এখন, আমাদের ধারণাটা ঠিক না তাঁদের ধারণাটা ঠিক, এ-নিয়ে তর্ক তোলবার দরকার নেই। অবশ্যই, এ-বিষয়ে আমাদের ধারণা তাঁদের চেয়ে অনেক স্পষ্ট, অনেক নির্ভুল। তার তুলনায়, তাঁদের ধারণাটার প্রায় পনেরো আনাই কল্পনা। কিন্তু যেটা আসলে ঢের বড়ো কথা, তাঁদের যুগে তাঁদের মনে এই রকমের একটা কল্পনা সত্যিই ছিলো, ছিলো ওই রকমের একটা ভুল ধারণা। তাই তাঁদের লেখা পুঁথিপত্র আমরা যদি বুঝতে চাই তাহলে আমাদের একালের ধ্যান-ধারণাগুলিকে তাঁদের লেখার উপর আরোপ করে বসলে প্রকাণ্ড ভুল হবে—ঠিক কী ভেবে তাঁরা কী লিখেছিলেন সে-কথা আমরা বুঝতেই পারবো না।
তাঁদের মনে যে সত্যিই ওই রকমের একটা ধারণা ছিলো এ-কথার প্রমাণ শুধুই উপনিষদ নয়, ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিও। বরং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে এই কথা এতোবার এবং এতো স্পষ্টভাবে তাঁরা লিখে রেখেছেন যে সেদিকে চোখ না পড়াটাই বিস্ময়কর। স্থানসংকুলানের খাতিরে আমরা এখানে মাত্র একটি নমুনার উল্লেখ করতে পারবো; উৎসাহী পাঠক পাদটীকায় অন্যান্য বহু দৃষ্টান্তের উল্লেখ পাবেন(২৫)। আমাদের এই দৃষ্টান্তটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের প্রথম পঞ্চিকা প্রথম অধ্যায় থেকে সংগৃহীত, তর্জমা শ্রদ্ধেয় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর(২৬) :
যে যজমান আপনাকে অপ্রতিষ্ঠিত মনে করে সে ঘৃতপক্ক চরু নির্বাপন করিবে। (অপ্রতিষ্ঠিত অর্থ, পুত্রাদিরহিত ও গবাদিরহিত)।
হে বৎস, যে এইরূপ প্রতিষ্ঠারহিত সে ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত (শ্লাঘ্য) হয় না। (ঘৃতচরুর দ্বারা সেই অপ্রতিষ্ঠার পরিহার হয়।)
তাহাতে (সেই ঘৃতপক্ক চরুতে) যে ঘৃত আছে তাহা স্ত্রীর পয়ঃ (শোনিতস্বরূপ) আর যে তণ্ডুল আছে তাহা পুরুষের (রেতঃ স্বরূপ); সেই ঘৃততণ্ডুল মিথুন সদৃশ; সেই জন্য এই মিথুনদ্বারাই (ঘৃততণ্ডুলময় চরুপ্রদানদ্বারা) ইহাকে (যজমানকে) সন্ততিদ্বারা ও পশুদ্বারা বর্ধিত করা হয়। (সেই হেতু এই চরু) প্রতিষ্ঠারই হেতু।
এখানেও সেই একই ধারণা : মিথুন থেকে শুধুই যে সন্তান পাওয়া যাবে তাই নয়, ধনসম্পদও। মনে রাখবেন, সে-যুগে ধনসম্পদ বলতে প্রধানত পশুই। তাহলে সে-যুগের যাঁরা জ্ঞানী তাঁদের ধারণায় ধনউৎপাদন আর প্রজনন এমন কিছু আলাদা ব্যাপার নয়। মিথুন থেকে শুধু সন্তান পাবার আশা নয়, পশুদ্বারা বর্ধিত হবার আশাও। আর এই কথায় যদি বিশ্বাস অটুট হয় তাহলে তাঁরা স্বভাবতই উপদেশ দেবেন : ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’, কোনো স্ত্রীলোককেই পরিত্যাগ করবে না—তাই-ই ব্রত।
আধুনিক কালের পণ্ডিতেরা বেদ-উপনিষদে এ-ধরনের কথা লেখা আছে দেখে বিলক্ষণ বিরক্তিবোধ করতে পারেন। তার কারণ, এ-ধরনের কথা বলবার পিছনে যেটা হলো নিছক আধুনিক যুগের উদ্দেশ্য সেটাকেই তাঁরা একমাত্র উৎসাহ মনে করেন। আর যদি তাই হয় তাহলে বেদ-উপনিষদের লেখকদের মধ্যে অত্যন্ত স্থূল আর কদর্য মনোবৃত্তি কল্পনা না করে উপায় থাকে না। কিন্তু তাই বা কী করে বলা যায়? হাজার হোক, তাঁরা ছিলেন সত্যদ্রষ্টা ঋষি! ক্রমে আধুনিক পণ্ডিতদের পক্ষে একমাত্র উপায় হলো ঋষিদের এই জাতীয় কথাবার্তাগুলিকে চেপে যাওয়া। আমরা বলতে চাই, ওই পদ্ধতিটাই ভুল। কেননা, প্রাচীনেরা কী ভেবে কী লিখেছেন তা ঠিকমতো বুঝতে হলে সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার যে প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন—তাই একালের ধ্যানধারণাগুলি তাঁদের মধ্যে কল্পনা করাটাই অসঙ্গত ও যুক্তিহীন।
——————
২১. F. Engels OFPPS 61.
২২. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ৮২।
২৩. M. N. Dutta RVS 801n.
২৪. মহাভারত (কালীপ্রসন্ন সিংহ) ১০৯।
২৫. SBE 12:194, 257sq.,…
২৬. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) ৬-৭।
০৬. সন্তান উৎপাদন আর ধন-উৎপাদন
লোকায়তিকদের কথায় ফিরে আসা যাক। কাপালিকদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে যে সমস্যা উঠেছিলো বৈদিক সাহিত্যের নজির থেকেই তার যেন একটা কিনারা পাওয়া যাচ্ছে। বৃহস্পতি বলছেন, লোকায়ত আর কাপালিক দু’-এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। শুধু বৃহস্পতিই নন, গুণরত্নের লেখা বইতেও এই কথাই। এদিকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেখছেন, লোকায়ত হলো অর্থসাধনশাস্ত্র—আধুনিক ভাষায় ধনউৎপাদনের শাস্ত্র, সায়েন্স অব ইকনোমিক্স। অপর পক্ষে, কাপালিক হলো কামসাধনশাস্ত্র, মহামহোপাধ্যায়ের ভাষায় সায়েন্স অব ইরোটিক্স।
অবশ্যই, আমাদের আধুনিক ধারণা অনুসারে ইকনোমিক্স-এর সঙ্গে ইরোটিক্স-এর—ধনউৎপাদনের সঙ্গে কামসাধনের—কোনো সম্পর্ক নেই। আর যদি তা না থাকে তাহলে সেকালের পুঁথিপত্রে লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিকদের অভেদ-সূচক যে-সব কথাবার্তা সেগুলির তাৎপর্য খোঁজবার কোনো মানে হয় না। মহামহোপাধ্যায়ের নিজের লেখার মধ্যে এই রকমেরই একটা পরাজয় স্বীকার করার ইঙ্গিত থেকে গিয়েছে। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, প্রাচীনদের মত অনুসারে লোকায়ত ও কাপালিক আলাদা নয়। আর এক জায়গায় তিনি বলছেন, লোকায়তিকেরা ছিলেন অর্থনীতি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা, কাপালিকেরা কামশাস্ত্রের : কিন্তু দু’-এর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তিনি কোনো কথাই তুললেন না। অথচ তা যদি না তোলা হয় তাহলে লোকায়ত আর কাপালিক যে কী করে এক হলো সে-সমস্যার সমাধান চেবার চেষ্টাই করা হলো না।
অথচ, আমরা দেখলাম বৈদিক সাহিত্যের আলোচনা এ-সমস্যার উপর কিছুটা আলোকপাত করতে পারে। কেননা, বৈদিক সাহিত্য থেকে অন্তত এটুকু বোঝা গেলো যে আজকালকার দিনে ধনউৎপাদন ও সন্তানউৎপাদনকে আমরা যতোখানিই সম্পর্কহীন ও বিচ্ছিন্ন চেষ্টা মনে করি না কেন প্রাচীনকালের কোনো একটা যুগের মানুষ তা মনে করতো না। আর তাহলে কি এমনটা হতে পারে না যে, যে-কালের বা যে-স্তরের ধ্যানধারণার স্মারক বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে টিকে রয়েছে সেই-স্তরের চেতনা থেকেই লোকায়ত ও কাপালিক মতের উৎপত্তি? সকলেই বলছেন, লোকায়তিকদের মতে অর্থ ও কামই হলো পরম-পুরুষার্থ; কিন্তু এমন কথা তো কেউই বলছেন না যে মানব-চেতনার একটি পুরানো স্তরে যেহেতু অর্থসাধন ও কামসাধন স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা নয় সেই হেতু এমনটা হওয়া নিশ্চয়ই অসম্ভব নয় যে, সেই স্তরের চেতনাই লোকায়তিকদের মধ্যে প্রতিফলিত—তাদের কাছে হয়তো অর্থ ও কাম স্বতন্ত্র পুরুষার্থ নয়, একই পুরুষার্থের যেন এপিঠ-ওপিঠ।