যে সকল ধর্মসংহিতা সম্পূর্ণাঙ্গ তাদের তিনটি ভাগ। সেইজন্য যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির তিন অধ্যায়— আচার অধ্যায়, ব্যবহার অধ্যায় ও প্ৰায়শ্চিত্ত অধ্যায়। মনুসংহিতায় এই তিন ভাগ আছে। যদিও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিব অধ্যায় ভাগ করে তাদের বিভাগ দেখানো হয় নাই। মনুসংহিতার শেষ বা দ্বাদশ অধ্যায়ে ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ আছে। এই দুটি প্রধান সংহিতা বা ধৰ্মশাস্ত্ৰে আচার ও প্ৰায়শ্চিত্ত অধ্যায় ও ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশমূলক অধ্যায় বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যবহার অধ্যায় বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।
বেদ প্রমাণে ও অন্য লৌকিক প্রমাণে কর্তব্যাকর্তব্যজ্ঞান সম্বন্ধে মেধাতিথি লিখেছেন যে, ‘অন্যত্র যেমন ব্যবহার স্মৃতি প্রভৃতিতে জ্ঞান ন্যায়মূল, অর্থাৎ বেদমূল নয়, তা ক্রমে প্ৰদৰ্শিত হবে।’ ‘অন্যত্ৰাপি ব্যবহার স্মৃত্যাদৌ যাত্র ন্যায়।মূলতা স্তত্র যথাবসরং দর্শায়িষ্যাম।’ এবং মনুর সপ্তম অধ্যায়ে, যেখানে রাজধর্মের বিবরণ আরম্ভ হয়েছে সেখানে মেধাতিথি লিখেছেন, ‘প্ৰমাণান্তরমূলোহি অত্র ধর্মী উচ্যন্তে। ন সর্বে বেদমূলাঃ।’ অর্থাৎ, এখানে যে ধর্ম বলা হচ্ছে, তার মূল অন্য প্রমাণ, এই ধর্মের সমস্ত বেদমূল নয়।
শাস্ত্রকারেরা এবং নিবন্ধকারগণ কেন যে ব্যবহার স্মৃতিকে বেদমূল নয় বলেছেন এবং অন্য লৌকিক প্রমাণ সাপেক্ষ বলেছেন তার কারণ ব্যবহার স্মৃতি কোনও বিষয়ের কর্তব্যাকর্তব্যের উপদেশ–তার উপর একটু চোখ বুলালেই বুঝা যায়। ব্যবহার স্মৃতির বিষয় হচ্ছে আমরা এখন যাকে বলি মামলা মোকদ্দমা। মিতাক্ষরাকার লিখেছেন–’অন্য বিরোধেন স্বাত্ম-সম্বন্ধিতয়া কখনং ব্যবহারো, যথা কশ্চিদিদং ক্ষেত্ৰাদি মদীয়ং ইতি কথয়তি। অন্যেপিতদবিরোধেন মদীয়ং ইতি’ অর্থাৎ একই বস্তুতে দুই ব্যক্তির পরস্পর বিরুদ্ধ স্বত্বেব দাবির নাম ব্যবহার–যেমন যদি একজন লোক বলে এ শস্যক্ষেত্র আমার ও অন্য লোক বলে ওই শস্যক্ষেত্র তার, তা হলে তাকে বলে ব্যবহার।
ব্যবহার স্মৃতির কাজ সাংসারিক ভোগের বস্তুতে বিভিন্ন লোকের বিরোধী দাবির বিচারের উপায় নির্ণয় করা। সুতরাং ও স্মৃতিতে আছে, রাজার বিচারসভায় কারা সভ্য
হবেন, কি প্ৰণালীতে তাঁরা বিচার করবেন, কোন প্ৰমাণ গ্রাহ্য, কোন প্ৰমাণ অগ্রাহ্য এবং যে সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে লোকের বিরোধী দাবি হতে পারে, মোটামুটি তাকে ১৮ ভাগে ভাগ করে তার আইনের ব্যবস্থা। স্মৃতিশাস্ত্রে এর নাম ‘অষ্টাদশ বিবাদ পদানি।’ এর মধ্যে আছে— ঋণ, তার সুদ ও তার পরিশোধের আইন, নানাবিধ চুক্তির আইন, ক্রয় বিক্রয়ের আইন, জমির সীমা নিয়ে বিবাদের আইন, নানারকম অপরাধের ফৌজদারি আইন ইত্যাদি। অর্থাৎ মোটামুটি প্রাচীন হিন্দু আইন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ব্রিটিশ আদালতে ইংরেজের প্রবর্তিত আইন দ্বার যেসব বিষয়ের বিচার হিন্দু, কি মুসলমান আজ মেনে নিচ্ছে। এতে হিন্দুর ধর্ম নষ্ট হয়েছে, অতি বড় সনাতনীও এমন কথা বলেন না।
এই সকল নিতান্ত লৌকিক বিষয়, যার ফলাফল ও মঙ্গলামঙ্গল হাতে হাতে পাওয়া যায় এবং মানুষের স্বাভাবিক লৌকিক জ্ঞানে যে বিধিব্যবস্থা করা যায়, প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা কি তাদের ভাষ্যকারেরা তা রিলিজিয়নের অঙ্গ সুতরাং অপরিবর্তনীয় একথা কখনও মনে করেননি। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনের ভার তাদের উপর ছিল। সুতরাং কাণ্ডজ্ঞানহীন গোড়ামি করার অবসর তাদের ছিল না। তার উপর তাঁরা ছিলেন তীক্ষ্ণ ধী-সম্পন্ন, সাংসারিক জ্ঞানে সম্পূর্ণ জ্ঞানবান পণ্ডিত। সেইজন্য তাঁরা স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে, ব্যবহার স্মৃতি লৌকিক জ্ঞান ও লৌকিক ব্যবহারের উপর স্থাপিত।
হিন্দুর দায়বিভাগ এই ব্যবহার স্মৃতির অন্তর্গত। সুতরাং এর মূল বেদ নয় এবং রিলিজিয়ন অর্থে দায়ভাগ হিন্দুধর্মের অঙ্গ নয়। স্মৃতি-শাস্ত্রকারগণের মধ্যে একটা তর্ক প্রচলিত ছিল— বস্তুর উপর স্বামিত্ব, কি স্বত্ব, শাস্ত্ৰ-প্রমাণের বিষয়, না লোক-প্রসিদ্ধির বিষয়। সকল স্মৃতিকার একবাক্যে বলেছেন যে, বস্তুর উপর স্বত্ব কি স্বামিত্ব শাস্ত্ৰ-প্রমাণের বিষয় নয়, লৌকিক স্বীকৃতির বিষয়। মিতাক্ষরাকার বলেছেন যে, তা না হলে যে সকল অহিন্দু প্রত্যন্তবাসী শাস্ত্রের প্রমাণ গ্রাহ্য করে না, তাদের মধ্যেও বস্তুর স্বামিত্ব স্বীকৃত হয় কি করে? যে সকল বিভিন্ন প্রকারে বস্তুতে লোকের স্বামিত্ব জন্মে, স্মৃতিশাস্ত্রে তার ফর্দ দেওয়া আছে। কিন্তু ভাষ্যকারেরা বলেছেন যে, স্মৃতিশাস্ত্রে ওই ফৰ্দ আছে বলেই ওকে শাস্ত্রের বিধি বলে মনে করতে হবে না। মিতাক্ষরাকার এর উদাহরণে যা বলেছেন, আমাদের বর্তমান আলোচনায় তা সকল সংশয় নিরসন করে। তিনি বলেছেন, ‘যদ্যপি পত্নী দুহিত।রশচ ইত্যাদি স্মরণং তত্ৰাপি স্বামী সম্বন্ধিতয়া বহুর্মুদায়বিভাগিতয়া প্ৰাপ্তেষু লোকপ্রসিদ্ধেপি স্বত্বে ব্যামোহ নিবৃতাৰ্থং স্মরণমিতি সৰ্বমনবদ্যং’ অর্থাৎ যেমন পুত্ৰহীন লোকের ধনের কারা অধিকারী হবে, সে সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্য ‘পত্নী দুহিতরাশ্চা’ ইত্যাদি বচনে নির্দেশ দিয়েছেন, তবু এটা শাস্ত্রের বিধি নয়, কিন্তু ধন স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কবশত বহু লোক তার সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে পারে, এজন্য লোকের সন্দেহ নিবৃত্তির জন্য এই বচন বলেছেন, যদিও এ দায়াধিকার বচনের উপর নয়–লোকপ্ৰসিদ্ধির উপর নির্ভর করে, তেমনি সম্পত্তি অর্জনের নানারূপ উপায় আছে। অন্য স্মতিশাস্ত্রে সে সব উপায় বলা হয়েছে, বিধি-নিষেধের উদ্দেশ্যে নয়, লোক-প্ৰসিদ্ধ ব্যাপারের বর্ণনা হিসাবে।