আর, এই থেকে কি প্রমাণ হয় যে মৈথুন ও কাম সম্বন্ধে আমাদের আজকের দিনের যা-ধারণা তার সঙ্গে সেকালের মানুষদের ধারণার একেবারে আকাশ-পাতাল তফাত?
তফাত যে হয়েছিলো এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনো রকম অবকাশই নেই। কেননা, মহাভারতের যুগে দেখা যায় এ-বিষয়ে পুরোনো কালের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে নতুন কালের ধ্যানধারণাগুলো আর মিল খাচ্ছে না। আদিপর্বের ১২২ অধ্যায় দেখুন(২৪) :
পূর্বকালে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদা তিনি পিতামাতার নিকট বসিয়া আছেন, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহার জননীর হস্ত ধারণপূর্বক কহিলেন, আইস আমরা যাই! ঋষিপুত্র পিতার সমক্ষেই মাতাকে বলপূর্বক (‘বলাৎ ইব’) লইয়া যাইতে দেখিয়া সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন। মহর্ষি উদ্দালক পুত্রকে তদবস্থ দেখিয়া কহিলেন, বৎস ক্রোধ করিও না, ইহা নিত্যধর্ম। (এষঃ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ ।।১।১২২।১৪।।)। গাভীগণের ন্যায় স্ত্রীগণ শত সহস্র পুরুষে আসক্ত হইলেও উহারা অধর্মলিপ্ত হয় না। ঋষিপুত্র পিতার বাক্য শ্রবণ করিয়াও ক্ষান্ত হইলেন না, প্রত্যূত পূর্বাপেক্ষা ক্রুদ্ধ হইয়া মনুষ্যমধ্যে বলপূর্বক এই নিয়ম স্থাপন করিয়া দিলেন যে, অদ্যাবধি যে স্ত্রী পতিভিন্ন পুরুষান্তর সংসর্গ করিবে এবং যে পুরুষ কৌমারব্রহ্মচারিনী বা পতিব্রতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, ইহাদের উভয়কেই ভ্রুণহত্যা সদৃশ ঘোরতর পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হইবে। (কালিপ্রসন্ন সিংহের তর্জমা)
যৌনজীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা যে একটি বিশেষ যুগেই বদলেছে—আগে একরকম ছিলো, পরে অন্যরকম হলো—এ-কথার এর চেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ আর কী হবে? সেই যুগ বলতে ঠিক কোন যুগ,—কোন যুগ থেকে কামজীবন সম্বন্ধে আধুনিক ধ্যানধারণার শুরু,—এ-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র।
আমাদের কাছে এখানে প্রধান সমস্যা হলো, সেকালের ধারণাটা ঠিক কী রকম? কোন রকম ধারণার বশবর্তী হলে পরে বৈদিক ঋষিদের পক্ষে কামজীবনকে অতোখানি গুরুত্বপূর্ণ, অতোখানি উদ্দেশ্যমূলক, মনে করা সম্ভবপর? এ-প্রশ্নের পুরো জবাবটা অবশ্যই শুধুমাত্র বৈদিক সাহিত্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। অন্য কোন দিক থেকে জবাবটা পাবার সম্ভাবনা সে-কথায় একটু পরে ফেরা যাবে। কিন্তু, যেটা খুবই বিস্ময়ের কথা, এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্য আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করে না। উপনিষদ এবং বিশেষ করে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির কাছ থেকেই প্রশ্নটার অন্তত আংশিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে।
উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায় ছান্দোগ্য-উপনিষদের বামদেব্য ব্রতের কথা। ‘বামদেব্য’ নামটার দিকে নজর রাখবেন। বৈদিক সাহিত্যেও বামাচারের স্মারক রয়েছে তার একটি স্পষ্ট নিদর্শন ওই নামের মধ্যেই।
ছান্দোগ্য-উপনিষদে লেখা আছে :
উপমন্ত্রয়তে স হিংকারো জ্ঞপয়তে স প্রস্তাবঃ স্ত্রিয়া সহ শেতে স উদ্গীথঃ প্রতি স্ত্রীং সহ শেতে স প্রতিহারঃ কালং গচ্ছতি তন্নিধনং পারং গচ্ছতি তন্নিধনমেতদ্বামদেব্যং মিথুনে প্রোতম্।।২।১৩।১।।
স য এবমেতদ্বামদেব্যং মিথুনে প্রোতং বেদ মিথুনীভবতি মিথুনান্মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বমায়ুরেতি জ্যোগ্ জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্।।২।১৩।২।।
আহ্বান করে, সেই হলো হিঙ্কার। প্রস্তাব করে, সেই হলো প্রস্তাব। স্ত্রী সঙ্গে সে শয়ন করে, সেই হলো উদ্গীথ। স্ত্রীর অভিমুখ হয়ে শয়ন করে, সেই হলো প্রতিহার। সময় অতিবাহিত হয়, তাই নিধন। এই বামদেব্য নামক সাম মিথুনে প্রতিষ্ঠিত। ।।২।১৩।১।।
যে এইভাবে বামদেব্য সামকে মিথুনে প্রতিষ্ঠিত বলে যে জানে সে মিথুনে মিলিত হয়। (তার) প্রত্যেক মিথুন থেকেই সন্তান উৎপন্ন হয়। সে পূর্ণজীবী হয়। সন্তান, পশু ও কীর্তিতে মহান হয়। কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না—এই-ই ব্রত।।২।১৩।২।।
“মিথুনাৎ মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বম্ আয়ুঃ এতি জ্যোক্ জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা”—এই হলো আসল কথা।
মিথুন থেকে কী কী পাওয়া যাবে তার ফর্দ দেখুন :
সন্তান পাওয়া যাবে।
পূর্ণ জীবন পাওয়া যাবে।
পশু পাওয়া যাবে।
মহান্ কীর্তির নামডাক পাওয়া যাবে।
এখানে বিশেষ করে দে-দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি তা হলো, উপনিষদের ঋষি মৈথুনকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনেরই উপায় মনে করছেন না, সেই সঙ্গেই ধনউৎপাদনের উপায় বলেও বর্ণনা করছেন। উপনিষদের যুগেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা অনেকখানিই পশুপালনমূলক; তাই ধনউৎপাদন বলতে প্রধানতই পশুবৃদ্ধি।
আর এই ধারণার দরুনই মিথুনকে এতোখানি জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে যে ঋষি মিথুনের বিভিন্ন স্তরকে হিঙ্কার, প্রস্তাব, উদ্গীথ, প্রতিহার প্রভৃতি পঞ্চবিধ সামগানের সঙ্গে এক বলে বর্ণনা করছেন। শুধু তাই নয়, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, “ন কাঞ্চন (=কাম্+চন=কোনো স্ত্রীলোককে) পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম”—কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না, তাহা-ই ব্রত।
তাহলে প্রাচীনদের মনে মিথুন সম্বন্ধে ধারণাটা ঠিক আমাদের মতো নয়।
আমাদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? সন্তান।
ঋষিদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? শুধু সন্তান নয়, ধনসম্পদও।
আমাদের ধারণায় সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে ধনসম্পদ উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁদের ধারণায়, ধনসম্পদ উৎপাদন ও সন্তান উৎপাদন—দু’-এর মধ্যে সম্পর্ক বড়ো গভীর।