- বইয়ের নামঃ তিতাস একটি নদীর নাম
- লেখকের নামঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
তিতাস একটি নদীর নাম (উপন্যাস) – অদ্বৈত মল্লবর্মণ
তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।
স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।
ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায় ; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।
মেঘনা পদ্মার বিরাট বিভিষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বৌ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।
তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।
কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারিদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোঘল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে–উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের তক্তের হাতিঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তারা শুখাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ্ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটি নদী।
তার তীরে বড় বড় নগরী বসানো নাই। সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না। ভূগোলের পাতায় তার নাম নাই।
ঝরণা থেকে জল টানিয়া, পাহাড়ি ফুলেদের ছুঁইয়া ছুঁইয়া উপল ভাঙিয়া নামিয়া আসার আনন্দ কোনোকালে সে পায় নাই। অসীম সাগরের বিরাট চুম্বনে আত্মবিলয়ের আনন্দও কোনোকালে তার ঘটিবে না। দুরন্ত মেঘনা নাচিতে নাচিতে কোন্কালে কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকাইয়াছিল; বাঁ তীরটা একটু মচ্কাইয়া গিয়া ভাঙিয়া যায়। স্রোত আর ঢেউ সেখানে প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধারা সেখানে নরম মাটি খুঁজিয়া, কাটিয়া, ভাঙিয়া, দুমড়াইয়া পথ সৃষ্টি করিতে থাকে। এক পাকে শতশত পল্লী দুই পাশে রাখিয়া অনেক জঙ্গল অনেক মাঠ-ময়দানের ছোঁয়া লইয়া ঘুরিয়া আসে–মেঘনার গৌরব আবার মেঘনার কোলেই বিলীন হইয়া যায়। এই তার ইতিহাস। কিন্তু সে কি আজকের কথা? কেউ মনেও করে না কিসে তার উৎপত্তি হইল। শুধু জানে সে একটি নদী। অনেক দূর-পাল্লার পথ বাহিয়া ইহার দুই মুখ মেঘনায় মিশিয়াছে। পল্লীরমনীর কাঁকনের দুই মুখের মধ্যে যেমন একটু ফাঁক থাকে, তিতাসের দুই মুখের মধ্যে রহিয়াছে তেমনি একটুখানি ফাঁক–কিন্তু কাঁকনের মতই তার বলয়াকৃতি।
অনেক নদী আছে বর্ষার অকুণ্ঠ প্লাবনে ডুবিয়া তারা নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। পারের কোনো হদিস থাকে না, সবদিক একাকার । কেউ তখন বলিতে পারে না এখানে একটা নদী ছিল । সুদিনে আবার তাদের উপর বাঁশের সাঁকোর বাঁধ পড়ে । ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়িরা পর্যন্ত একখানা বাঁশে হাত রাখিয়া আর একখানা বাঁশে পা টিপিয়া টিপিয়া পার হইয়া যায় । ছেলে-কোলে নারীরাও যাইতে পারে । নৌকাগুলি অচল হয় । মাঝিরা কোমরে দড়ি বাঁধিয়া সেগুলিকে টানিয়া নেয় । এপারে ওপারে ক্ষেত । চাষীরা দিনের রোদে তাতিয়া কাজ করে । এপারের চাষী ওপারের জনকে ডাকিয়া ঘরের খবর জিজ্ঞাসা করে । এপারের চাষী ঘাম মুছিয়া জবাব দেয় । গরুগুলি নামিয়া স্নান করিতে চেষ্টা করে । অবগাহন স্নান । কিন্তু গা ডোবে না । কাক- স্নান করা মাত্র সম্ভব হয় কোন রকমে । নারীরা কোমরজলে গা ডুবাইবার চেষ্টায় উবু হয় । দুই হাতে ঢেউ তুলিয়া নীচু–করা ঘাড়ে-পিঠে জল দিয়া স্নানের কাজ শেষ করে । শিশুদের ডুবিবার ভয় নাই বলিয়া মায়েরা তাদের জলে ছাড়িয়া দিয়াও নিরুদ্বেগে বাসন মাজে, কাপড় কাচে, আর এক পয়সা দামের কার্বলিক সাবানে পা ঘসে । অল্প দূরে ঘর । পুরুষমানুষে ডাক দিলে এখান হইতে শোনা যাইবে; তাই ব্যাস্ততা নাই ।
কিন্তু সত্যি কি ব্যাস্ততা নাই ? যে-মানুষটা এক-গা ঘাম লইয়া ক্ষেতে কাজ করিয়া বাড়ি গেল, তার ভাত বাড়িয়া দিবার লোকের মনে ব্যাস্ততা থাকিবেইত । দুপুরে নারীরা ঘাটে বেশি দেরি করে না । কিন্তু সকালে সন্ধ্যায় দেরি করে । পুরুষেরা এজন্য কিছু বলে না । তারা জানে এ নদী দিয়া কোনো সদাগরের নৌকা আসা- যাওয়া নাই ।
শীতে বড় কষ্ট । গম্ গম্ করিয়া জলে নামিতে পারে না । জল খুব কম । সারা গা তো ডোবেই না; কোমর অবধিও ডোবে না । শীতের কন্ কনে ঠাণ্ডা জলে হুম্ করিয়া ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিবার উপায় নাই; একটু একটু করিয়া শরীর ভিজে । মনে হয় একটু একটু করিয়া শরীরের মাংসের ভিতর ছুরি চালাইতেছে কেউ । চৈত্রের শেষে খরায় খাঁ খাঁ করে । এতদিন যে জলটুক্ অবশিষ্ট ছিল, তাও একটু একটু করিয়া শুষিতে শুষিতে একদিন নিঃশেষ হইয়া যায় । ঘামের গা ধুইবার আর উপায় থাকে না । গরুরা জল খাইতে ভুল করিয়া আসিয়া ভাবনায় কাতর হয় । মাঘের মাঝামাঝি সরষে ফুলে আর কড়াই-মটরের সবুজিমায় দুই পারে নকসা করা ছিল । নদীতেও ছিল একটু জল । জেলেরা তিন-কোণা ঠেলা-জাল ঠেলিয়া চাঁদা পুঁটি টেংরা কিছু-কিছু পাইত । কিন্তু চৈত্রের খরায় এ সবের কিছুই থাকে না । মনে হয় মাঘমাসটা ছিল একটা স্বপ্ন । চারিদিক ধু-ধু করা রুক্ষতায় কাতরায় । লোকে বিচলিত হয় না । জানে তারা , এ সময় এমন হয় ।