স্ত্রীলোকের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে রাও কমিটির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আর একটি আপত্তি এই যে, স্ত্রীলোকদের উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে তাদের নিৰ্বািঢ়স্বত্ব স্বীকার করা হয়েছে। প্রকৃত কথা, এক দায়ভাগশাসিত বাংলাদেশ ছাড়া মিতাক্ষরাশাসিত সমস্ত ভারতবর্ষেই এইরূপ নিৰ্বািঢ়-স্বত্বই স্বীকৃত। মিতাক্ষরাকার সুস্পষ্টভাবে সেই ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। কেবলমাত্র প্ৰিভি কাউন্সিলের নজির সমস্ত ভারতবর্ষের স্ত্রীউত্তরাধিকারীগণের সেই স্বত্ব লোপ হয়েছে। দায়ভাগ প্রচারিত স্ত্রী-উত্তরাধিকারীগণের জীবন-স্বত্বের বিধি–যা শাস্ত্ৰৰলে নয়, প্ৰিভি কাউন্সিলের নজিরবিলে এখন সমস্ত ভারতবর্ষে প্রচলিত আইন, তার ফল যে কিছুমাত্র মঙ্গলকর নয়–তা প্রত্যেক আইনব্যবসায়ী অবগত আছেন। এ নিয়ে যে মামলা মোকদ্দমা উপস্থিত হয়, তা স্ত্রীউত্তরাধিকারীগণের নিরর্থক ক্লেশকর। সম্পত্তির শেষপুরুষ— অধিকারীর যে পুরুষ ওয়ারিশগণের হিতার্থে এই জীবনস্বত্ব কল্পিত, তাঁরা প্রায়শই দূর সম্পর্কে সম্পর্কিত। তাদের অনুকুলে নিজের অত্যন্ত নিকট স্ত্রী-ওয়ারিশগণের সম্পত্তিভোগে বাধা জন্মানোর কিছুমাত্র অর্থ নেই। কয়েক বছর হল এক প্ৰস্তাবিত আইনে মা ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। মা যেখানে নিজের জীবনান্ত এই উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সম্পত্তি ছেলের জন্য মা রেখে বিক্রি করবেন, ধরে নেওয়া যেতে পারে শতকরা নব্বইটি জাযগায় উপযুক্ত কারণ আছে।
২
এই উত্তরাধিকার আইন সম্বন্ধে অনেক হিন্দুর মনে একটা ভুল বিশ্বাস আছে। তাঁরা মনে করেন যে, হিন্দুর উত্তরাধিকার আইন হিন্দুধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই আইনের পরিবর্তনে হিন্দুর ধর্মে আঘাত লাগবে। এই ধারণা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা-প্রসূত! দায়বিভাগ বিধি ধর্মশাস্ত্রের ব্যবহার অধ্যায়ের অন্তৰ্বতী। ধৰ্মশাস্ত্রের ব্যবহাব অধ্যায় যাকে ইংরেজিতে রিলিজিয়ান বলে, তার অন্তর্গত নয়। কারণ, ধর্মশাস্ত্র-বেত্তাগণ স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে, ব্যবহারবিধি ও উত্তরাধিকার বৈদিক বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ওদের ভিত্তি অর্থশাস্ত্ৰ ও লোকপ্রসিদ্ধি। সুতরাং উত্তরাধিকার বিধির পরিবর্তনে হিন্দুর ধর্ম অৰ্থাৎ রিলিজিয়নে কোনও আঘাত লাগে না। লোক ব্যবহারের উপর যার প্রতিষ্ঠা, লৌকিক অবস্থার পরিবর্তনে তার পরিবর্তন না ঘটলে লোকযাত্রা ও সমাজযাত্ৰা সুষ্ঠুভাবে নির্বাহ হয় না। সেই জন্য দায়ভাগকার জীমূতবাহন বাংলাদেশে অন্যত্র প্রচলিত উত্তরাধিকারবিধির পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন।
কথাটার একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন।
৩
হিন্দু দায়াধিকার বিধি হিন্দুধর্মের অঙ্গ; সুতরাং তার পরিবর্তনে ধর্মে আঘাত লাগে এই বিশ্বাসের মূলে আছে একটা ভুল ধারণা। সে ধারণা হচ্ছে–হিন্দুর ধর্মশাস্ত্ৰে ধৰ্ম কথাটা ইংরেজি রিলিজিয়ান শব্দের সমর্থবাচক। এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে ধর্মশাস্ত্ৰ কি তার টীকাকারদের মত থেকে নয়, কয়েকজন ইউরোপীয় লেখকের গ্রন্থ থেকে। এই সব লেখক হিন্দু সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বকে অপ্রমাণের জন্য একটি মত খাড়া করেছিলেন। হিন্দুর আইন তার ধর্ম অর্থাৎ রিলিজিয়ান থেকে পৃথক হয়ে পরিণতি লাভ করেনি। সকল সমগ্নজেই আদিতে ধর্ম ও আইন অবিশ্লেষিত অবস্থায় থাকে। সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম অর্থাৎ রিলিজিয়ান থেকে আইন স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। এইসব ইউরোপীয় লেখকেরা প্রচার করেছিলেন যে, হিন্দু সভ্যতা এই শেষ স্তরে পৌঁছতে পারেনি। হিন্দুর রিলিজিয়ন ও আইন চিরদিন অবিশ্লেষিত অবস্থায় থেকে গেছে। ইংরেজ লেখক হেনরি মেইন এই মতের একজন প্রধান প্রচারক। তার প্রাচীন আইন বা ‘এনসেন্ট ল’ নামক পুথি আমাদের দেশের আইন পরীক্ষার্থী ছাত্রদের পড়তে হয়। এই পুথিতে মেইন তার মত প্রচার করেছেন। হিন্দু সভ্যতার কুৎসাকারীদের এই মতকে সাহেবের লেখা বলে কোনও অনুসন্ধান না করেই আমরা মাথা পেতে নিয়েছি। এবং গর্বের সঙ্গে প্রচার করছি যে, আমরা হিন্দুরা ধমপ্ৰাণ জাতি, আমাদের যা কিছু সবই ধর্মের অঙ্গ। কিন্তু ধৰ্মশাস্ত্রকারগণ ও ধর্মশান্ত্রের ব্যাখ্যাত নিবন্ধকারগণ রিলিজিয়ন ও আইনের মধ্যে সুস্পষ্ট ভেদরেখা নির্দেশ করেছেন। ওর প্রথমটি হচ্ছে বৈদিক, দ্বিতীয়টি লৌকিক। একই ধর্মশাস্ত্রের গ্রন্থে এই উভয়বিধ জিনিসের আলোচনা আছে, কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের প্রভেদ সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করা আছে। ধর্মশাস্ত্রে ধর্ম কথাটির অর্থ ‘কর্তব্য’। কর্তব্য ও অকর্তব্যের বিধি ও নিষেধ ধৰ্ম শব্দের অর্থ।
মনুসংহিতার আরম্ভে আছে, ঋষিগণ ভগবান মনুর কাছে উপস্থিত হয়ে তার কাছে সমস্ত ধৰ্ম আনুপূর্বিক জানতে চেয়েছিলেন। সেই ধর্ম শব্দের ব্যাখ্যায় মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথি লিখেছেন: ‘ধর্ম শব্দঃ কর্তব্যতাবাচনঃ। ধর্ম শব্দঃ কর্তব্যাকর্তব্যয়োবিধি প্ৰতিষেধয়ো দৃষ্ট প্রয়োগঃ।’ এর অর্থ পূর্বেই বলেছি। এই যে কর্তব্য ও অকৰ্তব্য এটা হিন্দুর ঐহিক ও পািরত্রিক সমস্ত রকম কর্তব্য ও অকৰ্তব্যকে সূচিত করে। যে সকল করণীয় ও অকরণীয় ঐহিক নয় পারিত্রিক, সেগুলি রিলিজিয়ন অর্থে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। আর যে কৰ্তব্য ও অকৰ্তব্য ঐহিক তাঁরা ধর্ম; কিন্তু নন-রিলিজিয়স। রিলিজিয়ন অর্থে যে ধর্ম তার মূল হচ্ছে বেদ। আর যে ধর্ম নন-রিলিজিয়স তার মূল বেদ নয়, তার মূল লোকাচার ও লোকপ্ৰসিদ্ধি। বেদ হচ্ছে সেই ধর্মের প্রমাণ যা অন্য কোনও প্রমাণ দিয়ে জানা যায় না। বেদ শব্দের ব্যাখ্যায় মেধাতিথি লিখেছেন–’বিদন্তি অনন্য প্ৰমাণ বোদ্যং ধর্মলক্ষণমর্থমন্মাদিতি বেদঃ’ অৰ্থাৎ যে ধর্মের বিষয় অর্থাৎ কর্তব্যাকর্তব্যের বিষয় অন্য কোনও প্রমাণ দিয়ে জানা যায় না। তাই জানিয়ে দেয় বলেই বেদের নাম বেদ–যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে স্বৰ্গলাভ হয়। অন্য কোনও প্রমাণেই তা জানা যায় না, সুতরাং এখানে বেদই একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু মানুষের মঙ্গল কি অমঙ্গলের যে সকল উপায় লৌকিক প্রমাণেই জানা যায় সেটা বেদের বিষয় নয়, লৌকিক জ্ঞানের বিষয়। কারণ সেখানে বেদের কোনও প্রয়োজন নেই। মেধাতিথি লিখেছেন–’শ্রেয়ঃ সাধনং কৃষি সেবাদি ভবতি। পুরুষস্য কর্তব্য ত্বস্য চ তৎসাধনস্বভাবঅন্বয় ব্যতিরোেকাভ্যামবগম্যতে। যাদৃশেন ব্যাপারেন। কৃষ্যাদেঃ বৃহ্যাদিসিদ্ধিঃ সাপি প্রত্যক্ষাদবগম্য এব। যাগাদেন্তু সাধনত্বং যেন চ রূপেন অপূর্বোৎপত্তি ব্যবধানাদিনা তন্ন প্রত্যক্ষাদি অবগম্যম’ অর্থাৎ ‘কৃষি ও চাকুরি করে’ মানুষের শ্রেয় সাধন হয় এ জ্ঞান লৌকিক, অন্বয়-ব্যতিরেকে প্রমাণ দ্বারাই লোকে জানতে পারে। কি উপায়ে কৃষিকার্যের ফলে ধান প্রভৃতি ফসল ফলান যায় তা প্রত্যক্ষ প্রমাণেই মানুষ জানতে পারে। কিন্তু যাগযজ্ঞাদির ফলে যে এক অপূর্ব-ফলোৎপত্তি হয়ে পরকালে মানুষকে সুফল দেয় তা প্রত্যক্ষাদি কোনও লৌকিক প্রমাণেই জানা যায় না। সুতরাং এখানে বেদ প্রমাণ। কৃষি ও চাকুরিতে মানুষের ফললাভ, কি চাষের উপায়–এই জ্ঞানের প্রমাণ বেদ নয়। বেদে যদি এ সম্বন্ধে কোনও কথা থাকে। তবে তা প্রসঙ্গত, মীমাংসকদের ভাষায়, অনুবাদ মাত্র। প্রকৃত বেদ অর্থাৎ বিধিনিষেধেরত অঙ্গ নয়।