বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদের তাৎপর্য খুঁজতে হলে আজকালকার বটতলাসাহিত্য থেকে কোনোরকম মূলসূত্র পাওয়া সম্ভব নয়—এক কথাটি স্পষ্টভাবে মনে রেখেই বৈদিক সাহিত্যে বামাচার ও কামাচারের নিদর্শনগুলিকে বোঝবার চেষ্টা করা যাক।
একটি নিদর্শন : শুক্ল-যজুর্বেদ (বাজসনেয়ী সংহিতার) ২৩।।২২ থেকে ২৩।।৩১। এই দশটি বেদমন্ত্রেরই আক্ষরিক অনুবাদ দেবার দরকার নেই। আমরা শুধুমাত্র দুটি মন্ত্রের তর্জমা উদ্বৃত করবো, কেননা, ওই দুটির মধ্যেই খুব প্রয়োজনীয় একটি ইঙ্গিত লুকিয়ে রয়েছে—বাকি আটটি মন্ত্রে বারবার একঘেঁয়ে ভাবে, একই কথাবার্তা পাওয়া যাচ্ছে। কিসের কথাবার্তা? মৈথুনের। কেবল মনে রাখবেন, এই মৈথুন-দৃশ্যে ও মৈথুন-সংলাপে যাঁরা অংশগ্রহণ করছেন তাঁরা কেউই আজকালকার লম্পটের মতো লোক নন। তার বদলে পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিক : অধ্বর্য্যু, ব্রহ্মা, উদ্গাতা, ইত্যাদি। ২৩।।২২ এবং ২৩।।২৩ : অধ্বর্য্যু কুমারীকে অভিমেথন করছেন—দুটি মন্ত্রে অধ্বয্যু ও কুমারীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ২৩।।২৪ এবং ২৩।।২৫ : ব্রহ্মা মহিষীকে অভিমেথন করছেন—মন্ত্র দুটিতে ব্রহ্মা ও মহিষীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আমাদের আলোচনার পক্ষে ২৩।।২৬ এবং ২৩।।২৭ সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হবে। তাই শুধু এই দুটি বেদমন্ত্রই উদ্বৃত করলাম।
উর্ধ্বামেনামুচ্ছ্রাপয় গিরৌ ভারং হরন্নিব।
অথাস্যৈ মধ্যমেধতাং শীতে বাতে পুনান্নিব।।২৩।২৬।।
উবটভাষ্য :–উদ্গাতা বাবাতাম্ অভিমেথয়তি উর্ধ্বাম্ এনাম্ কম্ চিৎ পুরুষম্ আহ। উর্ধ্বাম্ এনাম্ বাবাতাম্ উচ্ছ্রিতাম্কুরু। কথম্ ইব। গিরৌ ভারম্ মধ্যে নিগৃহ্য হরেৎ এবম্ মধ্যে নিগৃহ্য উর্ধ্বাম্ উচ্ছ্রাপয়। অথ যথা ইতি এতস্য স্থানে। অথাচ উচ্ছ্রাপয় যথা অস্যা বাবাতায়া মধ্যম্ যোনিপ্রদেশঃ এধতাম্। ‘এধ্ বৃদ্ধৌ’ বৃদ্ধিম্ যায়াৎ অথ এনাম্ গৃহ্নীয়াঃ। শীতে বাতে পুনন্ ইব। যথা কৃষীবলঃ ধান্যম্ বাতে শুদ্ধম্ কুর্বন্ গ্রহণমোক্ষৌ ঝটিতি করোতি।
উর্ধ্বামেনমুচ্ছ্রয়োতাদিগিরৌ ভারং হরন্নিব।
অথাস্য মধ্যমেজতু শীতে বাতে পুনন্নিব।।২৩.২৭।।
উবটভাষ্য :–বাবাতা প্রত্যাহ উদ্গাতারম্। ভবতঃ অপি এতৎ এবম্। উর্ধ্বম্ এনম্। উদ্গাতারম্ উচ্ছ্রয়তাম্ উচ্ছ্রাপয়। অত্র স্ত্রী পুরুষায়তে। গিরৌ ভাবম্ হরন্ ইব। অথ এবম্ ক্রিয়মাণস্য অস্য মধ্যম প্রজননম্ এজতু চলতু। অথ এনম্ নিগৃহীব শীতে বাতে পুনন্ ইব যবান্।
২৩।।২৬ : এই স্ত্রীকে উর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। পর্বতে যেমন করিয়া তার উত্তোলন করে। অনন্তর ইহার মধ্যদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক। বায়ুকে শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবট : উদ্গাতা বাবাতাকে অভিমেথন করিলেন। কোনো পুরুষকে বলিলেন, এই বাবাতাকে উর্ধ্বে তুলিয়া উষ্প্রিত করো। কেমন করিয়া? পর্বতে ভারবস্তুকে মধ্যস্থানে ধরিয়া যেমন ভাবে উত্তোলন করা হয় তেমনি ইহাকে মধ্যে ধরিয়া উত্তোলন করো। যেমন কৃষক বায়ুতে ধান্য শুদ্ধ করিতে করিতে ঝটিতে গ্রহণ করে ও বপন করে…
২৩।।২৭ : উর্ধ্বে এই পুরুষকে তুলিয়া ধরো। যেমন করিয়া পর্বতে ভারবস্তুকে উত্তোলন করা হয়। অনন্তর ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক। শীতল বায়ুতে যব শস্য শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবট : প্রত্যুত্তরে বাবাতা উদ্গাতাকে বলিল, তোমা কর্তৃকও এই রকমই করা হউক। এই পুরুষকে, অর্থাৎ উদ্গাতাকে, উর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। এইখানে স্ত্রীলোক পুরুষের ন্যায় আচরণ করিতেছে। পর্বতে যেমন করিয়া ভার তোলে। অনন্তর এইরূপ ক্রিয়মান ইহার মধ্যেপ্রদেশ চলিতে থাকুক, অর্থাৎ মৈথুন চলিতে থাকুক। অনন্তর ইহাকে চালিয়া ধরো। যেমন কৃষক শীতল বায়ুতে যব শুদ্ধ করিতে করিতে ঝাটিতে গ্রহণ এবং বপন করে…
উদ্ধৃত অংশের বিশেষ করে একটি বিষয়ের দিকে নজর রাখা দরকার : মৈথুন-সংলাপের মধ্যে কী ভাবে ক্ষেত্রে বীজ বপনের কথাটা এলো! তাহলে বামাচারের সঙ্গে বার্ত্তা-বিদ্যার সংযোগটা মনে হচ্ছে শুধুমাত্র কাপালিক-লোকায়তিক সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয়, খোদ বৈদিক ঐতিহ্যের যেন একই ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে!
এ-আলোচনায় পরে ফেরা যাবে।
আপাতত, বড়ো সমস্যাটাই দেখা যাক। সমস্যা হলো : যজুর্বেদে পরের পর দশ দশটি এই রকম মন্ত্র আছে, এবং আধুনিক কোনো পণ্ডিতই বলতে পারছেন না যে উত্তরযুগের লম্পটেরা এগুলি রচনা করে বেদের মধ্যে গুঁজে দিয়েছে। অর্থাৎ, রচনাটি খোদ বৈদিক ঋষিদেরই।
অবশ্যই, পরের যুগের বেদপন্থীরা এই মন্ত্রগুলি নিয়ে খুবই বিপদে পড়েছেন। তার কারণ, তাঁদের উত্তরযুগের রুচির সঙ্গে এগুলি কিছুতেই খাপ খায় না। তাই পরের যুগে এমনকি বিধান দেওয়া হয়েছে, এই বৈদিক মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করবার জন্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে(২৩)। প্রায়শ্চিত্তবিধানের মূলে নিশ্চয়ই পাপ-বোধ। অথচ, পুরাকালের বৈদিক ঋষিরা যদি সত্যিই একে পাপাচরণ মনে করতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার জন্য পাঁচ-পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিককে নিয়োগ করতে চাইতেন না। তাই তাঁদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই যে একটি বৈদিক যজ্ঞ-বিশেষ সে-বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহের অবকাশ নেই। বস্তুত, বেদের ছাত্রমাত্রই জানেন এই মন্ত্রগুলির সঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞের কী রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
কিন্তু মৈথুনের সঙ্গে বৈদিক যজ্ঞের সম্বন্ধ আবার কী? ঠিক কী সম্পর্ক এ-কথার জবাব এখুনি দেওয়া যাবে না। কেননা, যজ্ঞ বলে ব্যাপারটির আসল তাৎপর্য নিয়েই প্রচুর আলোচনার অবকাশ রয়েছে। আপাতত, আমরা শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি যে যজ্ঞ মানে যাই হোক না কেন, অনেক জায়গায় দেখা যায় প্রাচীনেরা মৈথুনকেও সরাসরি যজ্ঞের মতোই মনে করেছিলেন।