিন্তু এই সজ্ঞান সচেতন চেষ্টার আগেই, বহুদিন হইতেই, আর্যপ্রবাহ বাংলাদেশে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে; এবং আর্যধর্ম ও সংস্কৃতির স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণাশ্রমের যুক্তি এবং আদর্শ ও স্বীকৃতি লাভ করে। সেইজন্য প্রাচীন বাংলার বর্ণবিন্যাসের কথা বলিতে হইলে বাংলার আর্যীকরণের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই তাহা আরম্ভ করিতে হয়।
০২. উপাদান-বিচার
আর্যীকরণের তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্বের ইতিহাস নানা সাহিত্যগত উপাদানের ভিতর হইতে খুঁজিয়া বাহির করিতে হয়। সে-উপাদান রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, মনু-বৌধায়ন প্রভৃতি স্মৃতি ও সূত্রকারদের গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। বৌদ্ধ ও জৈন প্রাচীন গ্রন্থাদিতে ও এ-সঙ্গন্ধে কিছু কিছু তথ্য নিহিত আছে। উত্তরবঙ্গে এবং বাংলাদেশের অন্যত্র গুপ্তাধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আর্যীকরণ তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের সূত্রপাত। এই সময় হইতে আবম্ভ করিয়া একেবারে ত্রয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত বর্ণবিন্যাস-ইতিহাসেব প্রচু্র উপাদান বাংলার অসংখ্য লিপিমালায় বিদ্যমান। বস্তৃত, সন-তারিখযুক্ত এই লিপিগুলির মত বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরযোগ্য যথার্থ বাস্তব উপাদান আর কিছু হইতেই পারে না; এইগুলির উপর নির্ভর করিয়াই বাংলার বর্ণবিন্যাসের ইতিহাস রচনা করা যাইতে পারে, এবং তারা করাই সর্বাপেক্ষ নিরাপদ। বতর্মান নিবন্ধে আমি তাহাই করিতে চেষ্টা করিব। সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক দু-একটি কাব্যগ্রন্থের, যেমন রামচরিতের সাহায্যও লওয়া যাইতে পারে। ইহাদের ঐতিহাসিকতা অবশ্যস্বীকার্য।