কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, উত্তরকালে আমরা যজ্ঞ-অনুষ্ঠানের যে-পরিচয় পাই তা প্রাচীনসমাজের জাদুঅমুষ্ঠান বা ritual-এর সঙ্গে অভিন্ন। অর্থাৎ, যজ্ঞের পিছনে তার স্মৃতি লুকোনো থাকলেও যজ্ঞের মধ্যেই তার আদি-আকৃত্রিম রূপটির পরিচয় টিকে থাকার সম্ভাবনা অল্পই। কিংবা, যা একই কথা, উত্তরকালে যজুর্বেদ ও ব্রাহ্মণে আমরা যজ্ঞের যে-রূপ দেখি তাই যজ্ঞের আদিরূপ নয়। প্রাচীন সমাজের ritual থেকেই যজ্ঞের জন্ম; কিন্তু যজ্ঞের মধ্যেই সে-ritual-এর আদি-তাৎপর্য নেই। এই বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।
আধুনিক জ্ঞানের মানদণ্ডে প্রাচীন সমাজের জাদুঅনুষ্ঠান নিশ্চয়ই অবাস্তব, অসম্ভব, ভ্রান্ত। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কামনা-সফল হবার একটা কাল্পনিক ছবি ফুটিয়ে তুলেই আধা-অসহায় অবস্থার মানুষগুলি মনে করে যে, এইভাবে কামনা বাস্তবিকই সফল হতে বাধ্য। কিন্তু সমস্ত ক্রিয়াটুকু কাল্পনিক হলেও ওই পর্যায়ের মানুষদের কাছে তা সম্পূর্ণ নিষ্ফল নয়। কেননা, ওই কল্পনাই তাদের জীবন-সংগ্রামে মানসিক উদ্দীপনার একটি প্রধানতম উৎস। এই কারণেই অধ্যাপক জর্জ টম্সন(৪৯) প্রাচীন মানুষদের জাদুঅনুষ্ঠানকে ‘an illusory technique supplementary to the real technique’ বলে বর্ণনা করেছেন : বাস্তব পৃথিবীর উপর এই কাল্পনিক অনুষ্ঠানটির কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নিশ্চয়ই নেই, কিন্তু একটা পরোক্ষ প্রভাব থাকতে বাধ্য। কেননা, যারা এতে বিশ্বাস করছে তাদের মনের বল, তাদের সাহস ও বিশ্বাস, অনেকাংশে এই সাফল্য-কল্পনার সাহায্যেই বেড়ে যাচ্ছে; তাই তারা অনেক ভালো করে, অনেক সার্থকভাবে, জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হতে পারছে। ফলে শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান বাস্তব পৃথিবীকেও প্রভাবিত করছে। অধ্যাপক জর্জ টম্সন(৫০) বলছেন, ‘It changes their subjective attitude to reality, and so indirectly it changes reality.’
এ-জাতীয় অনুষ্ঠান কাল্পনিক হওয়া সত্ত্বেও যে প্রাচীন-সমাজের পটভূমিতে বাস্তব জীবন-সংগ্রামের সহায়ক হতে পারে, তার মূল কারণ হলো প্রাচীন-সমাজের সমষ্টিজীবন। শ্ৰীমতী জেন হ্যারিসন্(৫১) বলছেন,
Collectivity and emotional tension, two elements that tend to turn the simple reaction into a rite, are—specially among the primitive peoples—closely associated, indeed scarcely separable. The individual among savages has but a thin and meagre personality; high emotional tension is to him only caused and maintained by a thing felt socially; it is what the tribe feels that is sacred, that is matter for ritual.
কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, সমাজের পটভূমি-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ প্রাচীন ritual-গুলিকে বর্জন করতে পারে; যে-সব আচার-অনুষ্ঠান পূর্বপুরুষদের জীবনে দীর্ঘ যুগ ধরে পরম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে পরবর্তী পর্যায়েও মানুষ সেগুলিকে পরম পবিত্র বলেই আঁকড়ে থাকতে চায়। তাই, শ্রেণীসমাজের পটভূমিতেও ritual-গুলি টিকে থাকে, আকস্মিকভাবে উবে যায় না।
কিন্তু তা হলেও ওই আচার-অনুষ্ঠানগুলির আদি-তাৎপর্য এবং উত্তর-তাৎপর্য এক নয়। অর্থাৎ, নবপর্যায়ে ritual-গুলিরও নবরূপ বিকশিত হয় এবং এই নবরূপটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এখানে ritual-গুলির আদি-তাৎপর্য বিপরীতে পর্যবসিত হয়েছে। তারও নির্দিষ্ট কারণ আছে।
প্রথমত, প্রাচীন-পর্যায়ের মতো এগুলি আর সমষ্টিগত অনুষ্ঠান থাকে না, তার বদলে শ্রেণীবিশেষের গোপন বিদ্যার রূপ গ্রহণের দাবি করে।
দ্বিতীয়ত, এগুলি আর সামগ্রিক স্বার্থে নিযুক্ত নয়—অন্তত নিযুক্ত বলে কল্পিত নয়; তার পরিবর্তে ব্যষ্টির স্বার্থে প্রযুক্ত বলেই কল্পিত হয়।
তৃতীয়ত, উদ্বৃত্তজীবীর গোপন বিদ্যা হিসেবে এবং তারই খণ্ড স্বার্থে প্রযুক্ত হিসেবে কল্পিত বলে আদিম অনুষ্টানগুলির নবরূপ আর বাস্তব জীবনসংগ্রামের অঙ্গ নয়। কেননা মূলতই কাল্পনিক কৌশল হওয়া সত্ত্বেও প্রাচীন পৰ্যায়ে এগুলি যে-কারণে বাস্তব কৌশলকে সাহায্য করতে পেরেছে সে-কারণ বা সেই সর্ত-প্ৰাচীন মানুষের সমষ্টিজীবন-ইতিমধ্যে ভেঙে গিয়েছে এবং এইভাবে বাস্তব জীবনসংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হবার ফলেই ওই আদিম আচার-অনুষ্ঠানের নেতিবাচক দিকটি—কাল্পনিক এবং অবাস্তব চরিত্রটিই–যেন বাধাবন্ধনহীন স্বাধিকারপ্ৰমত্ত ও সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠবার আয়োজন করে। একই কারণে এগুলির নবরূপ অসামান্য জটিল ও পল্লবিত হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
এই কথাগুলিকে সাধারণভাবে জানতে-পারা মূলসূত্র হিসেবে গ্ৰহণ করেই আমরা বৈদিক যজ্ঞের ইতিহাস বোঝবার চেষ্টা করবো।
ঋগ্বেদে অবশ্যই যজ্ঞ, যজমান, ঋত্বিক প্ৰভৃতির উল্লেখ আছে; এমন কি উত্তর-সাহিত্য বর্ণিত কোনো কোনো বিশিষ্ট যজ্ঞের পরিচয়ও পাওয়া যায়। যেমন, অধ্যাপক কীথ্(৫২) বলছেন, প্ৰথম মণ্ডলের ১৬২ এবং ১৬৩ সূক্ত অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই অশ্বমেধ যজ্ঞের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। কিন্তু উত্তর-সাহিত্যে—যজুৰ্বেদ এবং ব্ৰাহ্মণাদি গ্রন্থে-বৈদিক যজ্ঞকে আমরা যে-জটিল ও পল্পবিতরূপে দেখি ঋগ্বেদে নিশ্চয়ই তার পরিচয় নেই। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, ঋগ্বেদের যুগে যজ্ঞ পরবর্তী কালের মতো ছিলো না।